ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

-অর্মত্য সেন

ভারত ইন্ডাস্ট্রিয়াল জায়ান্ট হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার চেষ্টা করছে, তবে...

প্রকাশিত: ০৫:১১, ১৩ জুলাই ২০১৫

ভারত ইন্ডাস্ট্রিয়াল জায়ান্ট হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার চেষ্টা করছে, তবে...

অর্মত্য সেন আর্ন্তজাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভারতীয় অর্থনীতিবিদ-দার্শনিক। তিনি ১৯৯৮ সালে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন তাঁর দুর্ভিক্ষ ও দারিদ্র্য বিষয়ক মৌলিক কাজের জন্য। বর্তমানে তিনি হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত। সর্বশেষ ‘দ্য কান্ট্রি অব ফার্স্ট বয়েজ’ গ্রন্থ প্রকাশের কিছু আগে অর্মত্য সেন হিন্দুস্থান টাইমসের সাংবাদিক মঞ্জুুলা নারায়ণের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন। এরমধ্যে দরিদ্রতা নিয়ে ভুল ধারণা, গুজরাট মডেলের ভুলত্রুটি, ডানপন্থী হিন্দু ও শিক্ষায়তনে অনধিকার চর্চা এবং আদর্শের অবমাননা ইত্যাদি বিষয়ও উঠে আসে। গতকালের পর আজ পড়ুন সাক্ষাৎকারটির শেষাংশ। অনুবাদ করেছেন- আরিফুর সবুজ মঞ্জুলা : কিংবা, ধর্মের ওপর ফোকাস ছাড়াও নিরপেক্ষতার বিষয়েও... সেন : ঋগবেদের একটি বিষয় যা আমাকে বেশি ভাবায় তা হলো প্রকৃতির বিপুল ক্ষমতা যা আমাদের অভিভূত করে। আমরা জানি না কিভাবে তা পরিচালিত হয় বিশেষ করে বন্যা, প্রবল বর্ষণ, বজ্রপাত, তীব্র খরা, রোগব্যাধির প্রকোপ...। এটা চিন্তা করাই যায় যে, এসব বিষয় কোন সুপারন্যাচারাল পাওয়ার নিয়ন্ত্রণ করছে। এই বিষয় নিয়েই ঋগবেদের আলোচনা। এতে বোঝা যায় কোন একটি কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ আছে অর্থাৎ ভগবান। ঋগবেদে বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট আলোকপাত করা হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হলো, তাহলে কেন এত দুঃখজনক ঘটনা ঘটছে? অরুণ শৌরির একটি ইন্টারেস্টিং বই আছে, যেখানে তিনি কেন নাস্তিক এবং যদি ভগবান থেকেই থাকে তাহলে তার দয়া কোথায়, তা নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি এতে তার ছেলে, পরিবার এবং যন্ত্রণার কথা তুলে ধরেছেন। বইটি খুবই ভাল একটি বই। তিনি এবং আমার রাজনৈতিক আদর্শ এক নয়, কিন্তু এই বইটি আমি খুবই আগ্রহ নিয়ে পড়েছি। আমি মনে করি অরুণকে যে বেগ পেতে হয়েছিল, ঠিক সেইরকম বেগ ঋগবেদকেও পেতে হয়েছে। আমি সংস্কৃত নাটক খুব পছন্দ করি। শূদ্রকের ‘মৃচ্ছকটিক’ আমার খুবই পছন্দের। আমাদের এটার ভাল অনুবাদ দরকার। এর ইংরেজী অনুবাদটি ভাল নয়। নারায়ণ মূর্তির ছেলে রোহান। তাদের একটি ক্লাসিক্যাল লাইব্রেরি আছে। আমি সেটার উপদেষ্টা বোর্ডে আছি এবং চেষ্টা করছি বিখ্যাত সংস্কৃত প-িত শেলডন পোলোককে দিয়ে মৃচ্ছকটিকের নতুন অনুবাদ করাতে। আমি তাঁর সঙ্গে আগেও কাজ করেছি। আমি তাঁর জন্য রামায়ণের ভূমিকা লিখেছিলাম। রামায়ণের গল্পগুলো এতই সমৃদ্ধ যে এর প্রভাব শুধু ভারতেই নয়, পূর্ব ভারত থেকে জাপান হয়ে সারাবিশ্বেই। আমি সবসময়ই গণিত ও সংস্কৃতে আগ্রহী। কিন্তু দুঃখজনক যে, সংস্কৃতের প্রকৃত অধ্যয়ন না করে একে শুধু যুদ্ধের সেøাগান হিসেবে ব্যবহার করা হয়। মঞ্জুলা : ট্র্যাজেডি হলো সবকিছুকেই ক্ষুদ্রাবয়ব দেয়া হচ্ছে। সেন : আপনি একদম ঠিক। ক্ষুদ্রাবয়ব বড় ধরনের সমস্যা। মঞ্জুলা : এটি ভগবতগীতার ওপর কঠিন এক আঘাত। গীতা এর চেয়েও বড়। সেন : ভগবতগীতায় সংঘর্ষ ও নৈতিকতা নিয়ে যুক্তিতর্ক আছে। মহাত্মা গান্ধী দু’দিকেই ছিলেন। একদিকে তিনি অহিংসা মতবাদ প্রচার করেছেন আবার অন্যদিকে তিনি অর্জুনের পরিবর্তে কৃষ্ণের ভক্ত ছিলেন। আপনি চিন্তা করতেই পারেন যে, মহাত্মা গান্ধী অর্জুনের পক্ষে থাকবেন। কিন্তু তা হয়নি। আমি এই বিষয়গুলোকে গ্রহণ করছি না। কিন্তু অনেকে এগুলো গ্রহণ করেছে এমনকি পশ্চিমা বিশ্বও। ইমানুয়েল কান্টের কিছু লেখাও এরকম। আমি স্বাভাবিকভাবেই অর্জুনের প্রতি সহানুভূতিশীল। কিন্তু এখানে একটি সমস্যা আছে। তারা কেন এমন করেছে? কেন কৌরবকে পুরো রাজ্য দিয়ে দেয়া হলো ? এরজন্যই তো কৃষ্ণ যুদ্ধে জয়ী হয়েছে। ভগবতগীতা মহাভারতের একটি অংশ এবং মহাভারত শেষ হয়েছে বিষাদের মধ্য দিয়ে। মানুষজন মারা গেছে। পা-বরা সবাই মারা গেছে। তাদের দাহ করা হয়েছে। এখানে বেদের মতোই সঙ্কট বিদ্যমান। আপনি একদম ঠিক.... মঞ্জুলা : সাম্প্রতিক একটি রিপোর্টে দেখানো হয়েছে যে, আফ্রিকার অনেক দেশের চেয়েও ভারতে গরিব শিশুর সংখ্যা বেশি। সেন : হ্যাঁ। এবং অপুষ্টির অবস্থা আরও গুরুতর। টিকা গ্রহণের হার আফ্রিকার মতো এত খারাপ নয়, তবে বাংলাদেশ থেকে অনেক খারাপ এবং নাটকীয়ভাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে কম। মঞ্জুলা : এত বছর পরেও কেন আমরা এই পরিস্থিতিতে আছি। সেন : আমি মনে করি না যে আমরা এই বিষয়গুলোতে খুব বেশি সিরিয়াস ছিলাম। আমি বোঝাতে চাচ্ছি, যখন মানুষ বলে গুজরাট খুবই সফল অর্থনৈতিক মডেল, তখন তারা অপুষ্টি, নিরক্ষরতা, রোগ প্রতিষেধকের অভাব ইত্যাদি বিষয়কে এড়িয়ে যায়। এসব বিষয়ে গুজরাটের রেকর্ড খুবই বাজে। ইকোনোমিস্ট ম্যাগাজিনে এই বিষয়টির দিকে আলোকপাত করা হয়েছে। মোদির মুখ্যমন্ত্রিত্বের কালে গুজরাটের এসব পরিস্থিতি খুবই নাজুক হয়ে গিয়েছিল। এসব বিষয়ে আগে গুজরাট বিহারের থেকে সামান্য এগিয়ে থাকলেও পরে বিহারের চেয়ে খারাপ পরিস্থিতি হয়। পত্রিকাগুলো ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে অনেক কিছুই লিখেছে। ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন নিয়ে, বিশেষ করে রাস্তা ও বিদ্যুত। প্রকৃতপক্ষে অবকাঠামোর মধ্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যও অন্তর্ভুক্ত। ভারতই প্রথম দেশ যে ইন্ডাস্ট্রিয়াল জায়ান্ট হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার চেষ্টা করছে নিরক্ষর ও স্বাস্থ্যহীন শ্রমশক্তি নিয়ে। আমি মনে করি না যে, এতে সাফল্য আসবে। আমার কাছে এটি খুব বড় সমস্যা। মঞ্জুলা : এটা ইউপিএ হোক কিংবা এনডিএ হোক, কোন কিছুই আসলে পরিবর্তন হয়নি। সেন : না, খুবই কম। প্রকৃতপক্ষে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আরও খারাপ হচ্ছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় বাজেট ছিল অতি নগণ্য। গত বাজেটে তা আরও কমানো হয়েছে। মঞ্জুলা : ভিন্ন এক র‌্যাডিক্যাল গোষ্ঠীর হাতে ক্ষমতা যাওয়ায় এমনটা ঘটেছে। সেন : আমি একমত। একাডেমিক হস্তক্ষেপ বেশি হয়েছে। আমরা পরিবর্তন দেখি ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব হিস্ট্রিক্যাল রিসার্চ, ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট এবং আরও অনেক কিছুতে ( হাসি)। নালন্দার বিষয়টি এখানে অতি তুচ্ছ। এখানে দুর্ভাগ্যজনকভাবে পরিবর্তন ভালর জন্য নয়। বড় কথা হলো, গরিবরা উদ্বিগ্ন কিছু পরিবর্তনের কারণে। সেটা হলো নিপীড়ন। সূত্র : হিন্দুস্থান টাইমস
×