ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পটুয়াখালীতে গ্যারেজ ইটভাঁটি, রিক্সাচালক, মাছ ধরা কাজে জড়িত

ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় শিশু

প্রকাশিত: ০৭:২৯, ১৬ জুলাই ২০১৫

ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় শিশু

মোখলেছুর রহমান, পটুয়াখালী ॥ ‘সংসারে অভাব, সবাই এক সঙ্গে খাইতে পারতাম না। মায় আব্বায় ঝগড়া করে। হের পর লেহা (লেখা) পরা বন্ধ কইরা হুন্ডার গ্যারেজে কাম (কাজ) শুরু করছি। এই হানে যেকালে (যে সময়) কাম শুরু করছি হে সময় আমি ক্লাস থ্রিতে পরতাম। এই ৪ বছর এই হানে (এখানে) কাম করি, এহন মোটামুটি কাম পারি। এহনও ল্যাহা পরা করতে মোন চায়। আমি ল্যাহা পরা করতে না পারলেও ভাল লাগে যে এহন আমরা চাইর ভাই বুইনে এক লগে বইয়া প্যাড ভইরা ভাত খাইতে পারি।’ এ কথাগুলো বলেন ১৩ বছরের মোটরসাইকেল গ্যারেজ শ্রমিক শিশু রুবেল। সংসারে অভাবের কারণে ৯ বছর বয়স থেকে রুবেল শহরের পাওয়ার হাউস রোড এলাকায় মোটর গ্যারেজে চাকরি নেয়। রুবেল জানান, পটুয়াখালী সদর উপজেলার খলিশাখালী গ্রামে তাদের বাড়ি। বাবার নাম শহিদ হোসেন। পেশায় একজন শ্রমিক। সংসারে ছয়জন সদস্য। রুবেল বড়। বাবা শহিদের আয়ে সংসারের ব্যয় মেটানো দায়। এ কারণে অনেক সময় পরিবারের সদস্যদের আধপেটা কিংবা অভুক্ত দিন কাটাতে হতো। সংসারের অভাব মেটাতে বাবা শহিদ ৯ বছরের শিশু সন্তানকে স্কুলের পরির্বতে কাজে পাঠায়। শুরুতে রুবেলকে প্রতিদিন ৩০ টাকা বেতন দেয়া হতো। হাতুরি, ঝালাই আর ভারি যন্ত্রপাতির কাজ করতে গিয়ে বহুবার আহত হয়েছে শিশু রুবেল। এভাবেই দারিদ্রতার কারণে প্রতিনিয়ত শিশুরা শিক্ষা বিমুখ হয়ে শ্রমে জড়িয়ে যাচ্ছে। জানা গেছে, পটুয়াখালী জেলায় প্রায় ৪শ’র অধিক মোটরসাইকেল ওয়ার্কশপ ও গ্যারেজ রয়েছে। ওইসব প্রতিষ্ঠানে দুইজন করে শিশু শ্রমিক কাজ করে। এর ফলে পটুয়াখালীতে শুধু মোটরসাইকেল গ্যারেজে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা আছে প্রায় ৮শ’। এছাড়াও ইটভাঁটি, বিড়ি শ্রমিক, রিক্সার ড্রাইভিং, ওয়েলডিং কারখানা, হিউমান হলারের ড্রাইভিং ইমারত শ্রমিকের মতো নানা ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় শহুরে জীবনে শিশু শ্রমিকরা জড়িয়ে আছে। শ্রমের বাজারে শিশুরা শুধু শহরেই সীমাবদ্ধ নেই। আয়ের ধান্ধায় উত্তাল নদীতেও মাছ ধরে পরিবারে অর্থের যোগান দেয় তারা। নদী তীরবর্তী জেলে পরিবারে অধিকাংশ শিশুরা ঝুঁকি নিয়ে নদীতে মাছ শিকার করে। দুর্ঘটনার শিকার হয়ে অনেক শিশু মারাও যায়। তবুও থেমে নেই তাদের ঝুঁকিপূর্ণ এ জীবিকা। জেলায় এসব ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় কতো শিশু কাজ করছেন এর সঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই সরকারের কোন বিভাগের কাছে। ঝুঁকিপূর্ণ এসব পেশায় নিয়োজিত শিশুরা বলছেন, ‘পরিবারের অভাব অনটন আর পেটের দায়ে বাধ্য হয়ে এসব ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত হচ্ছে তারা।’ কুয়াকাটা এলাকার সাগর পাড়ের জেলে সোবহান ফকির বলেন, ‘আমাগো তো উপায় নাই। মাছ তো সব সময় পাওনা যায় না। এ লই¹া পরিবারের খরচ মিডাইতে গুরাগারা সন্তান লইয়া মাছ ধরি। আমি সাগরে যাই আর ওরা চরে রেণু পোনা ধরে।’ জানা গেছে, এসব প্রান্তিক আয়ের পরিবারগুলোর শিশুদের ভবিষ্যৎ মানে অন্ধকার। স্কুল, বই-খাতা কিংবা বিনোদনের জন্য খেলার মাঠে দৌড়ঝাঁপ এসব শ্রমজীবী শিশুদের জীবনে অনুপস্থিত প্রায়। অধিকার নিয়ে বেড়ে ওঠা তাদের জন্য বিলাসিতা। তাই জীবনের তাগিদে জীবিকার সন্ধানে ঝুঁকছে ঝুঁকিপূর্ণ পেশায়। তবে শহরের ইকবাল অটোসের মালিক ইকবাল হোসেন বলেন, ‘আমরাও এভাবে শিশু বয়স থেকে কাজ করতে করতে এখন ওয়ার্কশপের মালিক হইছি। তবে দিনে এসব শিশুরা কাজ করলেও রাতে যেন অন্তত প্রাথমিক শিক্ষাটা নিতে পারে সে বিষয়ে সরকারের একটু ভেবে দেখা উচিত।’ শিশুশ্রম প্রতিরোধ করার বিষয়ে পটুয়াখালী জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদফতরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহিদা বেগম জানান, শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম থেকে ফিরিয়ে আনতে দরিদ্র পরিবারগুলোকে পুর্নবাসন করতে ইউনিসেফের অর্থায়নে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে মাতৃ-পিতৃহীন ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম নামে একটি পাইলট প্রকল্প চালু হয়েছে। এ পাইলট প্রকল্পটির মাধ্যমে গলচিপা উপজেলার চিকনিকান্দি এলাকায় অতি দরিদ্র ১২৪ পরিবারের মধ্যে ৩টি শর্তে মাসিক ২ হাজার টাকা করে প্রদান করা হচ্ছে। তাদেরকে মোট ২৪ মাস এ অনুদান প্রদান করা হবে। শর্তগুলো হচ্ছে ৬Ñ১৪ বছরের শিশুকে অবশ্যই বিদ্যালয়ে পাঠাতে হবে। শিশুকে অর্থনৈতিক বা শ্রমে নিয়োজিত করা যাবে না এবং শিশুকে বিবাহ দেয়া বা করানো থেকে বিরত থাকতে হবে। তবে এ কর্মকর্তা মনে করছেন, প্রকল্পটি পুরো জেলায় শুরু করলে শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম থেকে ফেরানো সম্ভব হবে। এর ফলে সঠিকভাবে শিশুদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশ ঘটবে।
×