ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আজ শ্রাবণের আমন্ত্রণে

শ্রাবণ বর্ষণ সঙ্গীতে রিমিঝিম রিমিঝিম রিমিঝিম...

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ২৫ জুলাই ২০১৫

শ্রাবণ বর্ষণ সঙ্গীতে রিমিঝিম রিমিঝিম রিমিঝিম...

সমুদ্র হক শ্রাবণের আকাশে মেঘের কতই না খেলা। এই রোদ এই বৃষ্টি। এই মেঘের ভেলায় রৌদ্রোজ্জ্বল দিন, এই মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। শ্রাবণের এই দিনে বৃষ্টিতে ভিজে শিশুদের কী আনন্দ। যদি চোখে পড়ে হংসকুল তবেই হয়েছে। হাঁসগুলোকে তাড়িয়ে ধরে আকাশে উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা। ছেলেবেলায় এমন আনন্দ করেনি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া কি যাবে? আর শ্রাবণ দিনে মেঘকে সঙ্গী করে কেউ কি কোন সুরই তোলেনি! দিনে রাতে গ্রীষ্ম বর্ষায় মুখ তুললেই যার দেখা মেলে তা সুদূর আকাশের মেঘ। শ্রাবণ দিনে মেঘপানে তাকালে কত কথাই না মনে পড়ে... যেমন- ‘শ্রাবণ ঘন এই আকাশ কালো তৃষিত হৃদয়ে মোর জ্বেলেছে আলো...। কত কবিতা, কত গান, কত না বলা কথার কল্পনা, কত রোমান্টিকতা...। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুরই দিয়েছেন ‘মন মোর মেঘের সঙ্গী উড়ে চলে দিগদিগন্তের পানে নিঃসীম শুন্যে শ্রাবণ বর্ষণ সঙ্গীতে রিমিঝিম রিমিঝিম রিমিঝিম...।’ মেঘ নিয়ে কি কম কথা আছে। সবই মনে পড়ে এই শ্রাবণ দিনে। মেঘ নিয়ে ভাবনায় মেঘে মেঘে বেলা যেন গড়িয়ে না যায়। প্রবাদের এই কথাটি মেনে চললে ‘আকাশে আজ রঙের খেলা সাদা মেঘের ভেলা’র মতোই জীবন গড়ে নেয়া যায়। মেঘকে নিয়ে প্রবাদ-প্রচনের কি শেষ আছে- কিছু পাওয়ার কথা ভাবতেই দ্রুত তার চেয়ে বেশি চলে এলে কথা হয় ‘মেঘ না চাইতেই জল।’ আবার ‘ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ভয় পায়’ প্রবাদের এই মেঘেরও দেখা মেলে শ্রাবণের কোন গোধূলী শেষে। শ্রাবণ দিনের মেঘকে নিয়ে কতই না গান হয়েছে...। ‘ মেঘের কোলে রোদ হেসেছে বাদল গেছে টুটি আজ আমাদের ছুটি রে ভাই আজ আমাদের ছুটি...’ শিশুবেলায় এই গান কতই না মধুর শোনাত। ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা....’ এমন গান ভেসে এলে হৃদয়ের গভীরে ধ্রুপদী সুর জেগে ওঠে। রাগ রাগিনীতে মনের কোণে কখন যে গেয়ে ওঠে ‘শ্রাবণ ঘন এই আকাশ কালো তৃষিত হৃদয়ে মোর জ্বেলেছে আলো...। ‘আকাশ এত মেঘলা যেও নাকো একলা...’ মেঘকে নিয়ে এমন রোমান্টিকতার সুর কি সহসা মেলে! বর্ষা মৌসুমের শ্রাবণের দিন কতই না বিচিত্র। শ্রাবণ জুড়েই মেঘের খেলা। এরপর শরতের ¯িœগ্ধ রূপ। এই শরত ধন্য হয় শ্রাবণের কিছুটা রূপ লাবণ্য নিয়েই। হিসাব মেলাতে কখনও ভুলও হয়ে যায় কোন্টি শ্রাবণ আর কোন্টি শরৎ। ঋতু বৈচিত্র্যেও আছে লুকোচুরির মধুময়তা। শ্রাবণ ও শরতের মধ্যিখানে যে মেঘগুলো আকাশে ভেসে বেড়ায় তারও অনেক নাম। কোন্ সাহিত্যিক ও সৃষ্টিশীল মানুষ যে এই নামগুলো দিয়েছেন! প্রতিটি নামই অপার ভাবনার দুয়ার খুলে দেয়। সবচেয়ে মজার বিষয় বিজ্ঞানীরাও এইসব মেঘের মধ্যে ঢুকে মেঘগুলোতে তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করেছে। প্রকৃতির আকাশেও রক্ষা নেই। সেখানেও ভাগাভাগি। সবচয়ে উঁচুতে যে মেঘ দেখা যায় তারা অলক মেঘ। এরা বনেদী মেঘ। সব সময় অমল ধবল। অলকের নিচের স্তরে ধূসর রঙে মলিন আঁচল উড়িয়ে বেড়ায় যে মেঘ তারা স্তর মেঘ। এরই নিচে স্তরে স্তরে সাজানো থাকে এক ধরনের মেঘ এদের বলা হয়স্তূপ মেঘ। এই মেঘও অনেকটা ধূসর রঙের তবে কখনও ফুলে ফেঁপে ওঠে নানা আকার ধারণ করে। কখনও রোদের কিরণ মেখে এতটাই মনোহর হয়ে ওঠে মনে হবে অলক অথবা স্তর মেঘ। এরা দুই মেঘের মধ্যে মিশেও যেতে পারে। কেউ এদের বলে বর্ণচোরা মেঘ। আকাশে এমন মেঘ দেখে অনেক সময় সাধারণ মানুষ এমনকি আবহাওয়াবিদগণও ভুল হিসাব করে বসেন। শ্রাবণ মাসেই এই বর্ণচোরা মেঘ আকাশে উঁকি দিয়ে কি-ই-না লুকোচুরি খেলে। মেঘ আমাদের কাছে অনেক নামে পরিচিত- জলধর, জলদ, সেচক, অলক, অভ্র, বলাহক, সেক্তা, কাদম্বিনী, ধুমুল ইত্যাদি। মেঘযুক্ত করেও অনেক নাম আছে- বৃষ্টিকে বলা হয় মেঘপুষ্প, ময়ূরের আরেক নাম মেঘনাদানুলাসী, বর্ষার নাম মেঘাগম, শরতের নাম মেঘাত্যয়, আকাশে বিদ্যুতের ঝলকানি বা বিজলীর নাম মেঘবহ্নি, রোদকে বলা হয় মেঘভাঙ্গা... এভাবে মেঘমেদুর, মেঘতিমির, মেঘযামিনী, মেঘসখা...কত নাম মেঘের। শ্রাবণের আগমনেই মেঘেরা সব নেচে ওঠে। আসলে মেঘ কি? এ নিয়ে বিজ্ঞানীরা অনেক বিশ্লেষণ করেছেন। সহজ কথায়, ভূপৃষ্ঠের পানির বাষ্পীভবনের প্রক্রিয়ায় উর্ধলোকে ঘনীভবনে মেঘে রূপান্তর। তারপর অধঃক্ষেপণে বাদলধারা, বর্ষায় ঝরঝর মুখর। এই বাষ্পীভবনেরও একটা হিসাব আছে। নিত্যবছর পৃথিবী থেকে সূর্যতাপে যত পানি বাষ্পীভূত হয় এক সঙ্গে রাখলে তার আয়তন হবে এক লাখ ২৪ হাজার ঘনমাইল। এর মধ্যে সমুদ্র থেকেই যায় এক লাখ নয় হাজার ঘনমাইল। ভূপৃষ্ঠের নানা উৎস থেকে যায় ১৫ হাজার ঘনমাইল। ফিরতি পালায় স্থলের ওপর পড়ে ২৬ হাজার ঘনমাইল ও সমুদ্রে ৯৮ হাজার ঘনমাইল। এই পানি শুকিয়ে দেয় সূর্যালোক। সৌরশক্তির তিন ভাগের এক ভাগ ব্যয় হয় পানি শুকানোর কাজে। শ্রাবণের রোমান্টিক মেঘের বিষয়টি বহু আগেই বিজ্ঞানী অবধি গড়িয়েছে। এই মেঘকে নিয়ে কবি সাহিত্যিক শিল্পীদের কত লিখা কত কবিতা কত গান কত ছবি কত চিত্রকর্ম কতই না আয়োজন। মেঘের কোন দেশ নেই, মেঘের কোন ঠিকানা নেই, মেঘ সকল দেশের সকল কালের মানুষের। মেঘদূতকে বিরহীর বার্তাবাহক করে পাঠিয়েছিলেন কবি কালিদাস। আর এ যুগে বিজ্ঞানী ও কবি সাহিত্যিকদের সম্মিলনের বিশ্লেষণে সেই মেঘ হয়ে উঠেছে রোমান্টিকতার বার্তাবাহক। কখনও পরদেশী মেঘ যাও ফিরে কখনও মেঘমেদুর বরষায় কোথা তুমি। মেঘকে যে ভালবাসেতই হয়...।
×