ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

‘বাঘেদের সিংহ বধ’ বিশ্বজুড়ে প্রশংসা কুড়াচ্ছে

প্রকাশিত: ০৬:১৮, ১৭ জুলাই ২০১৫

‘বাঘেদের সিংহ বধ’ বিশ্বজুড়ে প্রশংসা কুড়াচ্ছে

স্পোর্টস রিপোর্টার ॥ ‘ছুটি শেষ। এবার ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে কাজে। শীঘ্রই দেখা হচ্ছে বাংলাদেশ। চ্যালেঞ্জের অপেক্ষায় রইলাম’-কথাটি বলেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার এ মুহূর্তের সেরা পেসার ডেল স্টেইন। ২১ জুলাই শুরু হতে যাওয়া দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজ খেলতে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে বাংলাদেশে আসার আগে বিমানে বসে টুইটে এমনটি জানিয়েছেন স্টেইন। সঙ্গে সঙ্গে টি২০, ওয়ানডে সিরিজে না খেলা স্টেইনকে খোঁচা দিয়ে পাল্টা বার্তার হিড়িক পড়ে যায়। সব পাল্টা বার্তাতেই তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে, ২০১৯ সালের বিশ্বকাপে খেলার ইচ্ছা থাকায় নির্র্ধারিত ওভারের সিরিজ খেলতে চাননি স্টেইন। বাংলাদেশে নির্ধারিত ওভারের ম্যাচগুলোকে ‘অগুরুত্বপূর্ণ’ দৃষ্টিতে দেখেছেন। সঙ্গে ‘শক্তি অপচয়’ না করার কথাও জানিয়েছেন। তাতে ফল কী হয়েছে? দক্ষিণ আফ্রিকাকে সিরিজেই হারিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। মাশরাফিবাহিনী যে এখন আর ‘দুর্বল’ দল নেই ‘বড় দল’ হয়ে উঠেছে, তা ভালভাবেই বুঝতে পেরেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। শুধু কী দক্ষিণ আফ্রিকা, পুরো বিশ্বই এখন তা বুঝতে পেরে বাংলাদেশের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হচ্ছে। ‘বাঘেদের সিংহ বধ’ বিশ্ব ক্রিকেটে খুব বড় করেই দেখা হচ্ছে। তাতে স্টেইনের মতো বাংলাদেশে খেলতে আসতে রাজি না হওয়া ক্রিকেটারদের খোঁচা মারার সুযোগও মিলে গেছে। ওয়ানডেতে বাংলাদেশের কাছে জিম্বাবুইয়ে, পাকিস্তান, ভারতের মতো অসহায় আত্মসমর্পণ করল দক্ষিণ আফ্রিকাও। দেশের মাটিতে টানা চার সিরিজ জিতে নিল বাংলাদেশ। জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে সিরিজ জয় দিয়ে শুরু হয়েছিল। ৫-০ ব্যবধানে জিম্বাবুইয়েকে হোয়াইটওয়াশ করে বাংলাদেশ। এরপর পাকিস্তানকে ‘বাংলাওয়াশ’ করেছে। ভারতকেও ২-১ ব্যবধানে সিরিজে হারিয়েছে। এবার দক্ষিণ আফ্রিকাকেও উড়িয়ে দিল। টানা চার সিরিজ জেতার সঙ্গে ৬০ তম দ্বিপক্ষীয় সিরিজ খেলে ১৯তম সিরিজ জিতেছে বাংলাদেশ। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে প্রথমবারের মতো কোন সিরিজে জিতল বাংলাদেশ। সবচেয়ে বেশি ৮ বার জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে সিরিজ জিতেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ তিনবার টানা চারটি সিরিজ জিতেছে। প্রথমবার ২০০৬-০৭ সালে, দ্বিতীয়বার ২০০৯ সালে এবং তৃতীয়বার ২০১৪-১৫ সালে। শক্তিশালী দলগুলোর মধ্যে নিউজিল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দুইবার করে জিতেছে বাংলাদেশ। কেনিয়ার বিপক্ষেও দুইবার সিরিজে জয় মিলেছে। স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে একবার, আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে একবার, পাকিস্তানের বিপক্ষে একবার ও ভারতের বিপক্ষে একবার সিরিজে জিতে বাংলাদেশ। এবার দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষেও প্রথমবার সিরিজ জিতে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা এ নিয়ে ভীষণ উচ্ছ্বসিত। বলেছেন, এই জয় বিশেষ কিছু। এভাবে ঘুরে দাঁড়ানোই হচ্ছে ভাল দলের লক্ষণ। সব মিলিয়ে আমি খুব খুশি, প্রথম ম্যাচ হেরে যাওয়ার পরও আমরা ঘুরে দাঁড়িয়েছি। দুই-তিন নম্বর ম্যাচটাও জিতলাম। সব কৃতিত্ব ছেলেদের ও ম্যানেজমেন্টকে দেয়া উচিত। প্রত্যেকটা সিরিজই গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেকটা সিরিজের জয়ের আনন্দ এক রকম। তুলনামূলক একটু কম শক্তির দলের সঙ্গে খেলে জয় পাওয়ার আনন্দটা একটু ভিন্ন রকম। বিশ্বকাপ থেকে শুরু করে পাকিস্তান, পাকিস্তান থেকে ভারত হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে আমরা জয় ধরে রাখতে পেরেছি। একটু স্ট্রাগল করতে হয়েছে শুরুতে। আমি বলব ব্রিলিয়ান্ট কামব্যাক। এই কামব্যাক ছিল আমাদের জন্য অত্যাবশ্যকীয়, এটা আমাদের দৃঢ়তার পরিচয়ও বলব। মাশরাফির কণ্ঠে সব সময় উদ্দীপ্ত করা কথাবার্তাই বের হয়। তার হাত ধরেই যে বাংলাদেশের এ আকাশে উড়ার মতো সাফল্য পাওয়া শুরু হয়েছে। জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে সিরিজে গতবছর নবেম্বরে যে মাশরাফিকে নেতৃত্ব দেয়া হলো, এর পর থেকেই দলের চেহারাই পাল্টে গেল। বিশ্বকাপে গিয়ে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের মাটিতেও বাংলাদেশের ঝলক বজায় থাকল। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালেও উঠল বাংলাদেশ। ভারতের বিপক্ষে ম্যাচটিতে যদি আম্পায়ারদের ভুল সিদ্ধান্তের মধ্যে না পড়তেন মাশরাফিরা, তাহলে সেমিফাইনালেও উঠে যেতে পারত। কিন্তু তা হলো না। দেশে ফিরে বিরোচিত সম্মানই পেল ক্রিকেটাররা। এর পর পাকিস্তান এসে ৩-০ ব্যবধানে হারল। সেই থেকেই বাংলাদেশ যে বড় দল হয়ে উঠেছে, তা ধরা পড়ল। ভারত যে বিশ্বকাপে হারতে পারত, তা বোঝা গেল সিরিজে। ভারতকে ২-১ ব্যবধানে সিরিজে হারিয়ে দিল। সঙ্গে এটাও বোঝা গেল, বাংলাদেশকে যে দলই হালকাভাবে নেবে, তারাই হারবে। নাকাল হবে। দক্ষিণ আফ্রিকা টি২০ সিরিজে টানা ২টি ম্যাচ জিতে গেল। প্রোটিয়ারা হয়ত মনে করেছে, ওয়ানডেতেও অনায়াসেই জিতবে। তাই তো ডি ভিলিয়ার্সকে বোর্ড বিশ্রামেই রাখল। প্রথম ওয়ানডেতে আরামে ৮ উইকেটে জিতেও গেল দক্ষিণ আফ্রিকা। কিন্তু পরের দুটি ওয়ানডেতে ৭ ও ৯ উইকেটে হেরে সিরিজ হার হলো। এবার ঈদের পর টেস্ট সিরিজে নামার পালা। তবে এখনই এ নিয়ে কেউই ভাবতে রাজি নন। সবাই বাংলাদেশের ওয়ানডে সিরিজ জয়কে ঈদ উপহার হিসেবেই নিচ্ছে। সঙ্গে বাংলাদেশের প্রশংসাও করা হচ্ছে। টম মুডি, অস্ট্রেলিয়া জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক ক্রিকেটার। মাঠের ক্যারিয়ার শেষ করে এখন ব্যস্ত থাকেন কোচিং কিংবা ধারাভাষ্যকক্ষে। এবার চলমান বাংলাদেশ-দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে কখনই তার নাম উচ্চারিত হবার কথা নয়। কিন্তু, তারপরও হলো। আর তার কারণ হলো, বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন তিনি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারে তিনি বাংলাদেশের ২-১ ব্যবধানে সিরিজ নিশ্চিত হওয়ার পর লিখেছেন, একেই বলে প্রকৃত উত্তম-মধ্যম। বাংলাদেশের বাঘেরা আবারও মুগ্ধ করল, আরেকটা সিরিজ জিতে নিলো। আর এবারেরটা দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। সেই মিছিলে শামিল হলেন বাংলাদেশের সাবেক বোলিং কোচ ইয়ান পন্ট। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারে তিনি স্পষ্ট বাংলায় লিখেছেন, ‘অভিনন্দন বাংলাদেশ!’ ভারতকে সিরিজে হারানোর পর ভারতের সংবাদ মাধ্যমে বাংলাদেশের ক্রিকেট বেশ ভালভাবেই স্থান পাচ্ছে। বাংলাদেশ ক্রিকেটের সংবাদও গুরুত্বের সঙ্গে উপস্থাপন করে ভারতের সংবাদমাধ্যমগুলো। এবার যেমন প্রভাবশালী প্রায় সব পত্রিকাতেই ছিল বাংলাদেশ দলের ভূয়সী প্রশংসা। কলকাতার প্রভাবশালী পত্রিকা আনন্দবাজার দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে বাংলাদেশ দলের সিরিজ জয় নিয়ে ‘আফ্রিকান সিংহও বিধ্বস্ত, বিশ্ব ক্রিকেটে ব্যাঘ্র গর্জন’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। যেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ দলের জয় এখন আর আবেগের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। সেটা এখন পেশীর লড়াইয়ে, মেধার লড়াইয়ে পৌঁছে গেছে। প্রভাবশালী দুটি ইংরেজী সংবাদ মাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়া এবং এনডিটিভি যথাক্রমে ‘দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজ নিবন্ধিত করল বাংলাদেশ’ এবং ‘প্রোটিয়াদের বিপক্ষে বাংলাদেশের নয় উইকেটের জয়, ঘরের মাঠে টানা চারটি ওয়ানডে সিরিজ জয়’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রশংসায় ভাসছে বাংলাদেশ।
×