ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সাজানো হয়েছে ছিনতাই নাটক

প্রেমিকের সঙ্গে ঘর বাঁধার ছক কষেই স্ত্রী খুন করায় স্বামীকে

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ২৬ জুলাই ২০১৫

প্রেমিকের সঙ্গে ঘর বাঁধার ছক কষেই স্ত্রী খুন করায় স্বামীকে

শর্মী চক্রবর্তী ॥ ছিনতাই নয় পরকীয়ার জের ধরেই স্ত্রীর পরিকল্পনায় নির্মমভাবে খুন করা হয়েছে ওবায়দুল হাসানকে। সাবেক প্রেমিকের সঙ্গে নতুন করে সংসার করার ইচ্ছা থেকেই সোনিয়া এই পরিকল্পনা করে। মোবাইল ফোনে পরিচয়ের মাধ্যমে ৪ বছর আগে রুবেলের সঙ্গে প্রেম হয়েছিল সোনিয়ার। সে প্রেমের গভীরতা মনের ভেতরে রেখেই পরিবারের চাপে আট মাস আগে সোনিয়ার সঙ্গে বিয়ে হয় চট্টগ্রামের বাসিন্দা কোয়ালিটি আইসক্রিমের সাব জিরো ব্র্যান্ডের ব্যবস্থাপক ওবায়দুল হকের (৩৬)। গভীর ভালবাসায় সাজিয়ে তোলা নতুন সংসার! সুন্দরী স্ত্রীর জন্য ভালবাসার এতটুকুও কমতি ছিল না ওবায়দুল হাসানের। কিন্তু সোনিয়া তার মন থেকে রুবেলকে মুছে ফেলতে পারেনি। তাই বিয়ের পরও সাবেক প্রেমিকের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেন। এমনকি সাবেক প্রেমিকের সঙ্গে ঘর বাঁধতে ওবায়দুলকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করেন তিনি। ওবায়দুল হাসানকে খুন করার আগে রাতে সোনিয়ার সঙ্গে রুবেল মোবাইল ফোনে ৭ বার কথা বলেন। রাত সাড়ে ৯টা থেকে ১১টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত দু’জনের এসব টেলিকথোপকথনের রেকর্ড এখন গোয়েন্দাদের হাতে। এমনকি ক্ষুদ্রাস্ত্র কিনতে প্রেমিক রুবেলের হাতে সোনিয়া তুলে দেন ৬০ হাজার টাকা। ২৬ জুন ঢাকার কলাবাগান পান্থপথে কথিত ছিনতাইকারীদের হামলায় খুন হন তিনি। ওবায়দুল হাসান চট্টগ্রামের সাংসদ ও বর্তমান প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসির ভাগ্নে পুলিশী তদন্তে এ খুনের রহস্য বেরিয়ে এসেছে। সর্বশেষ গত বুধবার গভীর রাতে চট্রগ্রাম থেকে গ্রেফতার করা হয় ওবায়েদ হাসানের স্ত্রী সোনিয়াকে (২৮)। গ্রেফতারের পর বৃহস্পতিবার সোনিয়াকে ঢাকায় নিয়ে শুক্রবার ঢাকায় মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করে পুলিশ। শুনানি শেষে তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে মহানগর হাকিম। মোবাইল ফোনে পরিচয়ের মাধ্যমে সোনিয়ার প্রেম হয়েছিল রুবেলের সঙ্গে। চার বছরের প্রেমের সম্পর্ক ছিল তাদের। ততদিনে এলএলবি পাস করা সোনিয়াকে বিয়ে দিতে তার পরিবার উঠেপড়ে লাগে। এরই মধ্যে ঘটকের বদৌলতে বর হিসেবে খোঁজ আসে ওবায়দুল হাসানের। ওবায়দুল বন্দর নগরীর প্রতাপশালী রাজনীতিবিদ ও সানোয়ার গ্রুপের কর্ণধার নুরুল ইসলাম বিএসসির ভাগ্নে হওয়ায় ওই প্রস্তাব সানন্দে গ্রহণ করে সোনিয়ার পরিবার। এতে সোনিয়ার দ্বিমত থাকলেও পছন্দের পাত্র রুবেলের পড়াশোনা শেষ হয়নি। তাই পরিবারের চাপ ও রুবেলের বেকারত্বের দায়ে শেষ পর্যন্ত গত বছরের ১৪ নবেম্বর নুরুল ইসলাম বিএসসির ভাগ্নেকে বিয়ে করেন সোনিয়া। তবে পুরনো প্রেমিককে তিনি তখনও ভুলতে পারেননি। বিয়ের পরও তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। বিয়ের ৮ মাস না পেরুতেই পুরনো প্রেমিকের সঙ্গে ঘর বঁাঁধার স্বপ্নে তাকে দিয়ে খুন করা হয় স্বামীকে। সোনিয়াকে গ্রেফতারের পর প্রথমদিন ও দ্বিতীয় দিনের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) মনিরুল ইসলাম বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে সোনিয়া তার সাবেক প্রেমিক সাইফুল্লাহ ওরফে রুবেলের সঙ্গে পরকীয়ার বিষয়ে স্বীকার করলেও স্বামীকে হত্যার বিষয়টি স্বীকার করছেন না। স্বামী হত্যার জন্য তিনি শোকগ্রস্ত বলেও দাবি করছেন। সোনিয়া আরও বলছেন, নতুন বছরে ২০১৬ সালের শুরুতে তার এলএলএম কোর্স সমাপ্ত হওয়ার কথা। একই সময়ে প্রেমিক রুবেলও টেলিকমিউনিকেশন থেকে বের হবে। তাই নতুন বছরে স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে হলেও রুবেলের সঙ্গে চার বছরের প্রেমের পরিণতি দেয়ার স্বপ্ন ছিল সোনিয়ার। ইচ্ছা ছিল রুবেলের সঙ্গে বিয়ের পিঁড়িতে বসবেন। জিজ্ঞাসাবাদে ডিবির তদন্তকারী কর্মকর্তা জানতে পারেন, রুবেলের বাড়ি চাঁদপুর ফরিদগঞ্জের আদসা গ্রামে। সে রাজধানীর ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করে। পড়াশোনা অবস্থাতেই সোনিয়ার মোবাইল ফোনে রুবেলের নম্বর থেকে কল আসে। এরপর সোনিয়ার বিয়ে হলেও গোপনে তারা প্রেমের সম্পর্ক চালিয়ে যান। বিয়ের পর স্বামী ওবায়দুল হাসান তার মামা নুরুল ইসলাম বিএসসির ভূতেরগলির ৫৭ নম্বর বাসার দোতলায় স্ত্রী সোনিয়াকে নিয়ে বসবাস করেন। ওবায়দুল নুরুল ইসলাম বিএসসির মালিকানাধীন সানোয়ারা গ্রুপের কোয়ালিটি আইসক্রিমের বসুন্ধরা সিটির ‘সাব-জিরো’ নামক প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার ছিলেন। ব্যবসায়িক কাজে ওবায়দুল দিন-রাতের অধিকাংশ সময় বাসার বাইরে থাকার সুযোগে রুবেলকে সঙ্গ দেন সোনিয়া। এ ছাড়াও রুবেলের পরামর্শে এ বছরের জানুয়ারিতে সোনিয়া ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটিতে এলএলএমএ ভর্তি হন। ১৬ ফেব্রুয়ারি তার ক্লাস শুরু হয়। ভর্তির পর নিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষার অজুহাতে ক্যাম্পাসে যাওয়ার নামে দুজনের মেলামেশা হতো। নতুন বছরে দুজনের পড়ালেখা শেষ হলে দূরত্ব তৈরির আশঙ্কায় ওই সময়ে বিয়ের পরিকল্পনা করেন তারা। চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, পান্থপথের বসুন্ধরা সিটি শপিংমলের অফিস থেকে প্রায় প্রতিদিনই রাত ১০টার মধ্যে বাসায় ফিরতেন ওবায়দুল হাসান। সে হিসেবে রাত ৯টার কিছু আগে ওই শপিংমলের সামনে অবস্থান নেয় ঘাতকরা। পরে রুবেল ওই শপিংমলের সামনে তার ভাগ্নে মিঠুকে রেখে মোটরসাইকেলে করে পাপ্পু ও তানভীরকে নিয়ে কলাবাগানে ৫৭, সার্কুলার রোডে (ভূতেরগলি) ওবায়দুল হাসানের বাসার অদূরে অপেক্ষা করতে থাকে। রাত ১২টার দিকে রিক্সাযোগে ফেরার পথে ওঁৎ পেতে থাকা ঘাতকদের গুলিতে খুন হন ওবায়দুল হাসান। হত্যাকা-ের দিন ওবায়দুলকে অনুসরণের দায়িত্বে থাকা মিঠু বসুন্ধরা সিটি শপিংমলের সামনে থেকে মোবাইল ফোনে তার দূর সম্পর্কে মামা রুবেলের সঙ্গে কয়েক দফা কথা বলে। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর একপর্যায়ে মিঠু তার মামাকে বলে, ‘মামা আজ বাদ দাও, ভাল লাগছে না।’ উত্তরে রুবেল তাকে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরামর্শ দেয়। এভাবে কয়েক দফা কথা বলার একপর্যায়ে রুবেল ফোন দেয় সোনিয়াকে। কিন্তু সোনিয়া অনড় থাকায় ওই রাতেই যে কোন মূল্যে ওবায়দুলকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয় রুবেল। ঘটনার রাতে রুবেল, সোনিয়া, পাপ্পু, মিঠু ও তানভীরের মধ্যে মোবাইল ফোনে যেসব কথা হয় তার রেকর্ড বিশ্লেষণ করছে গোয়েন্দা পুলিশ। সংশ্লিষ্ট মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানির কাছ থেকে এসব রেকর্ড সংগ্রহ করেছেন গোয়েন্দারা। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের উপ-পরিদর্শক দীপক কুমার দাস বলেন, নিছক ছিনতাইয়ের ঘটনা নয়, ওবায়দুলকে পরিকল্পিতভাবেই হত্যা করা হয়েছে। আর এ খুনের নেপথ্যে রয়েছেন তারই স্ত্রী সোনিয়া। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনাটি প্রমাণ করার মতো যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ এখন পুলিশের হাতে রয়েছে। তিনি বলেন, সোনিয়া বর্তমানে ৩ মাসের গর্ভবতী। অসুস্থ শরীর ও আইনের ধারা-উপধারার অজুহাত দেখিয়ে তিনি নানা বিষয় এড়িয়ে যাচ্ছেন। তবে রুবেলের সঙ্গে প্রেমের কথা স্বীকার করেছেন। ঘটনার দিনও তাদের মধ্যে সরাসরি কথা হয়। এরপর রুবেলের সঙ্গে তার যোগাযোগ নেই। তিনি বলেন, সাবেক প্রেমিক হিসেবে রুবেলের কথা তার স্বামীকে নিজেই বলেন। এ নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কখনও দাম্পত্য কলহ দেখা দেয়নি। সোনিয়া অন্তঃসত্ত্বা থাকায় সাবধানতার সঙ্গে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। শীঘ্রই চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকা-ে জড়িত রুবেল ও তার অপর ভাগ্নে পাপ্পুকে গ্রেফতার করা সম্ভব হবে বলে জানান তিনি। এর আগে গ্রেফতার মাহমুদুল হাসান মিঠু ও তানভীর আহমেদ হত্যাকা-ে সরাসরি অংশগ্রহণের কথা স্বীকার করে ঢাকা মহানগর আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দিয়েছেন। আদালতের জবানবন্দীতে তারা পুরো হত্যাকা-ের পেছনে সোনিয়ার পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করেন। এ দুজনের তথ্য ধরে গত বুধবার রাতে চট্টগ্রাম থেকে তাসমিন খদিজা সোনিয়াকেও (২৬) ডিবি পুলিশ গ্রেফতার করে। গত ২৬ জুন রাতে নিজ কর্মস্থল বসুন্ধরা সিটি থেকে রিক্সায় বাসায় ফেরার পথে সার্কুলার রোডে খুন হন ওবায়দুল। তিন যুবক ওবায়দুলের কাছে থাকা ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়ে মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে তাকে গুলি করে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়, ‘ছিনতাইকারীদের হাতে নুরুল ইসলাম বিএসসির ভাগ্নে খুন।’ ইতোমধ্যে হত্যার পরিকল্পনা থেকে শুরু করে আদ্যোপান্ত জানিয়ে মিঠু ও তানভীর আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। তারা দুজন সম্পর্কে রুবেলের ভাগ্নে। জবানবন্দীর তথ্য অনুযায়ী ঘটনার রাতে ওবায়দুল হত্যা মিশনে মিঠু, রুবেল, তানভীর ও তার আরেক ভাগ্নে পাপ্পু উপস্থিত ছিল। তানভীর ও পাপ্পু পলাতক। হত্যাকা-ে অংশ নেয়া দুজনের জবানবন্দীতে সোনিয়ার নাম আসায় তাকে গ্রেফতার করা হয়।
×