ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

জাফর ওয়াজেদ

চাই গণহত্যা এবং নাশকতার শ্বেতপত্র

প্রকাশিত: ০৫:১০, ১৩ জুলাই ২০১৫

চাই গণহত্যা এবং নাশকতার শ্বেতপত্র

উনিশ শতক থেকে বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়কালে এই বঙ্গদেশে ডাকাতরা ডাকাতির আগে চিঠি পাঠিয়ে জানান দিত কবে কোন্ সময়ে কার বাড়িতে ডাকাতি করতে আসবে। ধন-দৌলত যা আছে, সবই যেন তাদের হাতে তুলে দেয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়। ডাকাতরা বাধা পেলে বা তাদের কাছে প্রয়োজন মনে হলে কল্লা কেটে নিতে দ্বিধা করত না। তবে তারা মহিলাদের গায়ে হাত দিয়ে অলঙ্কার কেড়ে নিত না। খুলে দিতে বলত। বাংলার ডাকাত নিয়ে নানান গল্পগাথা বা উপকথা প্রচলিত রয়েছে। একালের জঙ্গীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পূর্ব ঘোষণা দিয়ে হত্যা করে। কাকে কাকে হত্যা করবে সে তালিকা দিয়ে পত্রও পাঠায়। জঙ্গীদের সর্বাধিক পছন্দ হত্যা করা। তাদের মর্জিমাফিক গণহত্যাও তাদের কর্মকা-ের প্রধান অংশ। এই জঙ্গীদের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াও অবরোধ-হরতাল নামক নাশকতা পালন কর্মসূচী দিয়ে গণহত্যা চালিয়েছেন। পেট্রোলবোমা মেরে বাস জ্বালিয়ে শতাধিক নিরীহ সাধারণ মানুষকে হত্যা করিয়েছেন। তারও আগে ঢাকায় ধর্মকে বর্ম করে জঙ্গী সমাবেশ ঘটিয়ে অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর, লুটপাট এমনকি ধর্মগ্রন্থ পোড়ানোর মতো ঘটনা ঘটিয়েছেন। ২০১৩ সালে নতুন করে জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসের বিস্তার ঘটে বেগম জিয়ার নেতৃত্বে। জ্বালাও পোড়াও কর্মসূচী দিয়ে সে সময় উগ্রতার পরিচয় দিয়েছেন হেফাজতে ইসলামী নামে একটি অরাজনৈতিক সংগঠনকে সমর্থন দিয়ে। এই সংগঠনটিতে রয়েছে বেগম জিয়ার জোটে থাকা ইসলামী ঐক্যজোটের জঙ্গী পৃষ্ঠপোষক ও পরিচালকরা। তাদের নেতা মুফতি ইজাহারুল ইসলাম চৌধুরীর অস্ত্র কারখানা আবিষ্কারের পর যে পলাতক। সেকালের ডাকাতদের মধ্যে ‘জেনুইন’ ডাকাত যেমন ছিল, তেমনি স্বদেশী আন্দোলনের বিপ্লবীরাও সাংগঠনিক প্রয়োজনে ডাকাতির আশ্রয় নিয়েছিল। একালের খালেদা জিয়া ও তার পুত্র মিলে যে পরিমাণ অর্থ লোপাট করেছেন অথচ দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত হয়েও আদালতে হাজিরা দিতে গড়িমসি করেন। সেই তিনি পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা থেকে অর্থ নিয়ে নির্বাচন করেছিলেন বলে পাকিস্তান জাতীয় সংসদেই বলা হয়েছে। আর ২০০১ সালে দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার পর দেশজুড়ে ‘এথনিক ক্লিনজিং’ চালু করেন। তার প্রথম টার্গেটই হয় হিন্দু সম্প্রদায়। এরপর আওয়ামী লীগ। নারকীয় বীভৎসতার নজির হয়ে আছে সেসব ঘটনা। ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য সন্ত্রাসের সব পথই তিনি ধরেছিলেন। ঘোষণাও করেছিলেন, ২০৪০ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে পারবে না। দেশ থেকে সংখ্যালঘু বিতাড়ন নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের চাপে বেগম জিয়া পন্থায় পরিবর্তন আনেন। ক্ষমতাকে দীর্ঘমেয়াদী পোক্ত করার পথে প্রধান বাধা শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রচেষ্টা চালানো হয়। সর্বশেষ ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালানো হয় আওয়ামী লীগের সমাবেশে। প্রাণে বেঁচে যান শেখ হাসিনা। প্রশিক্ষিত জঙ্গীদের ব্যবহার করা হয়েছিল ওই ঘটনায়। মামলার বিচার চলছে শ্লথ গতিতে এবং দীর্ঘদিন ধরেই। এরপর ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট মুন্সীগঞ্জ ছাড়া দেশের ৬৪টি জেলায় একযোগে গ্রেনেড হামলা চালানোর মধ্য দিয়ে খালেদা-জামায়াত জঙ্গীবাদের বিস্তার ঘটান। জেএমবি নামক জঙ্গী সংগঠনটি গড়ে ওঠে জামায়াতের সহায়তায়। তাই নিজামী বাংলাভাইয়ের অস্তিত্ব অস্বীকার করে বলেছিল, এসবই মিডিয়ার সৃষ্টি এবং কাল্পনিক। দেশে জঙ্গী বলে কিছু নেই, বাংলাভাইও নেই। কিন্তু বাংলাভাই ও শায়খ রহমান ধরা পড়ার পর তারা তাদের জামায়াত সম্পৃক্ততার কথা বলেছিল। বাংলাদেশে বেগম খালেদা জিয়ার হাত ধরেই এবং তার পুত্র তারেক ও জামায়াতের তত্ত্বাবধায়নে জঙ্গীবাদের আত্মপ্রকাশ, বিস্তার, এ্যাকশন, প্রাণহরণÑ সবই চলছিল। পাকিস্তানের জঙ্গী সংগঠনগুলোর শাখা বাংলাদেশেও গড়ে ওঠে। সে সুবাধে অনেকে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তারা দেশে এসে বিএনপি-জামায়াতের ছত্রছায়ায় সন্ত্রাসী ও জঙ্গী তৎপরতা চালিয়ে আসছিল। এই জঙ্গীরা নানারূপে, নানা মুখোশে কিংবা বহুরূপী সেজে আসে। প্রাণ হরণ শেষে পালিয়ে যায়। এই যে খুনী হয়ে ওঠা, কিংবা খুনী বানানো বা খুনীতে পরিণত হওয়ার পেছনে ইন্ধনদাতা, পৃষ্ঠপোষক এবং নেত্বত্ব তো রয়েছেই। সেই পর্দার অন্তরালে যারাই থাক, প্রকাশ্যে তাদের প্রতিভূ তো বেগম জিয়া ও জামায়াত জোট। সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদে বিশ্বাসীদের নিয়ে গড়ে ওঠা জোট বলেই সন্ত্রাসের পথ বেছে নিয়েছে তারা। নিতেই তো হবে। কারণ গণতান্ত্রিক রীতিনীতি, আচার-আচরণে তারা বিশ্বাসী নয় এবং তা তাদের আদর্শও নয়। আদর্শ হলে জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদের পথ ধরে গণহত্যা চালাত না। একাত্তর সালে পাকিস্তান হানাদার সেনাবাহিনী ও তার দোসর রাজাকার, আলবদরদের নিয়ে বেগম জিয়া চলতি বছরের প্রথম তিন মাস দেশজুড়ে গণহত্যা চালিয়েছেন। নাশকতামূলক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছেন ঘোষিত আন্দোলনের কর্মসূচী অবরোধ ও হরতালের মাধ্যমে। আন্দোলন যদি হবেই, তবে তার বিধিবদ্ধ পথ ও পন্থা পরিহার করেই বেগম জিয়া সাধারণ নিরীহ মানুষ হত্যা করে সরকারের পতন ঘটাতে চেয়েছিলেন। রাষ্ট্রীয় সম্পদও ধ্বংস করেছেন। অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করেছেন। জ্বালাও পোড়াও নীতি নিয়ে দেশজুড়ে আগুনের পাশবিকতাকে প্রসারিত করেছেন। আর এই সন্ত্রাসবাদের পথ তিনি ধরেছেন ২০০১ সাল হতে ক্ষমতায় থাকাকালে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে দেশে জঙ্গীবাদের যে দৌরাত্ম্য দেখা গেছে, শেখ হাসিনার সরকারের আমলে তা করার সুযোগ মেলেনি। জঙ্গীদের ব্যাপারে সরকার জিরো টলারেন্স নীতি নিলেও তাকে শক্তপোক্ত করার কাজটি দৃষ্টিগোচর হয় না। দৃশ্যমান মানে জনগণকে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করার কাজটি দৃঢ়তর করা না গেলে জিরো টলারেন্স ব্যাহত হবে। আর এই ব্যাহত হওয়া মানেই বিপদকে প্রশ্রয় দেয়া। প্রশ্রয় পেলে সে দানবে রূপান্তরিত হয়, এমনটা গত জানুয়ারি-মার্চ মাসে ঘোষণা দিয়ে গণহত্যাকালে প্রতীয়মানও হয়েছে। জঙ্গীবাদ দমনে সরকারের সক্রিয়তার কথা শোনা যায়। কিন্তু প্রকাশ্য দিবালোকে পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী জঙ্গীরা হত্যাকা- চালিয়েছে। পুলিশ তাদের টিকিটিও ছুঁতে পারেনি। কোন তথ্যও উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হয়নি। এতে জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদ দমনে দক্ষতা ও দুর্বলতার ঘাটতিই পরিলক্ষিত হয়। ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে শেখ হাসিনা এদেশে আন্তর্জাতিক জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদ দমনে দৃশ্যমান অগ্রগতি সাধন করেছেন অবশ্যই। বেগম জিয়ার নেতৃত্বাধীন জঙ্গীরা জিরো টলারেন্সকে উপেক্ষা করে বরং আরও বেশি সশস্ত্র, আরও জঙ্গী কলাকৌশল রপ্ত করছে। বেগম জিয়ার নির্দেশ পেলে তারা আবারও তা প্রয়োগ করবে অতীতের মতোই। উন্নত প্রযুক্তি তারা রপ্ত করেছে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের। এই জঙ্গী সংগঠনগুলো ঈদের পূর্বাপর সময়ে নাশকতামূলক কর্মকা- ঘটিয়ে নিজেদের অস্তিত্বকে জানান দিতে পারে এমন আশঙ্কা অমূলক নয়। বিএনপি-জামায়াতের রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সব জঙ্গী সংগঠন। অতীতেও এরা জঙ্গিত্ব প্রকাশ করেছে বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্তভাবে। কিন্তু বাস্তবে তা ছিল অত্যন্ত পরিকল্পিত এবং যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে কৌশল নির্ধারিত। তারা তাদের বর্তমান পর্যায়ের সব শক্তি প্রদর্শন করে নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে। তাদের বোমায় বহু নিরীহ মানুষ চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছে। এই জঙ্গীরা ধর্ম ব্যবসায়ী রাজনৈতিক দলগুলোর ছত্রছায়ায় আশ্রয় করে ক্রমশ বেড়ে উঠেছে। বেগম জিয়া জঙ্গীবাদের বিস্তারে আত্মঘাতী বোমা সংস্কৃতির চর্চা করাতে চাইতে পারেন। যাদের তিনি হত্যা করতে দীর্ঘদিন প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছেন, আত্মঘাতী সংস্কৃতির পথ তিনি ধরতেই পারেন। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিষয়ে সংসদে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘ওরা ভ্যানিটি ব্যাগে গ্রেনেড নিয়ে এসেছিল’, এখন যেমন বলেন, ‘পেট্রোলবোমা পুলিশ মেরেছে’। তাই পুলিশের বিচার করতে হবে। আত্মঘাতী বোমা হামলার পরও বলবেন, ‘পুলিশ নিজেরাই আত্মঘাতী বোমা মেরে হত্যাকা- ঘটিয়েছে।’ আত্মঘাতী বোমাচর্চা চালু করে দেশজুড়ে ভয়ভীতি ও আতঙ্ক তৈরি করে অরাজকতা ছড়িয়ে দেয়ার কৌশল ও পরিকল্পনা হতে বেগম জিয়া সরে এসেছেন, এমন ভাষ্য মেলে না। বেগম জিয়ার ইতোমধ্যে গাত্রদাহ শুরু হয়েছে। যখন বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত বলে বিশ্বব্যাংক অনুমতি দিয়েছে। দেশে প্রবৃদ্ধিও হার বাড়ছে। সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথ হচ্ছে ত্বরান্বিত। পারিবারিক সদস্য বেগম জিয়ার জামায়াতের যুদ্ধাপরাধী নিজামী-মুজাহিদের ফাঁসি হবে, তখন চুপ করে নির্বিকার থাকার নেত্রী নন তিনি। তাদের মুক্ত করার জন্য জঙ্গীদের কৌশলে তিনি নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। সরকারের কোন সদস্যকে সহ্য করতে না পারা বেগম জিয়া দেশের অগ্রগতি ও উন্নয়নকে মেনে নিতে পারছেন বলে মোটেই মনে হয় না। দেশের অগ্রগতি চাইলে তিনি মানুষ হত্যার পথ ধরে অবরোধ নামক নাশকতাকে প্রতিষ্ঠিত করতেন না। বেগম জিয়া তার আমলে উন্নয়নের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে বলে বেড়াবেন। বাস্তবে সে উন্নয়নের জোয়ার বইছে হাওয়া ভবন ও তার সাঙ্গোপাঙ্গদের। তাদের এই উন্নয়নের ফজিলতে দেশ ও জাতির কোন অগ্রগতি হয়নি। হয়েছে দুর্নীতির। ইয়াজউদ্দীন সরকারের আমলে মাতাপুত্রসহ দলের অনেক নেতাই দুর্নীতির দায়ে জেল খেটেছেন। এসব খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে বর্তমান একমাত্র বাধা ও প্রতিবন্ধক জঙ্গীবাদ। এই জঙ্গীবাদ কি, কারা জঙ্গী কেন হয়, সেসব বিষয়ে জনগণ তেমন অবহিত নয়। জঙ্গীরা যে আশপাশে অবস্থান করছে, তাও তেমন স্পষ্ট নয়। এ সম্পর্কে কোন প্রচার-প্রচারণা নেই। ফলে জনগণ এ ব্যাপারে অজ্ঞ থেকে যাচ্ছে। তেমনি জঙ্গীবাদ সম্পৃক্ত হওয়া তরুণদের বিপথগামী হওয়ায় পথ থেকে ফেরানো বা তাদের সচেতন করে তোলার কোন কাজই হয়নি। যে কারণে দেখা যাচ্ছে, প্রাইভেট ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা জঙ্গী সংগঠনগুলোতে নাম লেখাচ্ছে। ব্লগার হত্যায়ও ছাত্ররা জড়িত। নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহ্রীর সদস্য খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। গত সপ্তাহে নিষিদ্ধ সংগঠনটির প্রচারপত্র ও সিডি বিতরণের অভিযোগে পাঁচ ছাত্রকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ ছাত্র আটকে রয়েছে ব্লগার হত্যার অভিযোগে। এদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় পাঁচ কোটি তরুণ। এই জনগোষ্ঠী প্রান্ত পথে পরিচালিত হওয়া মানেই বিপদ ঘনিয়ে আসা। ধর্মীয় উন্মাদনা তৈরি করে জঙ্গীবাদীরা শিক্ষিত তরুণদের তাদের জেহাদী কাজে ব্যবহার করে আসছে। উন্নত প্রযুক্তিতে শিক্ষিতরা কেন জঙ্গীবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে, তার কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না। সরকারও বিষয়টিতে নজর দিচ্ছে, তাও নয়। মস্তিষ্ক শোধন কী ধরনের হলে এইসব মেধাবী তরুণরা মানুষ হত্যার মতো চেতনা ধারণ করে, স্বর্গপ্রাপ্তির স্বপ্নে বিভোর হতে পারে। বোমাবাজিতে সিদ্ধহস্ত হতে পারে। তার মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাও জনগণকে জানানো প্রয়োজন। যেসব পিতামাতার সন্তানরা বিপথে চলে যাচ্ছে, সে অভিভাবকদের সচেতন করার কাজটিও করা হয় না। তাদের অগোচরেই সন্তান চলে যাচ্ছে জঙ্গীবাদেও পথ ধরে, যে পথ হতে নেই ফেরার উপায়। জঙ্গীবাদী গোষ্ঠীর টার্গেটে পরিণত হচ্ছে বেকার কিন্তু শিক্ষিত সমাজও। এদের স্বাভাবিক জীবনধারা বিচ্যুত হওয়ার পথগুলো বন্ধ করা জরুরী। জঙ্গী সংগঠন নিষিদ্ধ করা মানেই তৎপরতা বন্ধ, তা নয়। সাইনবোর্ড বদলে তারা ভিন্ন নামে মাঠে নামছে। সংগঠন নিষিদ্ধ, কিন্তু কর্মীরা সক্রিয় থাকছে। তারা ক্ষমতাসীন বা বিরোধী দলে অনুপ্রবেশ করে অবস্থান বজায় রাখলেও সে খতিয়ান কেউ রাখে না। সংগঠন নিষিদ্ধের পাশাপাশি, সদস্যদের কর্মকা- বন্ধ করার উপায় ও উদ্ভাবন জরুরী। জঙ্গী সদস্যদের যে ব্রেনওয়াশ করা হয়েছে, তা শোধন করা না গেলে ফল শূন্যই হবে। এদের মধ্যে স্বাভাবিক মনুষ্যত্ব বোধ জাগ্রত করা, দেশপ্রেমের ধারায় ফিরিয়ে আনার কাজটিও জরুরী। প্রয়োজনে সংশোধনাগার চালু করা যেতে পারে। এদের চেতনা ও মনস্তাত্ত্বিক জগতে পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রটি তৈরি করা না গেলে এদের ভারে সমাজ প্রগতি বিনষ্ট শুধু নয়, গণহত্যা, নাশকতা, হানাহানি, সহিংসহার প্রকোপে সবকিছু ধ্বংস হওয়ার উপক্রম হবে। এই তরুণদের নিয়ে ভাবতে হবে। জঙ্গীবাদ নির্মূলে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা দরকার, খুব দ্রুত এদের নির্মূল করা যাবে, তা নয়। বিষয়টি সময়সাপেক্ষ। তাই দরকার যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ। সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ মোকাবেলায় বৃহত্তর সংলাপে বাংলাদেশ সম্পৃক্ত হতে যাচ্ছে। বিভিন্ন পন্থায় চরম সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় একটি বৈশ্বিক সিদ্ধান্ত হতে যাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই সংলাপের আয়োজক, সমাজব্যবস্থা থেকে চরম জঙ্গীবাদ দমনে এ ধরনের বড় সংলাপে সম্পৃক্ত হয়ে বাংলাদেশ লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বেগম জিয়ার রাজনৈতিক দল বিএনপি যে জঙ্গীদের দ্বারা আচ্ছন্ন তা বোঝা যায়, মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি সারাহ পোলের সাম্প্রতিক বক্তব্যে। তাঁর মতে, জঙ্গীবাদীদের আদর্শের দ্বারা যে সহিংসতার প্রচার হয়, তা হয়ত অনেক বিবেচনায় সন্ত্রাসবাদ হিসেবে বিবেচ্য হয় না। তবু এটা সমাজ ও মানুষকে একটা চরম ঝুঁকির সম্মুখীন করে। আর এটা রাজনৈতিক ভিত্তিতে ঘটতে পারে, যা কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং এটা যে বাংলাদেশে ঘটছে রাজনীতির ভিত্তিতে এবং ছত্রছায়ায় তা ২০১৩ হতে ২০১৫ সময়ে নাশকতা ও গণহত্যাকালেই স্পষ্ট হয়েছে। যার রেশ এখনও রয়েছে। ধর্ম ও জঙ্গীবাদকে এদেশে একত্র করে ফেলা হয়েছে। মূলত জঙ্গীবাদের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা না গেলে তাদের নির্মূল বাধাগ্রস্ত হবেই। ধর্মীয় অনুশাসনের নামে জঙ্গীবাদে সামাজিক উন্নয়নও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সহিংসতা, নির্যাতন, হত্যা এবং জঙ্গীবাদ বন্ধ না হলে উন্নয়ন করা সম্ভব নয়। দেশের সব নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। সেই নিরাপত্তা বিঘœ হলে তার বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করা ও অপরাধীকে শাস্তি দেয়ার দায়িত্ব সরকারের ওপর অর্পিত রয়েছে। এই দায়িত্ব পালনে সরকারের আর যাই হোক ব্যর্থতার পরিচয় দিতে পারে না। তাই বেগম জিয়ার পেট্রোলবোমা পুলিশ মেরেছে বলে যে বক্তব্য দিয়ে আসছেন, তার বিপরীতে সরকার কোন দলিল-দস্তাবেজ প্রকাশ করছে না। অথচ জনগণকে জানান দিতে প্রয়োজন হয়ে পড়েছে গণহত্যা, জঙ্গীবাদ ও নাশকতার ওপর শ্বেতপত্র প্রকাশ। সংসদীয় সরকার ব্যবহার সংসদও পারে এই শ্বেতপত্র প্রকাশে উদ্যোগী হতে। জনগণ জানতে পারবে নাশকতার পেছনের রহস্যসহ মানুষ হত্যার বিবরণ। আমরা স্মরণ করতে পারি। মুক্তিযুদ্ধকালে দখলদার পাকিস্তান সরকার ‘ইস্ট পাকিস্তান ক্রাইসিস : হোয়াট হ্যাপেন্ড’ শীর্ষক একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছিল। হাজার খানেক পৃষ্ঠার এই শ্বেতপত্রে আওয়ামী লীগ ও ভারতে সরকারকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। ইংরেজী ও উর্দু ভাষায় প্রকাশিত এই শ্বেতপত্রে অনেক সত্য-মিথ্যা এবং কথামালার ফুলঝুড়ি ছড়ানো হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ২ মার্চ থেকে আওয়ামী লীগের অসহযোগ আন্দোলনকে পাকিস্তানী নিধনের আন্দোলন হিসেবে বলা হয়েছে। এই শ্বেতপত্র দেশে বিদেশে প্রচার করা হয়েছে। আবার ১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে সামরিক জান্তা জিয়া ক্ষমতা দখলের পর আওয়ামী লীগের ওপর শ্বেতপত্র শুধু নয়, বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের মালামালের ওপরও শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছিল, যা ছিল মিথ্যাচারে পূর্ণ। ২০০১ সালে বিএনপি জামায়াতের নারকীয় কর্মকা-ের ওপর তদন্ত করলেও সে রিপোর্ট প্রকাশ করেনি এবং জনগণ জানতেও পারেনি কী ঘটেছিল। এই তথ্যপ্রযুক্তির যুগে দেশ ও জনগণের স্বার্থে প্রকাশ করা উচিত জঙ্গী নেত্রী খালেদা-জামায়াতের গণহত্যা পরিচালনার ওপর শ্বেতপত্র। তা প্রকাশ করা গণতান্ত্রিক সরকারের অবশ্য কর্তব্য।
×