ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ট্রলার ডুবে জেলের মৃত্যু

প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ী ঢলে কয়েক জেলায় সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ২৮ জুলাই ২০১৫

প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ী ঢলে কয়েক জেলায় সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন

জনকণ্ঠ ডেস্ক ॥ প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ী ঢলে সৃষ্ট বন্যায় বান্দরবানের সঙ্গে চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি ও কক্সবাজারের সড়ক যোগাযোগ এখনও বিচ্ছিন্ন রয়েছে। সোমবার দুপুর থেকে বৃষ্টিপাত কমে আসায় বন্যাপরিস্থিতি উন্নতির দিকে যাচ্ছে। ৪ দিনের টানা বৃষ্টিতে কক্সবাজারের ৫ উপজেলার ৩১ ইউনিয়নের ৩ শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দী হয়েছে ২ লাখ মানুষ। ঝড়ো হাওয়ায় ফিশিং ট্রলার ডুবে জুবাইদ নামে এক জেলে মারা গেছেন। ৫ জেলেকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। এখনও নিখোঁজ রয়েছেন ৯ জেলে। ফেনীর মুহুরী নদীর বাঁধের ফুলগাজী উপজেলার দুই স্থান ও ৫ বাঁধ ভেঙ্গে গেছে। মুহুরী নদীর পানি বিপদসীমার ১০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফেনী সদর ও ছাগলনাইয়ার ১০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। লক্ষ্মীপুরে টানাবর্ষণে জেলা শহরসহ বিভিন্ন জায়গায় জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। দমকা হাওয়া ও বর্ষণে বরিশালের ১০ উপজেলার বিভিন্ন এলাকা খুঁটি উপড়ে এবং তারের ওপর গাছ পড়ায় কয়েক দিন ধরে বিদুতবিহীন রয়েছে। অব্যাহত বর্ষণ ও বর্ষার কারণে দেশের অন্যতম বড় চাঁদপুর সেচ প্রকল্প বাঁধের অধিকাংশ জায়গায় জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। কপোতাক্ষের উপচেপড়া পানিতে কেশবপুরের সাত গ্রাম পানির নিচে তলিয়ে গেছে। মেঘনার ভাঙ্গনে ভোলা-লক্ষ্মীপুর মহাসড়কের ইলিশা ফেরিঘাট এলাকার রাস্তা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। খবর স্টাফ রিপোর্টার ও নিজস্ব সংবাদদাতার। বন্যায় বান্দরবানের সঙ্গে চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি ও কক্সবাজারের সড়ক যোগাযোগ তৃতীয় দিনের মতো বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। সোমবার দুপুর থেকে বৃষ্টিপাত কমে সূর্যের মুখ দেখা যাওয়ায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, টানাবর্ষণের কারণে বান্দরবানের লামা, আলীকদম, নাইক্ষ্যংছড়ি, থানছি উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে তলিয়ে গেছে ঘরবাড়িসহ সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। জেলার সাঙ্গু ও মাতামুহুরী নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার কারণে নিম্নাঞ্চলের শত শত ঘরবাড়ি তলিয়ে গেছে, পানিবন্দী আছে অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ। বান্দরবান সদরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, প্রশাসন আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে পর্যাপ্ত ত্রাণ সরবরাহ করেছে, আরও ত্রাণ দেয়া হবে। জানা গেছে, শনিবার সন্ধ্যা থেকে বান্দরবান-কেরানীহাট সড়কের বাজালিয়ার বড়দুয়ারা নামক স্থানে সড়কে পানি উঠে পড়ার কারণে বন্ধ হয়ে যায় সবধরনের যান চলাচল। এতে বান্দরবানে বেড়াতে আসা শত শত পর্যটক আটকা পড়েন। আরও জানা গেছে, বান্দরবানের পুলপাড়া সড়কের একটি ব্রিজ পানিতে তলিয়ে যাওয়ার কারণে বান্দরবানের সঙ্গে রাঙ্গামাটির সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সড়ক পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে যাত্রীরা পড়ে চরম ভোগান্তিতে। জেলার ৭টি উপজেলার মধ্যে নাইক্ষ্যংছড়ির সড়ক যোগাযোগ চালু হলেও অন্য উপজেলার অভ্যন্তরীণ সড়ক যোগাযোগ ও বিদ্যুত সরবরাহ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। সোমবার দুপুর থেকে সূর্যের মুখ দেখা যাওয়ার কারণে বান্দরবানের স্থবির হয়ে পড়া ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙ্গা হতে শুরু হয়েছে। তবে বন্যার কারণে জেলার সরকারী-বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে উপস্থিতির হার তুলনামূলকভাবে কম। বান্দরবান পৌরসভার মেয়র মোহাম্মদ জাবেদ রেজা বলেন, বন্যার্তদের মাঝে এবারও যথাসম্ভব ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে। ফেনী ॥ মুহুরী নদীর বাঁধের ফুলগাজী উপজেলার বৈরাগপুর ও জগতপুরের ২টি স্থানে ভেঙ্গে গেছে। এর আগে সাহাপুর ও দক্ষিণ দৌলতপুরের দুটি স্থানে প্রথম ভাঙ্গন দেখা দেয়। এ নিয়ে ৫টি স্থানে বাঁধের অংশ ভেঙ্গে গেছে। সোমবার দুপুরে মুহুরী নদীর পানি পরশুরাম পয়েন্টে বিপদসীমার ১০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। উজানের পানি ভাটির দিকে নেমে আসায় ফেনী সদর, ছাগলনাইয়া উপজেলার ১৩টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। উপজেলা প্রশাসন থেক ক্ষতিগ্রস্ত ১১শ’ পরিবারের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেছে বলে ফুলগাজীর ইউএনও জানিয়েছেন। এছাড়া দাগনভুঞা উপজেলার সিলোনিয়া নদীর জোয়ারের পানি বেড়ে যাওয়ার কারণে ৩০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রমজান আলী বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। অপরদিকে ফেনী শহরের জলাবদ্ধতা চরম আকার ধারণ করেছে। প্রধান সড়কে যান চলাচল দুরূহ হয়ে পড়েছে। ভোগান্তি চরমে উঠেছে। কক্সবাজার ॥ কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের ডায়াবেটিক পয়েন্টে ঝড়ো হাওয়ার কবলে পড়ে ফিশিং ট্রলার ডুবে জুবাইদ (৩২) নামের এক জেলের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় শমসু মাঝি, এনায়েত উল্লাহ ও মোঃ হানিফসহ ৫ জেলেকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। এতে আরও ৯ জেলে নিখোঁজ রয়েছেন। সোমবার সকালে ট্রলারডুবির ঘটনাটি ঘটে। উদ্ধার জেলেদের ভর্তি করা হয়েছে জেলা সদর হাসপাতালে। উদ্ধার শমসু মাঝি জানান, তিন দিন আগে তারা ১৫ জন সাগরে মাছ ধরতে যান। সোমবার সকালে উপকূলে ফেরার পথে ট্রলারটি শহরের ডায়বেটিক পয়েন্টে উল্টে গেলে একজনকে মৃত এবং আরও ৫ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। কক্সবাজার ট্যুরিস্ট পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার জহিরুল ইসলাম জানান, ট্রলারডুবির ঘটনায় জুবাইদকে আহতদের সঙ্গে হাসপাতালে নেয়ার পথে মারা যায়। এ ঘটনায় ৯ জন নিখোঁজ রয়েছেন। তাদের উদ্ধারে তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। গত ৪ দিনের টানাবৃষ্টিতে কক্সবাজার জেলার পাঁচটি উপজেলার ৩১টি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্রায় ৩ শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। টানাবর্ষণে ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে গ্রামের পর গ্রাম পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। বরিশাল ॥ মৌসুমী নিম্নচাপের প্রভাবে নগরীসহ জেলার ১০টি উপজেলায় গত কয়েক দিনের মাঝারি ও দু’দিনের ভারিবর্ষণ এবং দমকা হাওয়ায় জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। রবিবার সকালে দমকা হাওয়ায় ১০টি উপজেলার বিভিন্ন এলাকার বৈদ্যুতিক খুঁটি ও তারের ওপর গাছ উপড়ে পড়ায় দু’দিন থেকে বিদ্যুত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে দশ উপজেলা। এরই মধ্যে সোমবার বিকেলে উপজেলা সদরের কয়েকটি স্থানের উপড়ে পড়া গাছ অপসারণ করে বিদ্যুত সংযোগ সচল করা হয়েছে। ভোলা ॥ পানি উন্নয়ন বোর্ড ভাঙ্গন রোধ করতে না পারায় রাক্ষুসে মেঘনার ভাঙ্গনে ভোলা-লক্ষ্মীপুর মহাসড়কের ইলিশা ফেরিঘাট এলাকার রাস্তা সোমবার ভোরে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ফলে বাস-ট্রাকসহ সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনির্দিষ্টকালের জন্য ভোলা-লক্ষ্মীপুর নৌরুটে ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। এতে বাসযাত্রীসহ পণ্যবাহী পরিবহন ও শ্রমিকরা চরম ভোগান্তির মধ্যে পড়েছে। এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় ইলিশা ফেরিঘাট এলাকায় প্রায় ৩শ’ মিটার রাস্তা, মাছঘাট, দোকানপাটসহ জমি বিলীন হয়ে গেছে। চাঁদপুর ॥ অব্যাহত বর্ষণ ও ভরা বর্ষার কারণে দেশের অন্যতম বড় ‘চাঁদপুর সেচ প্রকল্পের (সিআইপি)’ বাঁধের অধিকাংশ এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। দীর্ঘ সময়ের জলাবদ্ধতার কারণে প্রকল্পের ভেতর ৫৭ হাজার হেক্টর ফসলি জমির বহু আমন বীজতলা বিনষ্ট হয়ে গেছে। সোমবার দুপুর পর্যন্ত সেচ প্রকল্পে রোপণ করা আমন ক্ষেত ৩ হতে ৫ ফুট পর্যন্ত পানির নিচে ডুবে আছে। গলাচিপা ॥ ভারিবর্ষণে পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার আমন চাষীদের মাথায় হাত পড়েছে। কৃষক বার বার বীজতলা তৈরি করছে। কিন্তু অতিবর্ষণে তা তলিয়ে যাচ্ছে। পানির নিচে পচে যাচ্ছে বীজ। কৃষক তা রোপণ করতে পারছে না। এতে একদিকে আমন চাষ অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। অন্যদিকে কৃষকদের আর্থিক ক্ষতির শিকার হতে হচ্ছে। এ কারণে এবার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়ে শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। উপজেলা কৃষি দফতর এক সপ্তাহের বর্ষণে দেড় শ’ হেক্টর আমন বীজতলার ক্ষতি হয়েছে বলে স্বীকার করেছে। বাস্তবে ক্ষতির পরিমাণ এর কয়েকগুণ বেশি হবে বলে কৃষকরা ধারণা করছেন। কৃষি দফতরের হিসাব মতে, এবার রাঙ্গাবালী উপজেলায় ৩৫ হাজার ৭৭১ হেক্টর জমিতে রোপা আমন ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। লক্ষ্মীপুর ॥ লক্ষ্মীপুরে টানাবর্ষণে জেলা শহরসহ বিভিন্ন জলবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। এতে সাধারণ নাগরিকের জীবনযাত্রা চরমভাবে ব্যাহত হয়েছে। গত তিন দিনে লক্ষ্মীপুরে সূর্যের মুখ দেখা যায়নি। জলাবদ্ধতার ফলে পৌর শহরের ৬নং ও ৯নং ওয়ার্ডের দশ সহস্রাধিক বাসিন্দার ভোগান্তি চরমে পেঁৗঁছেছে। অপরদিকে টানাবর্ষণে গ্রীষ্মকালীন শাকসবজি ও আমন বীজতলার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর জেলায় প্রায় তিন হাজার ৬শ’ হেক্টর জমিতে গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালীন সবজির আবাদ করা হয়েছে। এর মধ্যে অতিকাংশ সবজি ক্ষেত ইতোমধ্যে পানির নিচে নিমজ্জিত হয়েছে। কেশবপুর ॥ অতিবর্ষণ ও কপোতাক্ষ নদের উপচেপড়া পানিতে কেশবপুরের প্রায় সাতটি গ্রাম তলিয়ে গেছে। কপোতাক্ষ নদে অসংখ্য পাটা দিয়ে বাঁধ দেয়ার কারণে পানি সরতে পারছে না। ফলে বদ্ধ পানিতে ঘরবাড়ি, মাঠঘাট ও রাস্তা পানিতে থৈ থৈ করছে। গত শুক্রবার থেকে কপোতাক্ষ পারের শত শত পরিবার অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়েছে। চুয়াডাঙ্গা ॥ চুয়াডাঙ্গার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে মাথাভাঙ্গা নদী। এই নদী রক্ষা বাঁধের বিভিন্ন অংশে দেখা দিয়েছে ফাটল। ফলে দৌলতদিয়া, তালতলা, ইসলালপাড়াসহ বিভিন্ন স্থান ধসে যাচ্ছে। দ্রুত এসব জায়গা সংস্কার করা না হলে বাড়িঘর, রাস্তা, ড্রেন নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ২০১১ সালে নদী রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা হয়। ওই সময় নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে বাঁধটি নির্মাণের অভিযোগ ওঠে। চলতি বর্ষা মৌসুমে টানাবর্ষণে মাথাভাঙ্গা নদীর পানি বৃদ্ধির সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। হুমকির মুখে পড়েছে কিছু স্থাপনা।
×