ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অজয় দাশগুপ্ত

সিডনির মেলব্যাগ ॥ উন্মাদনা ও অতি আবেগের বিপরীতে সুস্থতা ফেরাতে হবে

প্রকাশিত: ০৩:৫০, ১৭ জুলাই ২০১৫

সিডনির মেলব্যাগ ॥ উন্মাদনা ও অতি আবেগের বিপরীতে সুস্থতা ফেরাতে হবে

বড় ঘটনাবহুল দেশ আমাদের। বিদেশেও তার প্রভাব আর আগুনের আঁচ এসে লাগে। কত কি যে ঘটে যায়। সকালবেলা দেখি সৈয়দ আশরাফের বিদায় সংবাদ। আমরা যারা দেশে থাকি না তাদের সত্যতা পরিমাপের দুটো অস্ত্র- একটি মিডিয়া, আরেকটি ব্যক্তিগত যোগাযোগ। মিডিয়াকে এখন কিভাবে বিশ্বাস করব? এক মিডিয়ায় যেটা আনন্দের সংবাদ আরেক মিডিয়ায় সেটা কারবালা প্রান্তর। কেউ বলবেন দেশ এখন খুব খারাপ আছে। মানুষ পারলে সব ভেঙ্গে ফেলে। আর কারও মতে এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি। আর ব্যক্তিগত যোগাযোগ? সে তো ও মাই গড টাইপের। ঘটনার চেয়ে বিশ্লেষণ আর মতামত দেয়ার জন্য মুখিয়ে আছেন সবাই। সবাই সব জানে। প্রধানমন্ত্রী, খালেদা জিয়া বা এরশাদ কেউই যেন এদের সুপরামর্শ ছাড়া অচল। শুনলে মনে হয় পাগল হয়ে যাই। আর যারা সত্যি জানেন তারা মুখ খোলেন না। ফলে আমরা আসল খবর জানতে পারি না। খবর আরও আছে। আমাদের সবার প্রিয় আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীও এখন সংবাদ শিরোনাম। বিপাকে আছেন। অথচ তিনি যা যা বলেছেন বলে হৈচৈ করা হচ্ছে সে কথাগুলো আমরা শুনেছি প্রায় পনের বছর আগে। তিনি দু’দফায় সিডনি এসেছিলেন। প্রথম দফায় তাঁর সঙ্গে কথা বলা ও আলাপের সুযোগ পেলেও দ্বিতীয় দফায় তাঁকে মঞ্চে দেখেই চলে আসতে হয়েছিল। উপবিষ্ট গাফ্ফার চৌধুরী ইশারা করলেও থাকতে পারা যায়নি। যারা এনেছিলেন তাদের কেউ কেউ চাননি আমাদের সঙ্গে তাঁর দেখা হোক। এটা আওয়ামী লীগারদের পুরনো স্বভাব। তারা জামায়াত-বিএনপির বেলায় যতটা কঠোর বা নির্মম তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি কঠিন আমাদের বেলায়। তাদের ধারণা আমাদের মতো কারও কারও সঙ্গে এদের দেখা করতে দেয়াই বিজয়ের ব্যাপার। গাফ্ফার ভাই অবশ্য ব্যতিক্রম। সে যাত্রায় তিনি বিলেত ফেরত যাওয়ার পর এক রাতে অনেক সময় নিয়ে কথা হয়েছিল। নিজেই বলেছিলেন কিভাবে তাঁকে আলাদা করে রাখা হয়েছিল। যে কথা বলছিলাম, প্রথমবারে তিনি এই কথাগুলো খোলামেলাভাবেই বলেছিলেন। যেখানে ধর্ম বা শাস্ত্রের ব্যাপারে আসলে কোন দ্বিমত ছিল না। তিনি বদলে যাওয়া বাঙালীর সাম্প্রদায়িকতা আর অন্ধত্ব নিয়ে বলছিলেন। সে সময় সামাজিক মিডিয়ার নামে হুলস্থুল না থাকায় তাঁর কথা নিয়ে জল ঘোলা করার সুযোগ ছিল না। এবার দেখছি বাঙালী কিভাবে মিডিয়া বিশেষত আন-এডিটেড মিডিয়ার নামে পাগল হয়ে ওঠে। বর্ষীয়ান মানুষটির অতীত ইতিহাস বা ভূমিকা মনে না রেখে এভাবে আক্রমণের কি আসলেই কোন কারণ আছে? এ সমস্ত স্পর্শকাতর বিষয়ে কথা বলাও বিপজ্জনক। সে পথে না গিয়ে আমি বরং বলব সামাজিক মিডিয়ার ব্যাপারে কঠোর হওয়ার বিকল্প নেই। যারা আমাকে প্রশ্ন করেন ওয়েবে বা খোলা মিডিয়ায় না লিখে কাগজে কেন লিখি তাদের বলি চোখ মেলে দেখুন মাথার ওপর তোয়াব খান, রাহাত খানদের মতো সম্পাদকরা থাকলে সবাই কতটা নিরাপদ। তখন জহুর হোসেন চৌধুরী, মানিক মিয়া, সন্তোষ গুপ্ত বা বজলুর রহমানরা ছিলেন বলে আমরা ভদ্র ছিলাম। তাঁরা আমাদের সৌজন্য আর শিষ্টাচারও শেখাতেন। চাইলেই মানুষ যা ইচ্ছা তা বলতে পারে না বা লিখতে পারে না। এই বিষয়টাও আমরা এখন ভুলতে বসেছি। এমন কঠিন সময়ে আমরা দেখছি উন্মাদনা আর অপপ্রচার। কেবল আওয়ামী লীগ বলে নয়, বিএনপির বেলায়ও তা সত্য। কোন দল, কোন নেতা কোন কিছুই নিরাপদ না। মানুষের আদিম প্রবৃত্তি বা স্বভাবজাত উন্মাদনা যেন আমাদের পিছু ছাড়তে চাইছে না। এ প্রবণতা কিভাবে বন্ধ হবে বলা মুশকিল। তবে এতে আমাদের লোকসান ছাড়া লাভ কিছু দেখছি না। মন্ত্রী বদল, কারও ভাষণ, কারও বক্তৃতা বা লেখা সবকিছু নিয়ে এমন মাতামাতি আগে দেখা যেত না। এই যে ঈদ উৎসব আসন্ন তা নিয়েও আমাদের উত্তেজনা চোখে পড়ার মতো। মানুষ যদি রাত জেগে সেহ্রি খায় বা তার জন্য চালু আধুনিক ফাস্ট ফুডের দোকানগুলো বেছে নেয় তাতেও কি কথা বলতে হবে? দেখছি সেগুলো নিয়েও আলোচনার অন্ত নেই। সব দেখে এ কথা বলা প্রাসঙ্গিক আমাদের মন ও মনন এখনও অনেক কিছুর জন্য তৈরি হতে পারেনি। সে জায়গাটা তৈরি করার কাজ করবে কে? যে মিডিয়া সামান্য ক্রিকেট খেলা নিয়ে সাম্প্রদায়িকতা ছড়ায়, যার কার্টুনে খবরে উস্কানি তার কাছে জাতি কতটা নিরাপদ? এটা তো মগের মুলুক না। কথা বলার স্বাধীনতা আর যা-তা বলা বা লেখার দিকটা এক ধরনের কিছু নয়। এরাই আবার বলে দেশে নাকি মত প্রকাশের সুযোগ নেই। নাই যদি থাকত আপনারা মাতম করছেন কিভাবে? এনজিও প্রধান আদালতকে অবহেলার সাহস রাখে। নোবেলজয়ী সরকারের তোয়াক্কা করে না। সরকারের মানুষ সরকারকে কাঁচকলা দেখায়। যুদ্ধাপরাধী ভি-চিহ্ন দেখিয়ে বলে আমরা জিতেছি। তারপরও মানবাধিকার আর স্বাধীনতার নামে একশ্রেণীর মানুষ ভোকাল। এদের মতলব আমরা জানি। এরা আগেও এমন করেছে। আওয়ামী লীগের দুর্বলতাকে পুঁজি করে এরা আমাদের প্রায় বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিল। মানুষ অনেক ত্যাগ আর কষ্টের ভেতর দিয়ে সে অবস্থা থেকে বের হয়েছে। আরও একবার সে পথে ঠেলে দেয়াটা কি রোখা যাবে না? বাঙালী আয়-উন্নতি আর সাম্যে আগুয়ান। এভাবে পিছে তার নামে উস্কানিদাতাদের ঠেকাতে না পারলে সরকার তো বটেই, জাতিও নিরাপদ নয়। সেটাই এখন প্রকাশ্য। সরকারের যে মেকানিজম এখনও তা বুঝছে না বা বুঝে উঠতে পারছে না, তাদের কি চোখ খুলবে? এই যে সচিব ও মুক্তিযোদ্ধা বিতর্ক, আত্মহননের ঘটনা- এটা কি অবাঞ্ছিত, না অপ্রত্যাশিত? সচিব মুক্তিযোদ্ধাকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়ার অপমানে মুক্তিযোদ্ধাটি আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন। তাঁকে নিয়ে মায়াকান্না আর সচিব বিরোধিতার নামে ধূম্রজাল তৈরিতে ব্যস্ত মিডিয়া প্রাণ গ্রুপের আমজাদ খানের মৃত্যু সংবাদ দিলেও একাত্তরে আর্মিতে থাকাকালীন তাঁর ভূমিকা নিয়ে কিছু লেখেনি। এরাই মুক্তিযোদ্ধার জন্য মায়াকান্না কাঁদে! সবাই মিলে গলাধাক্কা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাকে প্রায় ঠেলে বের করে দিতে উদ্যত জাতির এই দুঃখ বা মেকি কান্না সত্যি ভয়ঙ্কর। আন্তর্গত রাজাকারে ভরা সমাজে সচিব কি একলা কেউ? সাহস থাকলে নিজের আচার-আচরণ, ব্যবহার আর দেশাত্মবোধে হাত দিন। না হলে এসব আস্ফালন বা সেন্টিমেন্টের মূল্য আসলেই জিরো। এখন তাই বাস্তবোচিত কর্মকা- আর এ্যাকশানের বিকল্প নাই। [email protected]
×