ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

এপিজে আবদুল কালাম

প্রকাশিত: ০৩:৪২, ২৯ জুলাই ২০১৫

এপিজে আবদুল কালাম

উপমহাদেশের আকাশে জ্বলজ্বলে তারকা ছিলেন তিনি। চলে গেলেন সেই নক্ষত্রের দেশে। তিনিই জ্বেলে দিয়েছিলেন বিজ্ঞানের শিখা ভারতবর্ষের প্রতিটি মানুষের মননে। স্বপ্ন জাগিয়েছেন তরুণদের মনে। মাথায় ছিল তাঁর পরমাণু বিজ্ঞানের সূত্রাবলী, বুকে ছিল সুরের ব্যঞ্জনা। আইনস্টাইনের মতো বেহালাতেও থাকতেন নিমগ্ন। মেঘের আড়ালে যেমন সূর্য থাকে-ঠিক তেমনি মারণাস্ত্রের বহিরাবরণে পরিপূর্ণ ছিল সুরের ব্যঞ্জনায় জগতখ্যাত এই দুই বিজ্ঞানীর। বলতেন- জীবন এক কঠিন খেলা। এই খেলায় জয় তখনই সম্ভব যখন ব্যক্তি হিসেবে জন্মগতভাবে পাওয়া অধিকারকে ধারণ করা হবে। বিশ্বাসও করতেন, জীবনে সমস্যার প্রয়োজন আছে। সমস্যা আছে বলেই সাফল্যের এত স্বাদ। যে হৃদয় দিয়ে কাজ করে না, শূন্যতা ছাড়া সে কিছুই অর্জন করতে পারে না। এমনটাও বুঝতেন যে, আকাশের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, মানুষ একা নয়, পুরো মহাবিশ্ব মানুষের প্রতি বন্ধুসুলভ এবং এই মহাবিশ্ব তাকেই অকাতরে দিতে প্রস্তুত, যে স্বপ্ন দেখে ও কাজ করে। নিজে স্বপ্ন দেখতেন ছাত্র জীবনেই বিমানের চালক হবেন। কিন্তু পাইলট হওয়ার পরীক্ষায় নবম হওয়ার কারণে আর বিমানের চালক হয়ে উঠতে পারেননি। বিমানচালক হতে না পারলেও নিজের অদম্য চেষ্টায় তিনি হয়ে উঠলেন ‘মিসাইল ম্যান’। ১৯৯৮ সালে পোখরান বিস্ফোরণ পরীক্ষার অন্যতম কারিগর ছিলেন তিনি। বঙ্গোপসাগর সৈকতেই দু’দশক ধরে একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্রের সফল উৎক্ষেপণ করে গেছেন তিনি। মহাকাশ ও পরমাণু গবেষণায় তার অবদানের জন্য সম্মানিত হয়েছিলেন পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণ ও ভারতরতœ পদকে। ২০০২ সালে ভারতের একাদশতম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় তাঁর ভবনের দরোজা সর্বসাধারণ, বিশেষ করে শিশুদের জন্য খুলে দেয়া হয়েছিল। সব বয়সী এবং বিজ্ঞানী ও শিক্ষক সকলের কাছেই ছিলেন তিনি সর্বসাধারণের আপনজন। মেয়াদ শেষে তিনি ফিরে গিয়েছিলেন শিক্ষার জগতে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা কেন্দ্রে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে জ্ঞান বিতরণ করতেন। এরই এক পর্যায়ে মেঘালয়ের রাজধানী শিলংয়ে সোমবার এক অনুষ্ঠানে বিজ্ঞানবিষয়ক ভাষণ দিতে গিয়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুতে ভারতে ৭ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে। শিলংয়ে পৌঁছে তিনি বলেছিলেন, ‘ব্রহ্মপুত্রের কাছে গিয়েছিলাম। আমার বড্ড প্রিয় নদ। এই নদের সংস্কার করতে চাই।’ কিন্তু সেই কাজ আর শেষ হলো না আবুল পাকির জয়নুল আবেদিন আবদুল কালামের। ১৯৩১ সালের ১৫ অক্টোবর তামিলনাড়ুর উপকূল সংলগ্ন রামেশ্বর গ্রামের এক দরিদ্র মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তাঁর পিতা ছিলেন নৌকার মাঝি। শৈশবেই তাঁকে জীবিকার তাগিদে কাজ শুরু করতে হয়। স্কুল শেষে সংবাদপত্র বিতরণ করতেন বাড়ি বাড়ি গিয়ে। গণিতে আগ্রহ থাকলেও পাঠ করেছেন পদার্থবিজ্ঞানে। পরে এ্যারোস্পেস নিয়ে পড়াশোনা করেন। এরপর তিনি সেনাবাহিনীর জন্য ছোট হেলিকপ্টারের নক্সা করতেন। ১৯৯২ সালে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য বিজ্ঞান উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন। ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থার বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞান প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর ৭৯তম জন্মদিনকে জাতিসংঘ বিশ্ব ছাত্রদিবস হিসেবে ঘোষণা করে। চল্লিশ বছর ধরে বিভিন্ন বিজ্ঞান ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। শুধু ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতে সফল ছিলেন তা নয়, ভারতের চন্দ্রযান অভিযানেরও তিনি পথিকৃৎ। অকৃতদার এই বিজ্ঞানী একাধিকবার বাংলাদেশে এসেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলাপকালে বাংলাদেশের বিজ্ঞানের উন্নতির জন্য নানা পরামর্শ দিয়েছেন। বাংলাদেশসহ বিশ্ববাসী তাঁর মৃত্যুতে শোকাভিভূত। তাঁকে হারিয়ে বিশ্ব একজন প্রথিতযশা বিজ্ঞানীকে হারাল। আর উপমহাদেশ হারাল এক মহৎ মানুষকে। তাঁর জীবন ও কর্ম সবার প্রেরণা হয়ে থাকবে। এই মহান বিজ্ঞানীর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
×