ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কলেজ কর্তৃপক্ষের সাফ কথা : তুমি ফিট না

প্রতিবন্ধী বলে ভর্তির সুযোগ পেল না শিক্ষার্থী

প্রকাশিত: ০৬:১৬, ১৬ জুলাই ২০১৫

প্রতিবন্ধী বলে ভর্তির সুযোগ পেল না শিক্ষার্থী

স্টাফ রিপোর্টার ॥ এবার শিক্ষা বোর্ডের মনোনয়ন পাওয়ার পরও প্রতিবন্ধী বলে এক শিক্ষার্থীকে ভর্তির অযোগ্য জানিয়ে বের করে দিল রাজধানীর একটি নামী কলেজ। ওই শিক্ষার্থী তার অভিভাবককে নিয়ে উত্তরার ওই কলেজে গেলে কলেজ কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দিয়েছে, ‘তুমি প্রতিবন্ধী, শারীরিকভাবে ফিট নও, এখানে ভর্তি হওয়া যাবে না।’ কলেজের নিগ্রহের শিকার মেধাবী এ শিক্ষার্থী আশিকুর রহমান ও তার অভিভাবককে সহযোগিতা করেনি ঢাকা শিক্ষা বোর্ডও। বোর্ডের কর্তাব্যক্তিদের অসহযোগিতায় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে আশিকুরের শিক্ষাজীবন। হাতে সামান্য সমস্যা থাকায় আশিকুরকে ‘প্রতিবন্ধী’ অভিহিত করে বঞ্চিত করেছে কলেজ ও বোর্ডের কর্তাব্যক্তিরা। কলেজে নিগ্রহের পর বুধবার দুপুরে শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টদের অমানবিক আচরণের ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয়েছে। এদিকে কেবল আশিকুরই নয়; মন্ত্রণালয়, বুয়েট ও ঢাকা বোর্ডের ভুলে ভরা তালিকার পর কলেজে কলেজে হয়রানির শিকার হচ্ছে হাজার হাজার কলেজে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী। কোথাও তালিকায় নামে ভুল, কোথাও ছেলের স্থলে মেয়ে, কোথাও মেয়ের স্থলে ছেলে আবার কোথাও শিক্ষার্থীকে না জানিয়ে ‘ভর্তি’ হয়েছে বলে বোর্ডে নাম পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। আবার এসব সমস্যা বোর্ডকে জানিয়েও ফল পাচ্ছে না ভুক্তভোগীরা। বোর্ড বলছে, বুয়েট করছে এ কাজ আর বুয়েটের কর্তাব্যক্তিরা কোন সমাধান দিচ্ছেন না। এসব উদ্বেগজনক কর্মকা-ে এখনও কলেজে ভর্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিত রয়ে গেছে সোয়া দুই লাখ এসএসসি পাস শিক্ষার্থী। ফলে তৃতীয় দফা মেধা তালিকা প্রকাশ করেও ভর্তির ভোগান্তি কাটাতে পারেনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বোর্ড ও বুয়েট। তৃতীয় মেধা তালিকা প্রকাশের পর থেকেই নতুন করে সঙ্কট দেখা দিয়েছে। অনেক নামীদামী কলেজে আসন খালি থাকলেও শিক্ষার্থীদের মনোনয়ন দেয়া হয়নি। আবার আসন খালি না থাকলেও সেখানে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে শিক্ষার্থীদের। ফলে কলেজে ভর্তি হতে গেলে শিক্ষার্থীদের কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দিচ্ছে- আসন খালি নেই। এসব নিয়ে শিক্ষার্থী, অভিভাবক আর কলেজ কর্তৃপক্ষের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। পরিস্থিতি সামাল দিতেই গত শনিবার ভর্তির নতুন একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল। এটি ছিল তৃতীয় তালিকা। এ তালিকায় নাম এসেছে ভর্তির সুযোগবঞ্চিত এক লাখ আট হাজার ৬৩৯ শিক্ষার্থীর। কিন্তু তালিকা প্রকাশের পরই বেরিয়ে এসেছে নতুন সঙ্কটের চিত্র। সর্বশেষ ভর্তির অবস্থা সম্পর্কে মন্ত্রণালয় ও বোর্ড বলছে, এখন পর্যন্ত নয় লাখ ৪৬ হাজার শিক্ষার্থীর ভর্তি সম্পন্ন হয়েছে। এ হিসাবেই এখনও কলেজে ভর্তি হতে পারেনি সোয়া দুই লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী। এবার নতুন পদ্ধতিতে ১১ লাখ ৫৬ হাজার ২২৪ শিক্ষার্থী একাদশে ভর্তিতে আবেদন করে। অনলাইনে এখন পর্যন্ত আবেদনই করেনি এক লাখ ২৬ হাজার ৬১৮ শিক্ষার্থী। অনলাইনে আবেদন করেও ভর্তির জন্য মনোনীত হয়নি আরও এক লাখ। ভর্তি নিয়ে বুধবার সরকারী ছুটির দিনেও নতুন কলেঙ্কারির জন্ম দেয়া হয়েছে। অমানবিক আচরণের ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয়েছে। জানা গেছে, শিক্ষা বোর্ডের মনোনয়নের পরও শারীরিক প্রতিবন্ধী বলে এক শিক্ষার্থীর ভর্তি নিল না রাজধানীর একটি কলেজ। ওই শিক্ষার্থী তার অভিভাবককে নিয়ে উত্তরার ওই কলেজে গেলে কলেজ কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেয়- তুমি প্রতিবন্ধী, তাই এখানে ভর্তি হওয়া যাবে না। তুমি শারীরিকভাবে ফিট নও। প্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রে ভর্তির অগ্রাধিকার থাকলেও কলেজটির কর্মকা-ের বিষয়ে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের কাছ থেকে কোন সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। কলেজে সকালে ওই শিক্ষার্থীর ভর্তি না নেয়ার পরই শিক্ষার্থী ও তার অভিভাবক ঢাকা বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক সালেহীনকে বিষয়টি জানিয়ে দ্রুত এ বিষয়ে বোর্ডের সহযোগিতা কামনা করে। কিন্তু কলেজ পরিদর্শক সহযোগিতা করতে অপারগতা প্রকাশ করে তাদের জানিয়ে দেন, বিষয়টি স্পর্শকাতর। আপনারা বোর্ডের চেয়ারম্যানকে বিষয়টি জানান। এরপর ওই শিক্ষার্থী ও অভিভাবক দুপুর দুটোর সময় ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু বকর সিদ্দিকীকে বিষয়টি জানায়। কিন্তু বোর্ড চেয়ারম্যান কলেজের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। বরং শিক্ষার্থীকে উল্টো নতুন করে ভর্তির আবেদন করতে পরামর্শ দেন। এ অবস্থায় ওই প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। শিক্ষার্থীর বড় ভাই দিপু জানান, তার ভাইয়ের নাম আশিকুর রহমান। তার এসএসসির রোলনং ১১৭৯২১। সে ঢাকা বোর্ডের শিক্ষার্থী এবং সে ভালভাবেই এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। তার কেবল একটি হাতে একটু সমস্যা আছে। অথচ কলেজ কর্তৃপক্ষ তাকে প্রতিবন্ধী বলে ভর্তি করেনি। ঢাকার ছাত্র রবিন মাহমুদ। অথচ তৃতীয় মেধা তালিকায় তাকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে ভোলার রেবা রহমান কলেজে। এমন তুঘলকী কর্মকা-ের শিকার হয়ে ভর্তি না হয়ে মাইগ্রেশন করার সিদ্ধান্ত নেয় সে। কিন্তু সেখানেই বিপত্তি; ভর্তির টাকা না নিয়েই কলেজ কর্তৃপক্ষ তার ভর্তি নিশ্চিত করে ফেলেছে। ভোগান্তিতে পড়ে সে তিন দিন ধরে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে দৌড়াচ্ছে। সেখানেই এই অভিযোগ জানালো রবিন। শুধু রবিনই নয়; এ রকম আরও অনেকেই এমন অভিযোগ নিয়ে ছুটছে শিক্ষা বোর্ডের বিভিন্ন কক্ষে। বুধবার বোর্ডের কলেজ শাখার কর্মকর্তারা জানান, এখন যে সমস্যাগুলো নিয়ে আসছে শিক্ষার্থীরা তার প্রায় ৭০ ভাগই হচ্ছে কলেজের প্রতারণা নিয়ে। শিক্ষার্থীকে না জানিয়ে অনেক কলেজ ভর্তি করিয়ে দিচ্ছে। বোর্ডে শিক্ষার্থীদের নামও পাঠিয়ে দিচ্ছে। ফলে ওই শিক্ষার্থী কোথাও ভর্তির জন্য গেলে সার্ভারে দেখা যায়, তার ভর্তি শেষ হয়ে গেছে অন্য কোন কলেজে। প্রতিদিন হাজারো শিক্ষার্থী ভিড় করছে বোর্ডের চেয়ারম্যান, কলেজ পরিদর্শক ও উপ-কলেজ পরিদর্শকের দফতরে। বেশ কয়েক শিক্ষার্থী অভিযোগ করেছে, শিক্ষার্থী নিজে আবেদন করে ভর্তি না হলেও তাদের নাম ব্যবহার করে বোর্ডের কাছে কয়েকটি কলেজ তালিকা পাঠিয়েছে। এর ফলে ওই শিক্ষার্থীরা পছন্দের কলেজে ভর্তি হতে পারছে না। আফজাল হোসেন মুন্না নামের এক শিক্ষার্থী বলছিল, ‘আমি উত্তরার আমেরিকান কলেজের জন্য নির্বাচিত হলেও ভর্তির জন্য বোর্ড নির্ধারিত কোন ফি প্রদান বা কোন কাগজই দিইনি। কারণ এ কলেজে আমি ভর্তি হতে ইচ্ছুক নই। পরবর্তীতে আমি ড্যাফোডিল কলেজে ভর্তির জন্য আবেদন করি। কিন্তু গত ১০ জুলাই জানতে পারি আমি টাকা না দিলেও কলেজ কর্তৃপক্ষ আমার ভর্তি নিশ্চিত করে রেখেছে।’ ময়মনসিংহের আরাফাত রহমান বলেন, ‘আমার মেয়ে সুষ্মিতা রহমানের নামে আবেদন করা হয়েছে। অথচ আমি রিলিজ সিøপ নিয়ে মেয়েকে ভর্তি করাতে পারছি না।’ বিষয়টি নিয়ে কলেজ পরিদর্শক আসফাকুস সালেহী বিব্রত। প্রতিদিন একই সমস্যা সামাল দিতে হচ্ছে তাঁকে। তিনি বলেন, বোর্ডে বেশকিছু অভিযোগ এসেছে। আমারা কলেজগুলো চিহ্নিত করছি। অবশ্যই কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু চেয়ারম্যন আবু বকর সিদ্দিকী দায়িত্ব চাপালেন উল্টো শিক্ষার্থীদের ওপর। কলেজগুলোর বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিচ্ছেন- জানতে চাইলে তিনি উল্টো বলেন, ‘আপনি শিক্ষার্থীদের বলেন তারা যেন কলেজের ওপর চাপ সৃষ্টি করে।’ শিক্ষার্থীরা বোর্ডে অভিযোগ দিচ্ছে, তারা আর কী করতে পারে। তাহলে আপনারা কেন আছেন- এমন প্রশ্নে চেয়ারম্যান বলেন, তাহলে কলেজগুলোর একটি তালিকা দিতে বলেন শিক্ষার্থীদের। কলেজ শাখায় শত শত শিক্ষার্থীর লিখিত অভিযোগ করার বিষয়টি চেয়ারম্যানকে জানানো হলে তিনি বলেন, ‘ও, আমি দেখছি তাহলে।’
×