ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

কৌশলে এড়িয়ে চলেছেন

খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখাও করেন না সিনিয়র নেতারা

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ২৮ জুলাই ২০১৫

খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখাও করেন না সিনিয়র নেতারা

শরীফুল ইসলাম ॥ বিভিন্ন কারণে ক্ষুব্ধ থাকায় খালেদা জিয়ার কাছে ভিড়তে চাচ্ছেন না বিএনপির সিনিয়র নেতারা। না ডাকলে তাদের কেউ খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখাও করতে যান না। সিনিয়র নেতাদের মতামত না নিয়ে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন এবং ৬ জানুয়ারি থেকে টানা ৯২দিন আন্দোলন এবং দল পরিচালনায় লন্ডন প্রবাসী সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান ছাড়া আর কারও পরামর্শ না নেয়ায় সিনিয়র নেতারা হতাশ হয়ে এখন কৌশলে খালেদা জিয়াকে এড়িয়ে চলেছেন। সূত্র মতে, আগে দলের যে কোন বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া সিনিয়র নেতাদের মতামত নিলেও বছর দুয়েক ধরে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছেলে তারেক রহমান ছাড়া কারও মতামত নেন না। আর দলের স্বার্থে আগ বাড়িয়ে কিছু করতে গেলেও তারেক রহমান তাতে হস্তক্ষেপ করেন। তখন খালেদা জিয়াও তারেক রহমানের পক্ষে সায় দেন। কিন্তু বিদেশে অবস্থান করেও দলীয় কর্মকা-ে তারেক রহমানের হস্তক্ষেপ মানতে পারছেন না বিএনপির সিনিয়র নেতারা। এই হস্তক্ষেপ বন্ধ না হলে সিনিয়র নেতাদের মধ্যে কেউ কেউ বিএনপির রাজনীতি ছেড়ে দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আর কেউ কেউ আস্তে আস্তে দলে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছেন। জানা যায়, প্রায় ২ বছর ধরে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া দল পরিচালনার ব্যাপারে ছেলে তারেক রহমান ছাড়া আর কোন সিনিয়র নেতার মতামত নেন না। এ কারণে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান সম্পর্কে সিনিয়র নেতাদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। আগে নিয়মিত গুলশান কার্যালয়ে গিয়ে সিনিয়র নেতারা খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে দলের স্বার্থে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিলেও ইদানিং তারা দলীয় প্রধানকে কৌশলে এড়িয়ে চলছেন। তবে কোন কাজে ডাকলে গুলশান কার্যালয় কিংবা বাসায় গিয়ে দেখা করেন। দলীয় কর্মকা- থেকে দূরত্ব বজায় রেখে অধিকাংশ সিনিয়র নেতাই নিজেদের পেশাগত কাজসহ ব্যক্তিগত কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের শেষের দিকে সারাদেশে কঠোর আন্দোলন করতে গিয়ে সরকারকে চরম বেকায়দায় ফেলে বিএনপি-জামায়াত। কিন্তু সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে আলোচনা না করেই ২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচী পালনের ঘোষণা দেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। কিন্তু সরকার কঠোর হস্তে এ কর্মসূচী ঠেকানোর পদক্ষেপ নিলে রাজধানীতে অবস্থানরত বিএনপির সব সিনিয়র নেতা আত্মগোপনে চলে যান। এর ফলে ২৯ ডিসেম্বর ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচী পালন করতে বিএনপির কোন নেতাকর্মী রাজপথে নামেননি। ওইদিন বিকেলে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া গুলশানের বাসা থেকে বের হতে চাইলেও পুলিশ তাকে বের হতে দেয়নি। এ কারণে খালেদা জিয়া ঘোষিত ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচী ব্যর্থ হয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়ার আগে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের মতামত নেননি দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। অবশ্য লন্ডন প্রবাসী ছেলে তারেক রহমানের মতামত তিনি ঠিকই নেন। এ কারণে নির্বাচনে অংশ নিলে যাদের বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা ছিল এমন দলীয় নেতারা খালেদা জিয়ার ওপর ক্ষুব্ধ হন। তাই ওই নির্বাচন প্রতিহত করতে খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে কেন্দ্রভিত্তিক সংগ্রাম কমিটি গঠনের কথা বলা হলেও সিনিয়র নেতারা সহযোগিতা না করায় সে নির্বাচন বানচাল করতে পারেনি বিএনপি। নির্বাচনের দিন ঘর থেকেই বের হয়নি বিএনপির নেতাকর্মীরা। এ কারণে আওয়ামী লীগ সমমনা দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচন করে বিজয়ের ফসল ঘরে তুলতে সক্ষম হয়। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সমমনা দলগুলোকে নিয়ে সরকার গঠন করায় রাজনৈতিকভাবে চরম বেকায়দায় পড়ে বিএনপি। ক্ষমতা থেকে বিএনপি অনেক দূরে সরে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের মধ্যে দেখা দেয় চরম হতাশা। এই হতাশা থেকে দলের নেতাকর্মীদের মুক্তির কোন পথই খুঁজে পাচ্ছিলেন না খালেদা জিয়া। এ পরিস্থিতিতে আন্দোলনের কি কর্মসূচী নেয়া যায় তা নিয়ে ছেলে তারেক রহমানের সঙ্গে পরামর্শ করেন খালেদা জিয়া। ৬ জানুয়ারি থেকে সরকারবিরোধী টানা আন্দোলন শুরুর পরও তারেক রহমান ছাড়া বিএনপির আর কোন সিনিয়র নেতার পরামর্শ নেননি বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। হঠাৎ করে বাসা ছেড়ে গুলশান দলীয় কার্যালয়ে অবস্থান করে নিজেই ৬ জানুয়ারি থেকে টানা অবরোধ কর্মসূচী পালনের ঘোষণা দেয়ায় বিএনপির সিনিয়র নেতারা অবাক হন। তবে এ কর্মসূচির প্রতি তাদের সায় না থাকায় খালেদা জিয়াকে না জানিয়েই কৌশলে আত্মগোপনে চলে যান তারা। সিনিয়র নেতারা রাজপথে না থাকায় দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতারাও আন্দোলনের সমর্থনে মাঠে নামেননি। এ কারণে খালেদা জিয়ার ডাকা টানা ৯২ দিনের অবরোধ ও দফায় দফায় ডাকা হরতাল ফ্লপ হয়। মাঝখান থেকে আন্দোলন সমর্থনকারী কিছু ক্যাডার ব্যাপক নাশকতামূলক কর্মকা- চালিয়ে জনমনে ঘৃণা ও ক্ষোভের সঞ্চার করেছে। তাই এ আন্দোলনে বিএনপির দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি হয়েছে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন। কিন্তু এ ক্ষতি কাটিয়ে কিভাবে এগিয়ে যাওয়া যায় সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে সে ব্যাপারেও পরামর্শ করছেন না খালেদা জিয়া। সাড়ে ৫ বছর ধরে বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল হচ্ছে না। কিন্তু তা না করে সরকার বিরোধী টানা আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পর বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া সর্বস্তরে দলকে ঢেলে সাজানোর কথা বললেও এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে সিনিয়র নেতাদের কোন পরামর্শ নেননি। তাই দল কোন পথে চলছে তা বুঝে উঠতে পারছেন না বিএনপির সিনিয়র নেতারাও। তবে এ জন্য দলীয় হাইকমান্ডের কর্মকা-ের প্রতি ক্ষুব্ধ থাকলেও প্রকাশ্যে কিছুই বলছেন না তারা। তবে তাদের মধ্যে কেউ কেউ মাঝে মধ্যে দলীয় হাইকমান্ডের সমালোচনা করতেও ছাড়ছেন না। সম্প্রতি দলের বেশ ক’জন সিনিয়র নেতা প্রকাশ্যেই বলেছেন তাদের দল এখন জিয়ার আদর্শ থেকে সরে গেছে। কেউ কেউ বলেছেন, এই বিএনপি দিয়ে হবে না। আবার কোন কোন সিনিয়র নেতা জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করার কথাও বলেছেন। কেউ কেই দলছুট সব নেতাকে ফিরিয়ে আনার কথা বলেছেন। কিন্তু তাদের মুখে এ ধরনের কথা শুনে তারেক রহমান তার মা খালেদা জিয়ার কাছে নালিশ করেন বলে জানা যায়। আর এ কারণেই সম্প্রতি সিনিয়র নেতাদের ডেকে খালেদা জিয়া শাসিয়েছেন এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের বক্তব্য রাখা থেকে বিরত থাকতে বলেছেন। এ কারণে ইদানিং বিএনপির অনেক নেতাই দল সম্পর্কে কোন মন্তব্য করতে চাচ্ছেন না। প্রসঙ্গত: বিএনপি গণতান্ত্রিক রাজনীতি করার কথা বললেও দলের গঠনতন্ত্র অনুসারে চেয়ারপার্সন কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য অন্য কোন নেতার মতামত নেয়ার প্রয়োজন পড়ে না। একক ক্ষমতাবলে যে কোন সময় যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন তিনি। গঠনতান্ত্রিক ক্ষমতা বলে সম্প্রতি বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কোন সিনিয়র নেতার মতামত না নিয়েই জাতীয় নির্বাহী কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ও সহ-দফতর সম্পাদক পদে দু’জনকে নিয়োগ দেন। এ নিয়ে ভেতরে ভেতরে বিএনপিতে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। কিন্তু হাইকমান্ডের রোষানলে পড়ার ভয়ে কেউ ‘টুশব্দ’ করেনি। এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, অনেক দিন ধরে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠক হয় না। তাই দলীয় বিষয়ে চেয়ারপার্সনের আমাদের পরামর্শও নেয়া হয় না। তবে যখন এ ধরনের বৈঠক হবে তখন হয়ত তিনি আমাদের পরামর্শ নেবেন। অবশ্য দলের গঠনতন্ত্র অনুসারে প্রয়োজন মনে করলে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন চেয়ারপার্সন।
×