ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কক্সবাজার পাসপোর্ট অফিস ॥ দুর্নীতির আখড়া

প্রকাশিত: ০৬:৪৯, ২৭ জুলাই ২০১৫

কক্সবাজার পাসপোর্ট অফিস ॥ দুর্নীতির আখড়া

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ কক্সবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে সীমাহীন দুর্নীতি, অনিয়ম আর জালিয়াতির অভিযোগে সহকারী পরিচালক (এডি) শরীফুল ইসলামকে অবশেষে ঢাকা জেলায় বদলি করা হয়েছে। রবিবার তিনি কক্সবাজারস্থ কর্মস্থল ত্যাগ করেছেন। এডি বদলি হলেও জাল-জালিয়াতিতে জড়িত উপ-সহকারী পরিচালক শওকত কামাল ও উচ্চমান সহকারী আবু হানিফ মোস্তফা কামাল এখনও বহাল তবিয়তে রয়েছে। এতে রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট তৈরি কাজে মেতে উঠেছে চিহ্নিত দালাল চক্র। দালালরা ওই দু’কর্মকর্তার কাছে গিয়ে শুধু আট্যু বললেই চলে। অন্য পাসপোর্টের কাজ-কাম বাদ দিয়েই আট্যু পাসপোর্টের কাজ আগে সেরে নেয় তারা। পাসপোর্ট অফিসে আট্যু শব্দ বের করেছে রোহিঙ্গারা। যাতে এদেশীয় নাগরিকরা সহজে বুঝতে এবং আগের কাজ বাদ দেয়ার প্রতিবাদ করতে না পারে। ‘আট্যু’ মিয়ানমারের ভাষা। আট্যু শব্দের অর্থ হচ্ছে দুই নম্বরী কাজ-কাম। অর্থাৎ নকল বা ভেজাল। ওই আট্যু শব্দতেই প্রতিটি পাসপোর্টের বিপরীতে দুই কর্মকর্তা হাতিয়ে নিচ্ছেন ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকা। দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তাদের বিভিন্ন অনিয়মের কারণে কক্সবাজার পাসপোর্ট অফিসটি দুর্নীতির সুতিকাগারে পরিণত হয়েছে। ডিএডি শওকত কামাল স্থানীয়দের প্রতিটি পাসপোর্ট ফরম জমা নিতে দেড় হাজার টাকা হারে ঘুষ দাবি করায় বুধবার আবেদনকারী ও পাসপোর্ট অফিস কর্মচারীদের মধ্যে লঙ্কাকা-ের ঘটনাও ঘটেছে। ওইদিন দেড় হাজার টাকা হারে ঘুষ নিয়ে বিকেল সাড়ে ৩টা হতে ৫টা পর্যন্ত ৩৫ আবেদনকারীর ফরম জমা নেয়া হয়। তবে কাউকে পাসপোর্ট ডেলিভারি সিøপ দেয়া হয়নি। এমন কি ছবি কিংবা ফিঙ্গার প্রিন্টও নেয়া হয়নি। এ কারণে আবেদনকারীদের সঙ্গে কর্মকর্তাদের হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। সূত্র জানায়, কক্সবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে অর্ধ লাখ টাকা দিলেই রোহিঙ্গারা পেয়ে যায় পাসপোর্ট। বৈধ পাসপোর্ট আবেদন ফরম জমা নিয়ে প্রকাশ্যে অর্ধ লাখ টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট সহজে করিয়ে দিচ্ছে চিহ্নিত দালাল চক্র। ইতোমধ্যে শত শত রোহিঙ্গার হাতে চলে গেছে এমআরপি পাসপোর্ট। ঘোর অভিযোগ উঠেছে ফোর স্টার সিন্ডিকেট করে রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট তৈরি করে দিতে কর্মচারীরা দিন দিন নয়া কৌশল ও প্রতারণার নতুন ফাঁদ সৃষ্টি করেছে। কর্মচারীদের এসব প্রতারণা উদঘাটন করেছে স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি) কক্সবাজার শাখা। ইতোমধ্যে ৪২টির বেশি রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট আবেদন বাতিল করা হয়েছে। এসব পাসপোর্ট ফরম প্রতি ৬০-৭০ হাজার টাকায় চুক্তিভিক্তিক জমা নিয়েছিলেন পাসপোর্ট অফিসের দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তারা। পাসপোর্ট অফিসে অনিয়ম আর দুর্নীতি করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকে গাড়ি, বাড়ি, শপিংমলসহ বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক বনে গেছেন বলে জানা গেছে। রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট দেয়ার কৌশল ॥ হাতের লেখা জেলার বিভিন্ন এলাকার ভিন্ন ভিন্ন জনের পুরাতন পাসপোর্টের কপি কিংবা সংরক্ষিত তথ্য সংশ্লিষ্ট কার্যালয় থেকে সংগ্রহ করেন পাসপোর্ট অফিসের কতিপয় কর্মচারী। এরপর হাতের লেখা পাসপোর্টের ছায়া কপি চলে যায় ওইসব ব্যক্তিদের হাতে। দালাল চক্র রোহিঙ্গা নারী ও পুরুষ মোয়াক্কেল সংগ্রহ করে থাকে। চুক্তিভিত্তিক হাতের লেখা পাসপোর্ট থেকে এমআরপি পাসপোর্ট তৈরির জন্য পূরণ করা হয় পাসপোর্ট আবেদন ফরম। এখানে অবলম্বন করা হয় ভিন্ন ভিন্ন কৌশল। আবেদন ফরমে রোহিঙ্গাদের ছবি সংযুক্ত করে অন্যান্য তথ্যগুলো ঠিক রাখা হয়ে থাকে। এখানে সংযুক্ত করা হয় ভুয়া জন্ম নিবন্ধন সনদ, চেয়ারম্যান সার্টিফিকেট ও থানায় দায়ের করা হয় পাসপোর্ট হারানোর ভুয়া ডায়েরি। এসব কাগজপত্র জালিয়াতির জন্য একটি চিহ্নিত সিন্ডিকেট রয়েছে। পুলিশ তদন্ত করতে মাঠে গিয়ে পিলে চমকানো চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। থানা, ফাঁড়ি কিংবা এসবি পুলিশ সদস্যরা মাঠ পর্যায়ে ওইসব আবেদনকারীর পাসপোর্ট ফরম তদন্ত করেন। অনেকের ঠিকানা বা বাড়ি-ঘরের অস্তিত্বও খুঁজে পায়নি স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি)। মাসিক আয় অর্ধ কোটি টাকা ॥ পাসপোর্ট অফিসে উল্লেখিত জালিয়াতি ছাড়াও দিনদিন নিত্য নতুন কৌশল অবলম্বন করেন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, কর্মচারী ও দালাল চক্র। অনেক সময় পুলিশ তদন্ত রিপোর্টও পক্ষে আনার তদ্বির করে দালাল চক্রের সদস্যরা। দালালদের একটি সূত্র জানায়, পাসপোর্ট অফিসে মাসে অর্ধ কোটি টাকারও বেশি অবৈধ লেনদেন হয়ে থাকে। উপ-সহকারী পরিচালক শওকত কামাল প্রাইভেটকার গাড়ি ব্যবহার ছাড়াও শহরে ভাড়া থাকেন ২৫ হাজার টাকায় বিলাসবহুল বাড়িতে। একইভাবে উচ্চমান সহকারী মোস্তফা কামালও কাটাচ্ছেন আয়েশি জীবন। তারও রয়েছে টয়োটা গাড়ি। অভিযোগ উঠেছে ওই দুই কর্তকর্তার রয়েছে ঢাকা ও চট্টগ্রামে বাড়ি, বিভিন্ন মার্কেটে শপিংমল ও নামে বেনামে সহায় সম্পত্তি। কক্সবাজার স্পেশাল ব্রাঞ্চের একটি সূত্র জানিয়েছে, জেলা পাসপোর্ট অফিস থেকে তদন্তের জন্য পাঠানো ফরমগুলোর তথ্য মাঠ পর্যায়ে তদন্ত করে পিবিআর তথ্যে রোহিঙ্গা প্রমাণ পাওয়ায় নেগেটিভ রিপোর্ট দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক আলী হোসেন বলেন, পাসপোর্ট করতে গিয়ে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি মেনে নেয়া যায় না। যারাই অপরাধের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। কক্সবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের উপ-সহকারী পরিচালক শওকত কামাল ও উচ্চমান সহকারী আবু হানিফ মোস্তফা কামাল তাদের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ সত্য নয় দাবি করেছেন।
×