ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বড় শক্তি হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৬:১৯, ১৫ জুলাই ২০১৫

বড় শক্তি হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ

সেই দিন ফুরিয়েছে। বাংলাদেশ এখন আর ক্রিকেটের ‘দুর্বল দল’, ‘ছোট্ট দল’টি নেই। এখন ক্রিকেটে ‘বড় শক্তি’ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের চেয়ে র‌্যাঙ্কিংয়ে যতই এগিয়ে থাকুক কোন দল। সেই দলটি বাংলাদেশকে পাত্তা দেবে না, সেই সময় উধাও হয়েছে। সর্বশেষ দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে হেসে-খেলে ৭ উইকেটের বড় জয় তাই প্রমাণ করে। গত বছর শেষের দিকে জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে ৫ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ খেলা শুরু করে বাংলাদেশ। সেই থেকে বাংলাদেশের এ উত্থানের শুরু হয়। মাশরাফি বিন মর্তুজার হাত ধরে শুধু উড়ছে দল। মাশরাফির ছায়াতলে শুধু সাফল্যই মিলছে। জিম্বাবুইয়েকে ৫-০ তে হারানোর পর বিশ্বকাপেও দেখিয়েছে ঝলক। বাংলাদেশ কোয়ার্টার ফাইনালে খেলেছে। এরপর পাকিস্তানকেও (৩-০) ‘বাংলাওয়াশ’ করেছে বাংলাদেশ। ভারতকেও সিরিজে ২-১ ব্যবধানে হারিয়ে দিয়েছে। জিম্বাবুইয়ের পর ইংল্যান্ডের মতো দলকে বিশ্বকাপের বড় মঞ্চে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে উড়িয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। সবার প্রশংসা কুড়িয়েছে মাশরাফিবাহিনী। এরপর পাকিস্তানের মতো দলকে হোয়াইটওয়াশ করেছে। তখন কথা উঠেছে, পাকিস্তান খানিক দুর্বল দল বলেই এমন হয়েছে। এরপর যখন ভারত শক্তিশালী দল নিয়ে আসল, তখন কথা উঠল; কোনভাবেই বাংলাদেশ পারবে না। এ দলটিকে যখন সিরিজে হারিয়ে দিল বাংলাদেশ, তখনই আসলে বিশ্ব ক্রিকেট কাঁপতে শুরু করে দেয়। শুরুতে ভারতের সিনিয়র ক্রিকেটাররা আসতেই চায়নি। এসে ধরাশায়ীই হয়েছে। এবার বাংলাদেশের মাটিতে যখন দক্ষিণ আফ্রিকা এসেছে, তখনও কথা উঠেছে; বাংলাদেশ পারবে না। প্রথম দুই টি২০তে অবশ্য কিছুই করতে পারেনি বাংলাদেশ। হেরেছে। এরপর প্রথম ওয়ানডেতেও দক্ষিণ আফ্রিকা অনায়াসেই জিতেছে। কিন্তু দ্বিতীয় ওয়ানডেতে এসেই সব ওলট-পালট হয়ে গেছে। বাংলাদেশ এবার জিতে গিয়ে সিরিজে ১-১ সমতা এনেছে। অসাধারণ ব্যাটিং বোলিং করেছে বাংলাদেশ। অথচ এ বাংলাদেশ যখনই শক্তিশালী দলগুলোর বিপক্ষে খেলতে নামত, তখনই বাংলাদেশকে ‘দুর্বল দল’ই বলা হতো। এখন আর সেই সুযোগ নেই। গায়ে যে এতদিন দুর্বল দলের গন্ধ লেগে ছিল, তা আর নেই। এখন ‘বড় দলে’র ছাপ বাংলাদেশের গায়ে লেগে গেছে। সেই কাজটি দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৮ বছর পর জেতাতেই হয়েছে। ২০০৭ সালে গায়ানাতে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়েছিল বাংলাদেশ। এবার বাংলার মাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকা বধ করেছে। গায়ানার স্মৃতি আবারও পুনরাবৃত্তি করেছে বাংলাদেশ। ২০০৭ সালের বিশ্বকাপের সুপার এইটে ওয়েস্ট ইন্ডিজের গায়ানাতে যে জয় মিলেছিল, সেই জয়টি এতদিন দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে বাংলাদেশের একমাত্র জয় ছিল। এবার আবারও দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারাল বাংলাদেশ। এ জয়টি আসল এবার বাংলার মাটিতে। নাসির হোসেন কী দুর্দান্ত বোলিংই না করেছেন। ২৬ রান দিয়ে ৩ উইকেট নিয়েছেন। আর মুস্তাফিজুর রহমানতো (৩/৩৮) তিন ম্যাচ পর আবার জ্বলে উঠেছেন। তাতে ১৬২ রানেই অলআউট হয়ে যায় দক্ষিণ আফ্রিকা। এ রান অতিক্রম করতে গিয়ে সৌম্য সরকার (৮৮*) ও মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের (৫০) দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ে ১৬৭ রান করে ৭ উইকেটে প্রোটিয়াদের হারিয়ে গায়ানার স্মৃতি আবারও মিরপুরে ফিরিয়ে এনেছে টাইগাররা। এ জয়টি পাওয়ায় তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে ১-১ সমতা এসেছে। আজ চট্টগ্রামে সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডেতে যে দল জিতবে, সিরিজ তাদেরই হয়ে যাবে। তবে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারানোর আনন্দের সঙ্গে বাংলাদেশ শিবিরে স্বস্তিও মিলে গেল। ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে খেলা যে নিশ্চিত করে নিয়েছে মাশরাফিবাহিনী। এ নিয়ে আর কোন দ্বিধাই থাকল না। সেইসঙ্গে জিম্বাবুইয়েকে ৫-০, পাকিস্তানকে ৩-০, ভারতকে ২-১ ব্যবধানে সিরিজে হারানোর পর এখন তো দক্ষিণ আফ্রিকাকেও সিরিজে হারানো আশা জেগে গেল! যদি দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে সিরিজ নিজেদের করে নেয়া যায়, তাহলে টানা চার সিরিজ জয় হবে বাংলাদেশের। দেশের মাটিতে অপ্রতিরোধ্য দলই হয়ে উঠবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ-দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজ শুরুর আগে একটি প্রশ্ন সবার মুখে মুখে ছিল, গায়ানার স্মৃতি পুনরাবৃত্তি করতে পারবে বাংলাদেশ? সেটি যে ওয়ানডেতেই হতে হবে এমন নয়, দুই ম্যাচের টি২০ সিরিজে হলেও হতো। কিন্তু বাংলাদেশ দুটি টি২০তেই হেরে গেল। প্রথম ম্যাচে ৫২ রানে ও দ্বিতীয় ম্যাচে ৩১ রানে হেরে যায় বাংলাদেশ। এরপর যখন প্রথম ওয়ানডেতেও ৮ উইকেটের বড় ব্যবধানে হার হলো, তখন বাংলাদেশের সিরিজ হারই হবে, এমন ভাবাও হলো। শেষে গিয়ে বাংলাদেশ জিতল। দ্বিতীয় ওয়ানডে জয়ে যেমন জয়ের দিক দিয়ে গায়ানার স্মৃতির পুনরাবৃত্তি হলো। দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংস শেষ হতেই গায়ানা স্মৃতি সামনে এসে পড়ল। এর আগে যে সেই গায়ানাতেই একবার মাত্র দক্ষিণ আফ্রিকাকে অলআউট করতে পেরেছিল বাংলাদেশ। গায়ানায় ১৮৪ রানে অলআউট করে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৬৭ রানের জয়ও পেয়েছিল বাংলাদেশ। এবার তার চেয়েও কম রানে দক্ষিণ আফ্রিকাকে অলআউট করা গেলে। টি২০তে দক্ষিণ আফ্রিকা অনেক শক্তিশালী দল, তাই বাংলাদেশ ফেভারিট নয়; দলের ক্রিকেটাররাই বলেছেন। হেরেছেও বাংলাদেশ। যখন ওয়ানডে সিরিজ শুরু হলো, মাশরাফি তিন ওয়ানডেতেই জয়ের কথা বললেন। তাতে করেই যেন ক্রিকেটারদের ভেতর আবারও আত্মবিশ্বাসের জ্বালানি দেখা গেল। তবে প্রথম ওয়ানডেতে তা একেবারেই মিলেনি। দ্বিতীয় ওয়ানডেতে গিয়ে তা ফুটে উঠল। এরপর মাশরাফি সংবাদ সম্মেলনে যা সব বললেন, সবার মন ছুয়ে গেল। বলেছেন, ‘বোলাররাই ব্যাটসম্যানদের কাজ সহজ করেছে। বিশ্বকাপ থেকেই বোলাররা ভাল করছে। ওখানে (বিশ্বকাপে) নির্দিষ্ট কয়েকটা ম্যাচ বাদে বোলাররা কমই বাজে বল করেছে। এরপর থেকে দলগতভাবে বোলিং ইউনিট খুবই ভাল করেছে। আমি নির্দিষ্ট করে কারও কথা বলব না। তবে রবিবার (দ্বিতীয় ওয়ানডেতে) বোলাররা ব্যাটসম্যানদের কাজ সহজ করে দিয়েছে। আমি এটাই চাচ্ছিলাম।’ মাশরাফি বোলারদের নিয়ে অনেক পর্যবেক্ষণের ইঙ্গিতও দিলেন। বললেন, ‘বোলিং পরিবর্তন করাটা আসলে পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে। অনেক কিছুই করতে চেয়েছিলাম, যখন যেটা মাথায় এসেছে। সাকিবকে এনে এক পর্যায়ে শেষ করে দিলাম। এরপর মুস্তাফিজকে দিয়ে বল করালাম। এছাড়া রুবেলকে দিয়ে অতিরিক্ত ওভার করিয়েছি। রিয়াদকেও করিয়েছিলাম।’ তবে মাশরাফি চ্যালেঞ্জের বিষয়ে মন ছুঁয়ে যাওয়া কথাই বলেছেন, ‘প্রত্যেকটি দিনই নতুন চ্যালেঞ্জের। তবে চ্যালেঞ্জ বলতে আমি শুধু বুঝি, আমার একটা ছেলে আছে আর একটা মেয়ে আছে। তাদের মানুষ করে তোলা। আর যা আছে সেসব আমার কাছে চ্যালেঞ্জ নয়।’ দক্ষিণ আফ্রিকাকে যে এত কম রানে আটকে রাখতে পারবে বাংলাদেশ এমনটা মাশরাফিও স্বয়ং ভাবেননি। বলেছেন, ‘সত্যি কথা বলতে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ১৬০ রানে অলআউট করার কথা কখনই ভাবিনি। ওদের যখন ৪-৫টা উইকেট পড়ে যায়, তখন চাপে রাখার চেষ্টা করছিলাম। তখন কিন্তু আমি মূল বোলারদের ব্যবহার শুরু করছিলাম। আমি যত তাড়াতাড়ি পারি ওদের অলআউট করতে চেয়েছিলাম।’ সেই কাজটি হয়ে যায়। বাংলাদেশ জিতেও যায়। এ জয়টিই বাংলাদেশের গায়ে ‘বড় শক্তি’র দল হয়ে ওঠার ছাপ লাগিয়ে দিয়েছে।
×