ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এরা কারাবন্দী আমিরকে ফিল্মি কায়দায় ছিনিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করছিল

জেএমবির একাংশের ভারপ্রাপ্ত আমিরসহ ৮ জঙ্গী গ্রেফতার

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ২৯ জুলাই ২০১৫

জেএমবির একাংশের ভারপ্রাপ্ত আমিরসহ ৮ জঙ্গী গ্রেফতার

স্টাফ রিপোর্টার ॥ নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন জেএমবির একাংশের ভারপ্রাপ্ত আমিরসহ আট জনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ জিহাদী বই, লিফলেট ও সিডি (কম্পিউটার ডিস্ক) উদ্ধার হয়েছে। উদ্ধারকৃত সিডিতে শারীরিক ও আগ্নেয়াস্ত্রের বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণের বিদেশী ভিডিও চিত্র রয়েছে। এ সব ভিডিও দেখিয়ে বাংলাদেশে জঙ্গীদের আগ্রহী করার পাশাপাশি প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। গ্রেফতারকৃতদের তিন দিনের রিমান্ডে পেয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে ডিবি। গ্রেফতারকৃতরা ময়মনসিংহের ত্রিশালের মতো ফিল্মি কায়দায় জেএমবির কারাবন্দী আমীর মুফতি মাওলানা সাইদুর রহমান জাফর ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের আধ্যাত্মিক নেতা মুফতি মাওলানা জসীমুদ্দিন রাহমানীকে ছিনিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করছিল। কতিপয় আইনজীবীদের মাধ্যমে এ বিষয়ে গ্রেফতারকৃতদের যোগাযোগ হতো। গ্রেফতারকৃতদের কলকাতার খাগড়াগড়ে জেএমবির বোমা তৈরির কারখানায় বিস্ফোরণ ও ত্রিশালে জঙ্গী ছিনতাইয়ের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এছাড়া লেখক অভিজিৎ রায় ও সিলেটে ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ হত্যা, চ্যানেল আইয়ের উপস্থাপক মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী এবং গোপীবাগে সিক্স মার্ডারের বিষয়েও জানতে চাওয়া হবে গ্রেফতারকৃতদের কাছে। গত সোমবার সন্ধ্যা সাতটায় পুলিশ সদর দফতরের এলআইসি (ল ফোল ইন্টারসেপশন) শাখা ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার মোঃ মনিরুল ইসলামের নির্দেশনায় ডিবির উত্তর বিভাগের উপ-কমিশনার শেখ নাজমুল আলমের তদারকি ও সমন্বয়ে অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মোঃ মাহফুজুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার মুহাম্মদ মঞ্জুর মোর্শেদের নেতৃত্বে রাজধানীর ঢাকার উত্তরায় যৌথ অভিযান চালানো হয়। অভিযানে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন জামা’তুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) ভারপ্রাপ্ত আমির ও কারাবন্দী জেএমবি আমীর জামায়াতে ইসলামীর সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা মুফতি মাওলানা সাইদুর রহমান জাফরের ছেলে আবু তালহা মোহাম্মদ ফাহিম ওরফে পাখি (২২), মোঃ শফিকুল ইসলাম (২৪), মোঃ রুহুল আমিন (২৫), মোঃ ইমদাদুল হক (২৬), মোঃ রফিক আহম্মেদ ওরফে রয়েল ((৩৫), মোঃ মোস্তফা (৩০), মোঃ সাখাওয়াত উল্লাহ (৩০) ও মোঃ আলী আশরাফ রাজীব (২৮) গ্রেফতার হয়। তাদের কাছ থেকে বিপুল জিহাদী বই, জিহাদী লিফলেট, বিভিন্ন প্রকার জিহাদী সিডি, জঙ্গী প্রশিক্ষণ ভিডিও, জেএমবির তথ্য ও ভিডিও ক্লিপসহ ১০টি মোবাইল ফোন ও ময়মনসিংহ- হ-১২-৩২৬৬ নম্বরের একটি মোটরসাইকেল উদ্ধার হয়। আমাদের কোর্ট রিপোর্টার জানান, বিকেলে গ্রেফতারকৃতদের ঢাকার সিএমএম আদালতে সোর্পদ করে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করে ডিবি পুলিশ। আদালত শুনানি শেষে তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এর আগে মঙ্গলবার দুপুরে ডিএমপির মিডিয়া বিভাগের আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ডিবির যুগ্ম-কমিশনার মনিরুল ইসলাম জানান, গ্রেফতারকৃতরা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও স্থাপনায় হামলা করার পরিকল্পনা করছিল। ইতোপূর্বে তারা বেশ কয়েকটি হামলার পরিকল্পনা করে ব্যর্থ হয়েছে। জেএমবির কারাবন্দী আমীর মুফতি মাওলানা সাইদুর রহমান জাফর ও নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের আধ্যাত্মিক নেতা মুফতি মাওলানা জসীমুদ্দিন রাহমানীকে ময়মনসিংহের ত্রিশালে তিন জঙ্গীর মতো ফিল্মি কায়দায় ছিনিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করছিল। হাজিরার সময় আদালতে কতিপয় আইনজীবীর মাধ্যমে গ্রেফতারকৃতরা সাইদুর রহমান ও জসীমুদ্দিন রাহমানীর সঙ্গে যোগাযোগ করত। এছাড়া গ্রেফতারকৃতদের সঙ্গে কারাবন্দী জেএমবির শীর্ষ নেতাদের মোবাইল ফোনে কথাবার্তা হতো। গ্রেফতারকৃতরা মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গী সংগঠন আইএস (ইসলামিক স্টেট) ও আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন আল কায়দার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করছিল। প্রসঙ্গত, ২০১০ সালের ২৪ মে রাজধানীর কদমতলী থেকে জেএমবির আমীর জামায়াতে ইসলামীর সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা মুফতি মাওলানা সাইদুর রহমান জাফর পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়। ডিবির সূত্রগুলো বলছে, সাইদুর রহমান গ্রেফতারের পর জেএমবির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে তারই ছেলে বাশার দলের হাল ধরে। পরবর্তীতে বাশারও গ্রেফতার হয়। বাশারের পর সাইদুর রহমানের আরেক ছেলে ও গ্রেফতারকৃত ফাহিমের বড়ভাই মোহাম্মদ শামীম জেএমবির হাল ধরে। ২০০৫ সালে শামীম মাহফুজ গ্রেফতার হয়ে ১০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত হয়। শামীম জেএমবির আইটি (তথ্য প্রযুক্তি) শাখার প্রধান ছিল। কিন্তু জামিনে বের হয়ে আবার জেএমবির কার্যক্রম শুরু করে। গত বছর ৩০ জুলাই ডিবি পুলিশ সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল এলাকা থেকে শামিম মাহফুজ ওরফে সুমন ওরফে ম্যানরিং মুরং (ছদ্মনাম) (৩৮), জাহিদুর রহমান (৩৩) ও ইসমাইল হোসেনকে (৩৯) তৈরিকৃত বোমা, বোমা তৈরির সরঞ্জাম ও বোমা তৈরির কলাকৌশল সমৃদ্ধ একটি ল্যাপটপসহ গ্রেফতার করে। শামীম মাহফুজের সঙ্গে বিএনপির সাবেক মন্ত্রী ও একুশে আগস্ট শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলা করে ২৪ জনকে হত্যা এবং অন্তত অর্ধহাজার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে আহত করার মামলায় কারাবন্দী আব্দুস সালাম পিন্টুর ভাই হুজি নেতা মুফতি মাওলানা তাইজউদ্দিন, জামায়াতুল মুসলিমীনের আমীর এবং আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের অন্যতম সংগঠক মুফতি ইজাজ আহমেদ এবং আফগানিস্তানে পলাতক মুফতি ইমরানের যোগাযোগ ছিল। তারা পাকিস্তান থেকে টাকা পাঠাত। সম্প্রতি পাকিস্তানের একটি স্কুলে জঙ্গীরা ৪২ জন শিশুকে হত্যা করলে পাকিস্তান সরকার জঙ্গী দমনে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে। সেই অভিযানে বাংলাদেশী চার জঙ্গী নিহত হয়। তার মধ্যে ইজাজ ওরফে কারগিল রয়েছে। ইজাজ কারাবন্দী জেএমবি আমীর মুফতি মাওলানা সাইদুর রহমান জাফরের মেয়ের জামাই। শামিন মাহফুজের মাধ্যমে বান্দরবনের থানচীতে ট্রেনিংপ্রাপ্ত প্রায় ২শ’ জঙ্গী বর্তমানে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে বিভিন্ন অপারেশনে আলকায়েদা ও তালেবান জঙ্গীদের সঙ্গে অংশ নিচ্ছে। এসব জঙ্গীদের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ ছাড়াও তাদের আয়কৃত টাকার একটি বড় অংশ বাংলাদেশে আসে। ব্যবসায়ী, পাকিস্তানে থাকা জঙ্গীদের পাঠানো টাকা বাংলাদেশের একটি বির্তকিত ব্যাংকের মাধ্যমে জেএমবির কাছে আসে। এসব টাকা ব্যয় হচ্ছে জেএমবির কার্যক্রমে। এরপর গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর ডিবি পুলিশ রাজধানীর তুরাগ থানাধীন আশুলিয়া ল্যান্ডিং স্টেশনের পার্র্কিং এলাকা থেকে জেএমবির একাংশের ভারপ্রাপ্ত আমির আব্দুল্লাহ আল তাসনীম ওরফে নাহিদ (২৯), জেএমবির সক্রিয় সদস্য মোঃ নাঈম আলী (২৮), মোঃ সিকান্দার আলী ওরফে নকি (২৫), মাহমুদ ইবনে বাশার (২৩), মোঃ মাসুম বিল্লাহ (২৬), ফুয়াদ হাসান (১৮) ও আলী আহম্মদসহ (২৪) সাত জনকে গ্রেফতার করে। তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক উদ্ধার হয়। ডিবির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম জানান, জেএমবির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা গ্রেফতারের পর কারাবন্দী সাইদুর রহমানের আরেক ছেলে গ্রেফতারকৃত আবু তালহা মোহাম্মদ ফাহিম ওরফে পাখি জেএমবির ভারপ্রাপ্ত আমির হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিল। ফাহিমের বিরুদ্ধে রাজশাহী ও হবিগঞ্জ জেলায় একাধিক মামলা রয়েছে। ফাহিম ইতোপূর্বে গ্রেফতার হয়েছিল। প্রায় নয় মাস আগে জামিনে ছাড়া পেয়ে আবার জেএমবির কার্যক্রম শুরু করে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে রয়েল ময়মনসিংহের চুরখাই নামক স্থানে হোটেল ব্যবসায় জড়িত। হোটেল ব্যবসার টাকা জেএমবির কার্যক্রমে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া মোস্তফা, সাখাওয়াত ও রাজিব জেএমবির গায়েরে এহসার সদস্য। তারা জেএমবির স্বক্রিয় কর্মী হিসেবে সর্বক্ষণ কাজ করে। তারা জেএমবির কাছ থেকে মাসিক হারে বেতন পেয়ে থাকে। সাখাওয়াত তথ্য প্রযুক্তিতে পারদর্শী। সেই মূলত আইএস ও আল কায়েদার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের কাজটি করছিল। গ্রেফতারকৃতরা একেক জন একেক জেলার জেএমবির হয়ে দায়িত্ব পালন করছিল। তারা বড় ধরনের অপারেশন চালাতে ঢাকার উত্তরায় একত্রিত হয়েছিল। ডিবির যুগ্ম-কমিশনার মনিরুল ইসলাম জানান, গত বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে ময়মনসিংহ জেলা জজ আদালতে হাজির করার সময় ময়মনসিংহের ত্রিশাল থানাধীন আমিরাবাড়ি সাইনবোর্ড এলাকা থেকে কমান্ডো স্টাইলে প্রিজনভ্যানে হামলা করে এক পুলিশকে হত্যা করে জেএমবির মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি রাকিব হাসান ওরফে হাফেজ মাহমুদ ওরফে রাসেল (৩৫), সালাউদ্দিন সালেহীন (৩৮) ও যাবজ্জীবন কারাদ-প্রাপ্ত বোমারু মিজানকে (৩৫) ছিনিয়ে নেয় জেএমবি। হামলায় নিহত হন প্রিজন ভ্যানে দায়িত্বে থাকা কনস্টেবল মোহাম্মদ আতিক। আহত হন উপ-পরিদর্শক হাবিবুর রহমান ও কনস্টেবল সোহেল মিয়া। পরে পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন রাকিব হাসান। এছাড়া গত বছরের ২ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের খাগড়াগড়ে জেএমবির আস্তানায় বোমা বিস্ফোরণে দু’জন নিহত ও একজন আহত হয়। ওই ঘটনার আস্তানা থেকে গ্রেফতার হয় রাজিয়া বিবি ও আমিনা বেগম। গ্রেফতারকৃতদের ত্রিশালের জঙ্গী ছিনতাই ও পশ্চিমবঙ্গের খাগড়াগড়ের বিস্ফোরণ এবং সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বেশ কয়েকটি চাঞ্চল্যকর হত্যার বিষয়েও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। সংবাদ সম্মেলনে ডিবির উপ-কমিশনার শেখ নাজমুল আলম, মাহবুবুর রহমান, সাজ্জাদুর রহমান, মাশরুকুর রহমান খালেদ ও মিডিয়া বিভাগের উপ-কমিশনার মুনতাসিরুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।
×