ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিশেষজ্ঞদের মতে, মূলত বিচারহীনতাই শিশু নির্যাতন ও হত্যার কারণ

বাড়ছে শিশু নির্যাতন ॥ বছরে হাজারো মামলা হলেও সাজার হার এক ভাগেরও কম

প্রকাশিত: ০৬:১৫, ১৬ জুলাই ২০১৫

বাড়ছে শিশু নির্যাতন ॥ বছরে হাজারো মামলা হলেও সাজার হার এক ভাগেরও কম

শর্মী চক্রবর্তী ॥ ‘অ ভাই আমারে এক গললাস (গ্লাস) পানি দেওরে বা, আমার গলা হুকাই গেছে (শুকিয়ে গেছে), আর আমারে মারিও না, আমার আত-পাও ভাঙ্গি গেছে (হাত-পা)’ এতসব কথা বলার পরও মন গলেনি পাষ- খুনীদের। গত ৮ জুলাই সিলেট-সুনামগঞ্জ রোডের কুমারগাঁও বাসস্টেশন এলাকার বড়গাঁওয়ের সুন্দর আলী মার্কেটের একটি ওয়ার্কশপের সামনে বারান্দার খুঁটিতে বেঁধে নির্যাতন করে হত্যা করা হয় রাজনকে। নির্যাতন করে হত্যার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও ইউটিউবে রাজনকে নির্যাতনের মর্মান্তিক দৃশ্য প্রচার করা হয়। ২৮ মিনিটের ভিডিও ফুটেজ এতটাই নির্মম আর পৈশাচিক যে, সিনেমার ভিলেনরাও এই নিপীড়ন দেখে আঁতকে উঠবে। কিন্তু নিষ্ঠুর নির্যাতনকারীদের মনে তার জন্য এতটুকুও মায়া হয়নি। তারা তাকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, তাকে অজ্ঞাত স্থানে ফেলে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু জনতা দেখে ফেলায় গাড়িসহ ঘাতকদের আটক করে। চুরির অপরাধে শিশুটিকে নির্যাতন করে হত্যা করে। ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, রাজনকে নির্যাতন করা ঘাতকরা বার বার একটা কথাই বলছিল, ‘তরে এমন শিক্ষা দিমু, হালার হালা (শালার শালা) জীবনে আর চুরি খরতে (করতে) ফারতে (পারবে) নায় (না)’। ঠিকই জীবন দিয়ে চুরির অপবাদের মূল্য দিয়েছে শিশুটি। কণ্ঠস্বর ও চিত্র থেকে অনুমেয়, ৫-৬ জন ঘাতক মিলে এই শিশুটিকে নির্যাতন করে। শুধু রাজনই নয়, এমন অনেক শিশুই নির্যাতন ও হত্যার শিকার হচ্ছে। দিন দিনা বেড়েই চলছে এ ধরনের নির্যাতন। অপরাধীরা রয়ে যাচ্ছে পর্দার অন্তরালে। আইন থাকলেও হচ্ছে না বিচার। আর এ কারণেই অপরাধীরা সুযোগ পেয়ে যায় এবং নির্যাতনও বাড়তে থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিচারহীনতার কারণেই মূলত শিশু নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা বাড়ছে। শারীরিক ও যৌন আক্রমণের সামনে শিশুরা বেশি অসহায়। আর এ সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে অপরাধীরা। তাদের ধারণা, শিশু হত্যা ও যৌন নির্যাতন করে সহজেই অপরাধ আড়াল করা সম্ভব। কারণ এসব ঘটনায় সাধারণত অপরাধীদের বিচারের সম্মুখীন হতে হয় না। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, অপরাধীদের পাশে দাঁড়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কতিপয় সদস্য, জনপ্রতিনিধিসহ সমাজের প্রভাবশালীরা। নির্যাতনের শিকার শিশুদের অধিকাংশই দরিদ্র পরিবারের। ফলে নির্যাতিত শিশুর অভিভাবকরা অনেক ক্ষেত্রেই মামলা দায়ের করতে পারেন না। যত দ্রুত সম্ভব অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করা হলে সমাজে এমন অপরাধ কমে আসবে। বিদ্যমান সমস্যা নিরসনে সরকারের পাশাপাশি সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে একযোগে এগিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, মহিলা আইনজীবী সমিতি ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১ মে থেকে চলতি মাসের ১৪ জুলাই পর্যন্ত গত আড়াই মাসে সারাদেশে প্রায় ১০২৩টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। হত্যা করা প্রায় ১৬০ জনের মধ্যে অধিকাংশই শিশু। ধর্ষণের পর হত্যা, গৃহকর্মী ও পথশিশুদের হত্যা, অপহরণের পর হত্যা সবচেয়ে বেশি। সর্বশেষ শিশু রাজনকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। বাংলাদেশ শিশু পরিস্থিতি-২০১৩ নিয়ে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন ছয়টি জাতীয় পত্রিকার শিশু বিষয়ক খবর পর্যালোচনা করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বছরটিতে ২৬৭ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। এরমধ্যে মারা যায় ১২ জন। গুরুতর আহত হয় ২৩৯ শিশু। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বছরটিতে ৯০ শিশু অপহরণের শিকার হয়। অপহরণের পর খুন করা হয় দু’জনকে। পারিবারিক কলহ, মুক্তিপণ না পেয়ে, জমিজমা নিয়ে বিরোধ ও মা-বাবার পরকীয়ার জেরে ৩৩৫ শিশু খুন হয়। অশ্লীল ভিডিওচিত্র ছড়ানোর ভয়ে বা অন্যান্য কারণে আত্মহত্যা করে ১৬৬ শিশু। বিভিন্ন অপরাধী কর্মকা-ে ২৪৫ শিশুকে সম্পৃক্ত করা হয়। এরমধ্যে মারা যায় ১৭৬ জন। বছরটিতে পাচার হয় ৪২ শিশু। এ্যাসিডদগ্ধ হয় ১০ শিশু। রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার হয়ে ৪১ শিশু মারা যায়। ১০৭ শিশু গুরুতর আহত হয়। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে দেশে প্রতি বছর হাজারো মামলা হলেও মামলায় অভিযুক্তদের সাজা পাওয়ার হার ১ শতাংশেরও কম। এখানে বলা হয়েছে, দেশের তিনটি জেলায় ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ২২ হাজার ৭৩টি মামলায় নিষ্পত্তি হলেও এতে সাজা পেয়েছেন মাত্র ১৮৬ জন। সাজা পাওয়ার হার মাত্র দশমিক ৯৪ শতাংশ। সিলেটে শিশু রাজন হত্যা নজিরবিহীন জানিয়ে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম বলেন, আমাদের দেশে শিশু নির্যাতন ও হত্যা ঘটছে প্রতিনিয়ত। সাত বছরের শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, শিশু অপহরণ করে নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, এমন বর্বর ঘটনার যথাযথ বিচার হচ্ছে না। অপরাধীদের পাশে রাজনৈতিক দলের শক্তিশালী নেতারা দাঁড়াচ্ছে, প্রতিপক্ষ হচ্ছে। পৈশাচিক এ ঘটনা নিয়ে সরকার থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষকে রুখে দাঁড়াতে হবে। তিনি বলেন, রাজন হত্যার আসামি সৌদি আরবে গ্রেফতার হয়েছে, তাকে দেশে এনে যথাযথ আইনের মাধ্যমে চূড়ান্ত শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। অপরাধীদের পাশে রাষ্ট্র, রাজনৈতিক নেতাকর্মী, উকিল-মোক্তারসহ কেউই দাঁড়াবে না। একই সঙ্গে সমাজে এমন বর্বর কর্মকা-ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র, প্রশাসন, জনপ্রতিনিধিসহ সর্বস্তরের লোকজনের প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করতে হবে। তবেই কেবল এমন বর্বর ঘটনা কমে আসবে। জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, দেশে শিশু হত্যা, ধর্ষণ ও শারীরিক নির্যাতনের যথাযথ বিচার হচ্ছে না। কিছু খুনের ঘটনায় অপরাধীদের ফাঁসি হলেও বছরের পর বছর সেই রায় কার্যকর হয় না। তিনি বলেন, রাজন হত্যা মানবতা ও মানুষের বিবেককে চরমভাবে নাড়া দিয়েছে। রাজনকে যেভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে, নির্যাতনকারীদেরও সেই একই ভাবে শাস্তি দেয়া হোক। একজন শিশুকে কোন অবস্থাতেই অপরাধী বলা যায় না। শিশু ও চলমান আইনে শিশুদের অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না। রাজনের মতো একটি ছোট শিশুকে পিটিয়ে হত্যা করে ভিডিও করে উল্লাস করে খুনীরা, এটা কী করে সম্ভব! তিনি বলেন, সরকার তথা প্রশাসন শিশু রাজনকে বাঁচাতে পারেনি। পুলিশ বিষয়টিকে ধামাচাপা দেয়ার অনেক চেষ্টাও করেছে। কিন্তু পারেনি। রাজন হত্যার বিচার আর কেউ ধামাচাপা দিতে পারবে না। আমাদের কাছে সকল প্রমাণ আছে। এর বিচার মৃত্যুদ- ছাড়া আর কিছু না। পুলিশ প্রশাসন এজন্য দায়ী। তারা চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। ব্যর্থতার দায় নিয়ে সরকারকে রাজনের পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে জানিয়ে এ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, খুনীদের সৌদি আরবে যেতে যারা সহযোগিতা করেছে তাদেরও বিচারের আওতায় আনতে হবে। হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণের ঘটনায় অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা গেলেই কেবল এমন নৃশংস ঘটনা সমাজে কমে আসবে।
×