ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিচিত্র পেশার জীবন

ইচ্ছে একাগ্রতায় নিপুণ খেলা, মৃত্যুকূপেও হাসিরাশি আনন্দ

প্রকাশিত: ০৬:৩৩, ৩০ জুলাই ২০১৫

ইচ্ছে একাগ্রতায় নিপুণ খেলা, মৃত্যুকূপেও হাসিরাশি আনন্দ

মোরসালিন মিজান ॥ যারপরনাই বুড়ো একটা মোটরসাইকেল। বয়স পঞ্চাশ প্রায়। শ্রীহীন দেখতে। মনে হয়, কিছুক্ষণ আগে গ্যারেজ থেকে কলকব্জার ত্রুটি সারিয়ে আনা হয়েছে। তবে বাহনটির ওপর রাশেদ ওঠে বসলেই হলো, সব কেমন যেন বদলে যায়! যৌবনের দূরন্ত ঘোড়ার মতো ছুটে চলে মোটরসাইকেল। এর গায়ে গতরে বাড়তি শক্তি যোগ হয়। অথচ চলার পথটি এক কথায় ভয়ঙ্কর। অসংখ্য সরু কাঠের ফালি ভূমিতে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে দিয়ে একটি কূপের মতো বৃত্ত তৈরি করা হয়। সে বৃত্তের ভেতরের দেয়ালটি রাশেদের চলার পথ। তাতে কী? রাশেদ স্বাচ্ছন্দেই শুরু করেন। ভূমি থেকে মোটরসাইকেল স্টার্ট দেন তিনি। এরপর বৃত্তাকারে ঘুরতে ঘুরতে দেয়ালে ওঠে যান। অর্ধেক কাত হয়ে, অনেকটা ঝুলন্ত অবস্থায় চলতে থাকে সাইকেলটি। কখনও একেবারে উপরে ওঠে যায়। কখনও মাঝখানে বা নিচে নেমে আসে। এ কসরত মুন্সিয়ানা দারুণ উপভোগ করেন দর্শক। চোখের পলক পড়ে না তাদের। রাশেদ একইভাবে চালিয়ে দেখান প্রাইভেটকার। চার চাকার গাড়িটির ওপরও তার আশ্চর্য নিয়ন্ত্রণ। অনায়াসে বৃত্তাকার পথ ধরে ছুটে চলে গাড়ি। দৃশ্যটি দেখে সত্যি অবাক না হয়ে পারা যায় না। তুমুল করতালিতে ফেটে পড়েন দর্শক। তাদের কাছে রাশেদ যেন ম্যাজিশিয়ান হয়ে ওঠেন। আদতে ঘটনা অন্য। পুরোটাই চালকের মেধা, শ্রম ও ইচ্ছে শক্তির যোগফল। কিন্তু সামান্যতম ভুল যদি হয়ে যায়, যদি এক সেকেন্ডের জন্য মনোযোগ নষ্ট হয় তবে জীবনের শঙ্কা। এরপরও বিচিত্র কাজটিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন রাশেদ। এখন এটি তার জীবিকা। লোকজ খেলার অংশ হয়ে ওঠা এ খেলা দেখাতে বিভিন্ন গ্রাম-গঞ্জে ঘুরে বেড়াতে হয় তাকে। বড় বড় শহর থেকেও ডাক আসে। চলতি বছরের গোড়ার দিকে রাজধানী শহর ঢাকার আগারগাঁয়ে খেলা দেখাতে আসেন তিনি। তখন বাণিজ্যমেলার মাঠে গিয়ে দেখা যায়, একটি কোণ বেছে নিয়ে তৈরি করা হয়েছে প্যান্ডেল। টিকেট কেটে খেলা দেখতে ঢুকছেন ছেলে বুড়ো সবাই। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠে যাচ্ছেন। দর্শকের জন্য নির্ধারিত জায়গায় দাঁড়িয়ে দেখা যায়, রাশেদের সাধারণ পরিচ্ছদ গায়ে। ব্লু জিন্স আর ফুল হাতা শার্ট। অন্য সবার মতোই বাইকে ওঠে বসেন তিনি। এই বসা দেখেই অনুমান করা যায়, পোষ মানা মোটরসাইকেল। ভূমিতে এক চক্কর দিয়েই ওপরে ওঠে যায়। নিউটনের মধ্যাকর্ষণ শক্তিকে ষোলআনা কাজে লাগান চালক। গতি বাড়তে থাকে। এভাবে জিরো ডিগ্রী থেকে ৬০ এমনকি ৮০ ডিগ্রীতে পৌঁছে যান। থর থর করে কাঁপতে থাকে কাঠের বেড়া। কিন্তু চালক অবিচল। এমন স্বাচ্ছন্দে চালিয়ে যান যে, পিচঢালা রাস্তায়ও অনেকের পক্ষে এভাবে বাইক চালানো সম্ভব হবে না। দেখে তাই মন্ত্রমুগ্ধ দর্শক। কিন্তু তখনও অনেক দেখার বাকি। প্রচ- গতির মোটরসাইকেলের সিটের ওপর রাশেদ দুই পা উঠিয়ে ভাঁজ করে বসে থাকেন। কখনও চেয়ারে পা তুলে বসার মতো করে বসেন। কিন্তু দু’হাত ছেড়ে দিলে তো সবই শেষ! অথচ এ কা-টিও দিব্যি করে দেখান তিনি। চলন্ত বাইক থেকে দর্শকদের উদ্দেশে হাত নাড়েন। তখনও কোন ব্যত্যয় ঘটে না চালনায়। বাইক দিব্যি চলে। এক সময় গতি কমাতে কমাতে নিচে নেমে আসে। রাশেদ মোটরসাইকেলের পর ওঠেন গাড়িতে। একটি লাল মারুতি সুজুকি। এতো অল্প জায়গায় গাড়ি ঘোরানোই কঠিন কাজ। অথচ চার চাকার গাড়ি দেয়াল আঁকড়ে ধরে ঘুরতে ঘুরতে উপরে ওঠে যায়। এক হাতে গাড়ির স্টিয়ারিং, অন্য হাত জানালার বাইরে দিয়ে দর্শকের করতালির জবাব দেন চালক। কখনও জোরে হর্ন বাজান। এভাবে বেশ কয়েকবার। অনেকটা উড়ে বেড়ানোর মতো ড্রাইভ করে নিচে নেমে আসেন। এরপর ছোট্ট বিরতি। নতুন দর্শক আসার আগ পর্যন্ত সাধারণ মানুষ তিনি। এ সময় কূপের বাইরে বসে কথা হয় তার সঙ্গে। কাজের কাজী বলেই হয়ত কথা বলেন গুনে গুনে। কীভাবে এ ভয়ঙ্কর পেশায় আসা? এমন প্রশ্নে পেশাটির সঙ্গে তাদের পারিবারিক সম্পর্কের কথা জানা যায়। রাশেদ জানান, তার দাদা এ খেলা দেখিয়েছেন। তার কাছ থেকে শিখেছিলেন বাবা। বড় ভাইও এ খেলা দেখান। রাশেদের শেখা বড় ভাইয়ের কাছ থেকে। ২০০৭ থেকে চালানো শুরু করেন প্রাইভেটকার। এটি তিনিই প্রথমবারের মতো করছেন বলে জানান। রাশেদের কসরত দেখে দর্শকই ভয় পেয়ে যান। শঙ্কায় থাকেন, কখন না আবার ভুল করে বসেন চালক! গাড়ি বা সাইকেল এসে যদি দর্শককে ছুঁয়ে দেয়! তবে রাশেদ এমন শঙ্কা হেসেই উড়িয়ে দেন। বলেন, সারাবছর এ-ই করি। অভ্যাস হয়ে গেছে। চোখ বেঁধেও চালাতে পারি। চলন্ত অবস্থায় কোল্ড ড্রিংকস খেতে পারি। কখনও দুর্ঘটনা ঘটেনি? জানতে চাইলে অবলীলায় বলেন, দুর্ঘটনা খেলার অংশ হয়ে গেছে এখন। কয়েকবার আহত হয়েছি। ২০০৯ সালে লক্ষ্মীপুরে খেলা চলাকালীন সময় হঠাৎ বিদ্যুত বন্ধ হয়ে যায়। আকস্মিক এ ঘটনায় নিয়ন্ত্রণ রাখতে না পেরে নিচে পড়ে গিয়েছিলাম। ২০১৩ সালে ময়মনসিংহে খেলা দেখানোর সময় হঠাৎ প্রাইভেটকারের ইঞ্জিনে ত্রুটি দেখা দেয়। এ অবস্থায় ছিটকে পড়তে হয়েছিল। গাড়িও নিচে পড়ে ওল্টে যায়। মেরুদ-ে আঘাত পেয়েছিলাম তখন। হাত পায়ে চোট তো ছিলই। ২০০৩ সালে সুনামগঞ্জে খেলা দেখানোর সময় পেছনের চাকা ফেটে গেলে আহত হন তিনি। পা ভেঙে যায়। এরপরও মাথায় এমনকি হ্যালমেট পরেন না। এমন ঝুঁকি কেন নেন? উত্তরে তিনি বলেন, হেলমেট নয়। আমার মনোযোগই আমার রক্ষাকবচ। মনোযোগটাই শেষকথা। টেনশান থাকলে, চাপ নিলে এ খেলা দেখানো সম্ভব নয়। খেলা শুরুর আগে তাই সব ধরনের টেনশান ফ্রি থাকেন বলে জানান। একই কারণে এমনকি বিয়ে করেননি তিনি। খেলার জন্য বিয়ে করেননি! রাশেদ তার সমস্ত প্রেম তুলে রেখেছেন অভিনব এ পেশার জন্য!
×