ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

প্রতিদিন ২ কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে প্রতিষ্ঠান ;###;ফ্লাইটের নিরাপত্তাও হুমকির মুখে

একদিন পরই সাকার চূড়ান্ত রায়, সবাই অধীর অপেক্ষায়

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ২৭ জুলাই ২০১৫

একদিন পরই সাকার চূড়ান্ত রায়, সবাই অধীর অপেক্ষায়

বিকাশ দত্ত ॥ এই প্রথম বিএনপির কোন শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের আপীল বিভাগের চূড়ান্ত রায় হতে যাচ্ছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর বিরুদ্ধে ২৯ জুলাই আপীল বিভাগের চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করা হবে। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে আপীল বিভাগের চার সদস্যবিশিষ্ট বেঞ্চ এই ঐতিহাসিক মামলার রায় ঘোষণা করবেন। বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। রায়ে কি হবে তা নিয়ে চলছে নানা জল্পনা কল্পনা। সবার নজর এখন আপীল বিভাগের দিকে। এ্যাটর্নি জেনারেল ও প্রসিকিউশন আশা করছেন ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদ- বহাল থাকবে আপীল বিভাগেও। উল্লেখ্য, এর আগে আপীল বিভাগের চূড়ান্ত রায়ে কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদ-ের স্থলে মৃত্যুদ- ও দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদ-ের স্থলে আমৃত্যু কারাদ- প্রদান করা হয়েছে। অন্যদিকে কামারুজ্জামান ও মুজাহিদের ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদ- বহাল রেখেছেন আপীল বিভাগ। কাদের মোল্লা ও কামারুজ্জামানের মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়েছে। এদিকে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের মধ্যে একমাত্র সাকা চৌধুরীই বিচারিক কার্যক্রমের সময়ে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেছেন। ট্রাইব্যুনালে সাকা চৌধুরী বলেছিলেন, ‘দুই বছর জেলে রাখছিস, জেল থেকে বের হয়ে নিই...। ট্রাইব্যুনালের রায়ের কপি আইন মন্ত্রণালয় থেকে দেয়া হয়েছে। রায়ের পর বিএনপি কি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে সেটাও দেখার বিষয়। যদিও এখন পর্যন্ত তার পক্ষে কোন বড় ধরনের কর্মসূচী দেয়নি বিএনপি। জামায়াতের কোন নেতার ফাঁসি বা রায় ঘোষণার দিন অবশ্য কর্মসূচী দিয়েছে। সাকার ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে প্রসিকিউশন যুক্তিতর্কে বলেছে, সাকা ‘এ দেশের ৭১-এর রাসপুতিন’। যিনি নিজেকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন, কিন্তু পাচ্ছেন না। অথচ আয়নার সামনে দাঁড়ালেই তিনি নিজেকে দেখতে ও চিনতে পারবেন। ট্রাইব্যুনালে সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে ২৩ অভিযোগের মধ্যে নয়টি প্রমাণিত। এর মধ্যে চারটি চার্জ ৩, ৫, ৬ ও ৮ নম্বর অভিযোগে হত্যা, গণহত্যার দায়ে সাকা চৌধুরীকে মৃত্যুদ- দেয়া হয়েছে। ১৭ ও ১৮ নম্বর অভিযোগে অপহরণ ও নির্যাতনের দায়ে পাঁচ বছর করে ১০ বছর কারাদ-। ২, ৪ ও ৭ নম্বর অভিযোগে হত্যা, গণহত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও দেশান্তরে বাধ্য করার মতো অপরাধের জড়িত থাকা এবং এর পরিকল্পনা করার দায়ে ২০ বছর করে ৬০ বছর কারাদ- দেয়া হয়েছে। আর নয়টি অভিযোগের ওপর প্রসিকিউশন কোন সাক্ষ্য গ্রহণ করতে পারেনি। তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সাকার ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের কারণে সাক্ষী আনা সম্ভব হয়নি। ওই সময়ে বিচারপতি ও প্রসিকিউটরদের বাড়িতে হামলা হয়েছে। সাক্ষী ও প্রসিকিউটরদের মৃত্যুপরোয়ানার মধ্যে থাকতে হয়েছে। ফলে নয়টি অভিযোগে সাক্ষী না দিলেও ট্রাইব্যুনালে ৯ অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। যার মধ্যে ৪টিতে মৃত্যুদ- প্রদান করা হয়েছে। ২০১০ সালের ১৬ ডিসেম্বর গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারিক কার্যক্রম শেষে যে দিন রায় ঘোষণার জন্য সিএভি ঘোষণা করা হয় সে দিন পর্যন্ত সাকা চৌধুরী নানা ধরনের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেছেন। ১ অক্টোবর ২০১৩ সালে যে দিন রায় ঘোষণা করা হয় সে দিন সাকা চৌধুরী ট্রাইব্যুনালের উদ্দেশে বলেন, ‘এটা মিনিস্ট্রি থেকে বেরিয়েছে। ইন্টারনেটে আছে তো। আইন মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ দিলাম।’ রায় পড়ার সময় সাকা সারাক্ষণই হাসছিলেন। তিনি বিভিন্ন মন্তব্য করছিলেন। ৩ নম্বর অভিযোগ পড়ার সময় তিনি বলেন, ‘৩০ লাখ তো মারা গেছে। বলে দিলেই হয়, আমি ২০ লাখ মেরেছি। রায় তো গতকালই ওয়েবসাইটে পাওয়া গেছে। তখন আইন মন্ত্রণালয় বলেছিল বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। বিষয়টি ট্রাইব্যুনালের তদন্ত করে দেখা উচিত। ২০১৩ সালের ১৪ আগস্ট বিচারিক কার্যক্রম শেষে রায় ঘোষণার জন্য সিএভি করা হয়। সে দিন ধৈর্য নিয়ে বিচারকাজ সম্পন্ন করায় ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের ধন্যবাদ জানালেন একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত বিএনপির নেতা সাকা চৌধুরী। তিনি বিচারকদের উদ্দেশে বলেন, ‘ধৈর্য নিয়ে আপনারা বিচারকাজ সম্পন্ন করেছেন এবং আমাকে দয়া করার জন্য আপনাদের ধন্যবাদ। তিনি বলেন, ‘রায় যা দেয়ার তা তো দেবেনই। তারপরও আপনাদের ধন্যবাদ যে, আপনারা আমার নিজেকেসহ সবার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন করেছেন।’ এ সময় বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘আমরা ধৈর্য ধরেছি ঠিক, কিন্তু আপনাকে দয়া করিনি। আইন আপনাকে যেটুকু অধিকার দিয়েছে, তা-ই করেছি।’ এরপর সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা পরা সাকা চৌধুরী আসামির কাঠগড়া থেকে নামতে নামতে প্রসিকিউটরদের সঙ্গে হাত মেলান এবং বলেন, ‘রায় যা হবার হবে, তাই বলে কি আপনাদের সঙ্গে হাত মেলাতে পারি না।’ ২০১৩ সালের ২ জানুযারি মধ্যাহ্ন বিরতির কিছুক্ষণ আগে ট্রাইব্যুনালে সাকা চৌধুরীর কয়েকটি আবেদনের শুনানি শুরু হয়। তখন থেকে দফায় দফায় উত্তেজনাকর পরিস্থিতি হয়। এ সময় সাকা চৌধুরী এ্যাটর্নি জেনারেলের উদ্দেশে বলেন, ‘দুই বছর জেলে রাখছিস, জেল থেকে বের হয়ে নিই...।’ আসামির কাঠগড়ায় থাকা সাকা চৌধুরী কথা বলার অনুমতি চাইলে ট্রাইব্যুনাল তাঁর আইনজীবীকে বলেন, ‘আমরা তাঁকে কথা বলতে দেব না।’ তারপরও সাকা চৌধুরী বলেন, ‘এটা খুব নির্দোষ আবেদন। আপনাদের সার্টিফিকেট দেয়ার কোন দরকার নেই। এই আবেদন এ জন্য করা হয়েছে যে নাসিম সাহেবের কোর্টে যে প্রেজুডিস হয়েছে, তাঁর দায় যেন আপনাদের ঘাড়ে না বর্তায়। কিন্তু আপনি আইনজীবীর ওপর রাগ করছেন।’ এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আসামি কি এভাবে কথা বলতে পারেন?’ এ সময় সাকা চৌধুরী বলেন, ‘ফাঁসি তো দিয়ে রেখেছেন, বেলজিয়াম থেকে ফাঁসি লিখে রেখেছে।’ এরপর আরও দুটি আবেদনের শুনানি হয়। এর মধ্যে একটি আইনমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগে ব্যবস্থা নেয়ার আবেদন, অপরটি বিচারপতি নিজামুল হককে ট্রাইব্যুনালে এসে ব্যাখ্যা দেয়ার বিষয়ে আবেদন। (তৎকালীন) আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগের আবেদনের বিষয়ে এ্যাটর্নি জেনারেল শুনানি শুরু করেন। এ সময় সাকা চৌধুরী মন্তব্য করলে মাহবুবে আলম বলেন, ‘চুপ থাকেন তো।’ তখন সাকা চৌধুরী চিৎকার করে এ্যাটর্নি জেনারেলের উদ্দেশে বলেন, ‘চোপ, চোপ...।’ ২০১৩ সালের ২০ জুন সাকা চৌধুরী সাফাই সাক্ষ্য দেয়ার সময় তিনি তার অভিযোগের সঙ্গে সম্পর্কহীন ও অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য এবং ট্রাইব্যুনাল ও প্রসিকিউশনের উত্তেজিত ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ উত্তপ্ত করে তোলে ট্রাইব্যুনালের পরিবেশ। এ নিয়ে সাকা ও তার আইনজীবীদের সঙ্গে প্রসিকিউটরদের বাগ্বিত-ায় সাময়িকভাবে বন্ধও হয়ে যায় সাক্ষ্যগ্রহণ কার্যক্রম। সাকা চৌধুরী তার সাক্ষ্য প্রদানকালে এমন কিছু অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করেছেন যা প্রকাশের অনুপযোগী। এছাড়া তিনি প্রসিকিউশনকে ধমক দিয়ে বলেন, দেড় বছরে আমার বিরুদ্ধে ৪১ সাক্ষী আনা হয়েছে। আর আমাকে একা সহ্য করতে পারছেন না। সাক্ষ্য শেষেও সাকা চৌধুরী প্রসিকিউশনকে কটূক্তি করতে ছাড়েননি। সাকা চৌধুরীর আপীল নিষ্পত্তি হবে আপীল বিভাগের পঞ্চম রায়। এর আগে আরও চারটি মামলার আপীল নিষ্পত্তি হয়েছে। ৭ আপীল বিভাগের আদেশের পর প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেছেন, আশা করি ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদ- বহাল থাকবে আপীল বিভাগেও। আশা করব যে চার অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল ফাঁসি দিয়েছিল সেটা বহাল থাকবে। তার মৃত্যুদ- হবে। সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক শ.ম রেজাউল করিম জনকণ্ঠকে বলেছেন, এই মামলায় আপীল শুনানিতে উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক ও আইনগত বক্তব্য শোনার সুযোগ আমার হয়েছে। একটি সংবাদপত্রের সংবাদকে কেন্দ্র করে ভিন্নরূপ যুক্তি এসেছিল সাকা চৌধুরীর পক্ষ থেকে। বিষয়টি খ-নের জন্য এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম মূল সংবাদপত্রটিও আদালতে উপস্থাপন করেন। যা প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা আসামি পক্ষের আইনজীবীকেও দেখতে বলেছিলেন। সামগ্রিক অবস্থায় আমার কাছে প্রতীয়মান হয়েছে, কোন প্রকার আবেগ নির্ভর না হয়ে ও সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতেই মৃত্যুদ-াদেশ বহাল থাকার সম্ভাবনাই উজ্জ্বল। এ রূপ ফলাফল হলে তা বিচার প্রার্থী এবং সাধারণ মানুষের প্রত্যাশারও প্রতিফলন ঘটাবে। এদিকে এ্যার্টনি জেনারেল ৮ জুলাই সাকা চৌধুরী দেশের থাকার প্রমাণি হিসেবে দৈনিক পাকিস্তানের একটি কপি আদালতে জমা দিয়েছি। মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশে থাকার সপক্ষে প্রমাণ হিসেবে দৈনিক পাকিস্তানের ২৯ সেপ্টেম্বর ’৭১ সংখ্যার মূল কপি সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগে জমা দিয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ। সাকা চৌধুরীর আপীল মামলাটির চূড়ান্ত রায় দেয়া হবে ২৯ জুলাই। আপীল শুনানি শেষ হওয়ায় ৮ জুলাই এ দিন ধার্য করেছেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপীল বেঞ্চ। ওইদিন বাংলা একাডেমির গ্রন্থাগার থেকে সংগৃহীত পত্রিকাটির মূল কপি জমা দেন এ্যাটর্নি জেনারেল। সংবাদটিতে বলা হয়েছে, ‘ফজলুল কাদের চৌধুরীর এক ছেলে আহত হয়েছিলেন’। মাহবুবে আলম আদালতে বলেন, এতে সাকা চৌধুরীর কথা বলা হয়েছে। যেহেতু তিনি আহত হয়েছিলেন, সেহেতু তিনি একাত্তরে দেশে ছিলেন। অতএব, সাকা চৌধুরী দেশে ছিলেন না বলে করা আসামিপক্ষের দাবি মিথ্যা।
×