ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সৌম্য সরকার- ক্রিকেটের নতুন সম্রাট

প্রকাশিত: ০৬:২১, ১৪ জুলাই ২০১৫

সৌম্য সরকার- ক্রিকেটের নতুন সম্রাট

প্রতিভাবন ব্যাটসম্যান সৌম্য সরকারকে আমাদের ক্রিকেটের নতুন সৌন্দর্য বললে একটুও ভুল হবে না। আত্মবিশ্বাস, ব্যাটিং স্টাইল দিয়ে তিনি সত্যিই তার সৌন্দর্য উন্মোচন করে চলেছেন। আসলেই ক্রিকেটের নতুন সৌন্দর্য তিনি। নতুন সৌরভের এক ফুলবাগান। সাকিব, তামিম, মুশফিকের নামের পাশে তার নামও তাই এখন উজ্জ্বল তরো। ক্যারিয়ারের বিচারে সাকিব, তামিম, মুশফিকদের তুলনায় তার খেলা ম্যাচের সংখ্যা মোটেও উল্লেখযোগ্য নয়, কিন্তু শুধু সৌন্দর্যময় ব্যাটিং পারফর্মেন্সের কারণেই সৌম্য এখন সবার মন জয় করে নিয়েছেন। ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ এবং ক্রীড়ামোদীদের আলোচনায় তিনিও এখন অন্যতম। তার পারফর্মেন্স সবাইকে এতটাই মুগ্ধ করেছে যে এমন এক তরুণের অপেক্ষাতেই যেন ছিল সবাই। দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে চলমান সিরিজে ১২ জুলাই দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ৭৯ বলে ৮৮ রানের অসাধারণ এক ইনিংস খেলে সৌম্য তার ব্যাটিং সৌন্দর্যের আরেকটি প্রমাণ দিলেন। এই ইনিংসে ছিল ১৩ চার এবং এক ছক্কার মার। স্ট্রাইক রেট ১১৩.৩। বলতে দ্বিধা নেই দেশের ক্রীড়ামোদীরা এদিন প্রাণ ভরে উপভোগ করে সৌম্য সরকারের দুরন্ত ব্যাটিং। স্বভাবতই ম্যান অফ দ্য ম্যাচের স্বীকৃতিটুকু আগেই নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল তার জন্য। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সৌম্য সরকারের আগমন খুব বেশি দিন নয়। মূলত এবারের বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সময়ই সৌম্য নামটা খানিকটা আলোচনায় উঠে আসে। সে সময় তিনি বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হন তার হাতের মধ্যে কিছুটা জাদু লুকিয়ে আছে। সময় সুযোগ পেলেই তিনি সেই জাদু উন্মোচনে সক্ষম হন। তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে সর্বশেষ ওয়ানডে সিরিজ এবং চলমান দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে দ্বিতীয় ওয়ানডেতে সেই জাদু উন্মোচন করতে সক্ষম। স্বল্প ক্যারিয়ারের এই তরুণ বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন তিনি একজন জাত ক্রিকেটার। তার মাঝে মাল-মসলার শেষ নেই। ব্যাটিং বিনোদন দিতেও তিনি পারঙ্গম। আগে থেকেই অবশ্য সৌম্য সেই ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন-বড় কিছু করা তার পক্ষে অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু ভাগ্য সহায়তা না থাকার কারণে তার হাত থেকে সবকিছু ফসকে যাচ্ছিল। তবে পাকিস্তানের সঙ্গে শেষ ওয়ানডে তাকে আর কেউ অবরুদ্ধ করে রাখতে পারেনি। ২২ এপ্রিল তাই সৌম্য হয়ে উঠেছিলেন অদম্য। সেদিন বাংলার মানুষ প্রাণভরে দেখেছে পাকিস্তানের বিপক্ষে একজন বাঙালী তরুণের সাহসী ক্রিকেট। দেখেছে তার ব্যটিং সৌন্দর্য। সেদিন পাকিস্তানের সব কলাকৌশলকে পরাস্ত করে সৌম্য ১১০ বলে ১২৭ রানের এক ঝকঝকে অপরাজিত ইনিংস খেলে সবার মন ভরিয়ে দেন। রাতটাকে বড় বেশি আলোকিত করেন তিনি। এখানেই গল্প শেষ নয়। ১৩ চার আর ছয় ছয় দিয়ে তার ইনিংসকে করে আরও উজ্জ্বল তরো। আবার স্ট্রাইক রেটটাও ছিল সবার থেকে বেশি ১১৫.৪৫। মজার বিষয় হলো ১২ জুলাই দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে চলমান সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতেও ফের ১৩ বাউন্ডারির পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে অপরাজিত ৮৮ রান করেন। আরও একটি উচ্চকিত ইনিংস খেলার কৃতিত্ব দেখান তিনি। সবাই একবাক্যে স্বীকার করবেন আমাদের ক্রিকেটে এই সময়ে এক অনন্য নাম সৌম্য। এই তরুণের পুরো নাম সৌম্য শান্ত সরকার। এই সময় যে সব উদীয়মান তারকা মধ্যে সবার নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছেন সৌম্য তাদের মাঝে অন্যতম একজন। এই অল্প অভিজ্ঞতাতেই মাঠে বিশ্বস্ততার ছাপ রেখে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। এতদিন ধরে যেসব ক্রীড়ামোদীদের চোখ ঘুরপাক খেত সাকিব, তামিম, মুশফিক ও মাশরাফিকে ঘিরেÑ সেইসব চোখের নিশানাতে এখন সৌম্যও অনিবার্য। কদিন আগেই সৌম্য ছিলেন একেবারেই অজানা, অচেনা। কিন্তু সেই সৌম্যই এখন সবার চেনা। প্রিয়ও হয়ে উঠেছেন বেশ। আত্মবিশ্বাসী সৌম্য সাতক্ষীরার তরুণ। একেবারে গাঁওগ্রামের সন্তান। সাতক্ষীরাতেই বড় হয়েছেন। ক্রিকেটের হাতেখড়িও ওখানে। এরপর এক সময় বিকেএসপিতে ভর্তি হন। বিকেএসপি থেকেই ঘরোয়া ক্রিকেটে তার অভিষেক। জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পাওয়ার আগেই সৌম্য ঘরোয়া ক্রিকেট নিজের পারফর্মেন্স দিয়ে বুঝিয়ে দেন আগামী দিনে তাকে কেউ রুখতে পারবে না। ঘরোয়া ক্রিকেটে তিনি খেলেন রাজশাহী বিভাগের হয়ে। প্রিমিয়ার ক্রিকেটে খেলেন ভিক্টোরিয়ার পক্ষে। গত বছরের জুনে কুয়ালালামপুরে অনুর্ধ ১৯ এশিয়া কাপে কাতারের বিপক্ষে ডাবল সেঞ্চুরি করে নিজ প্রতিভাকে উন্মোচিত করেন। ২০৯ রানের একটি বিস্ফোরক ইনিংস খেলেছিলেন ১৩৫ বলে। যাতে ছিল ২৭ বাউন্ডারি ও আট ওভার বাউন্ডারি। সৌম্য এ পর্যন্ত প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে খেলেছেন ৩২। ৬০ ইনিংসে তার রান ১৫৬৮। একদিনের ক্রিকেট তার অভিষেক কিন্তু বেশি দিন নয়। গত বছরের পহেলা ডিসেম্বর। জিম্বাবুইয়ে সফরে এলে পঞ্চম ম্যাচে তিনি খেলার সুযোগ পান। সে ম্যাচে ১৮ বলে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২০ রান করেছিলেন সত্য, তবে চারটি চার মেরে নিজেকে খানিকটা রহস্যময় করে রেখেছিলেন। ছোট্ট ওই ইনিংসে স্ট্রাইক রেট ছিল ১১১.১১। এরপর বিশ্বকাপ স্কোয়াডে ডাক পান নিজের অবিশ্বাসকে পরাজিত করে। মাঝখানে ঢাকা প্রিমিয়ার লীগে তার ব্যাট থেকে উল্লেখযোগ্য রান এলে সৌম্য নির্বাচকদের নজরে পড়েন। বিশ্বকাপ স্কোয়াডে ঠাঁই হয় তার। নবাগত হিসেবে বিশ্বকাপে তিনি ভালই নিজেকে তুলে ধরেন। ১৩ মার্চ হ্যামিল্টনে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে একটি আধা সেঞ্চুরির করার সাহস দেখান। তখন থেকেই তাকে নিয়ে শুরু হয় ফিসফিস। ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের পাতায় তাকে নড়াচড়া শুরু করে ক্রিকেটমোদীরা। সৌম্য শান্ত সরকার নিতান্তই আমাদের সাধারণ পরিবারের এক ধীর স্থীর সন্তান। দেখেই বুঝা যায়, আভিজাত্য কোনদিনও তার পরিবারে ছিল না। লড়াই-সংগ্রাম আর সঙ্গে একমুঠ স্বপ্নকে ধরেই কেবল এগোতে হয়েছে। তবে অর্থনৈতিক আভিজাত্য না থাকলেও ক্রিকেট আভিজাত্যের দিকে ছুটে চলেছেন এই তরুণ। ম্যাচ খেলছেন আর বিশ্বস্ততার প্রতীক হয়ে উঠছেন। এই সময় কোচ চন্দ্রিকা হাতুরেসিংহের সবচেয়ে আস্থাভাজন তিনি। চন্দ্রিকা যেন তাকে দিয়েই সবাইকে ঘায়েল করতে চান। আসলে বাংলাদেশের মানুষ ঠিক কিছুদিন আগেই এভাবে ভাবেনি যে, আমাদের তরুণরা মাঠে নেমেই সাহস দেখাতে পারে। হাত খুলে পেটাতে পারে। প্রতিভাবন ক্রিকেটারদের কল্যাণে আমরা এখন সেটাই দেখছি। সত্যিই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ক্রিকেট অনেক বদলে গেছে, অনেক এগিয়ে গেছে তা যে কেউ স্বীকার করবেন। সে প্রসঙ্গেই বলছিলেন সাবেক ক্রিকেটার দীপু রায় চৌধুরী। তার মতে, আরও নতুন নতুন সৌম্য বেরিয়ে এলে দেশের ক্রিকেট আরও সমৃদ্ধ হবে। সৌম্যরাই এগিয়ে নিয়ে যাবে এদেশের ক্রিকেটকে। সৌম্যরাই এ দেশের ক্রিকেটকে করবে আরও সৌন্দর্যময়।
×