ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

অনুবাদ : এনামুল হক

সৌদি আরব মধ্যপ্রাচ্যের শীর্ষ শক্তি হতে চায়!

প্রকাশিত: ০৬:৫৫, ১০ জুলাই ২০১৫

সৌদি আরব মধ্যপ্রাচ্যের শীর্ষ শক্তি হতে চায়!

মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে সৌদিদের মাথায় সত্যিকারের কী পরিকল্পনা খেলছে, কেউ জানে না। এ নিয়ে কোন ভবিষ্যদ্বাণী করার মতো সময়ও আসেনি বলে কোন কোন পর্যবেক্ষক মনে করেন। তবে একটা ব্যাপারে কূটনীতিক মহল একমত। তা হলো, সৌদি আরবের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো শীর্ষ আঞ্চলিক শক্তি হওয়া এবং তার জন্য অন্য কোন রাজনৈতিক বা সামরিক অস্ত্রকে ব্যবহার করার চাইতে বরং অর্থকে কাজে লাগানো। পাশ্চাত্যের এক কূটনীতিক সম্প্রতি বলেছেন, ইয়েমেনে সৌদি আরব আজ প্রক্সিযুদ্ধে নিয়োজিত। সেখানকার লড়াই রিয়াদের কোন স্ট্র্যাটেজিক লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি, বরং তা আল কায়েদাসহ র‌্যাডিক্যাল ইসলামী সংগঠনগুলোর হাত শক্তিশালী করে তুলেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই লড়াই চলতে থাকবে। কারণ এটা সৌদিদের জাতীয় অহঙ্কারের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া এই লড়াই সৌদি প্রাসাদ রাজনীতিরও অংশ। কারণ এতে করে সৌদি বাদশাহর পুত্র ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোহাম্মদ বিন সালমানের হাত শক্তিশালী হয়ে উঠছে। গত কয়েক বছর রিয়াদে কাজ করেছেন এমন বিদেশী কূটনীতিকদের চোখে এ অঞ্চলে সৌদি পররাষ্ট্রনীতির গতিপথের পরিবর্তন ধরা পড়েছে। তারা বলেন, এই পরিবর্তন অনিবার্য। কারণ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ইরানের একঘরে অবস্থার অবসান ঘটতে যাচ্ছে এবং পরমাণু কর্মসূচী নিয়ে তেহরান ও পাশ্চাত্যের মধ্যে একটা সমঝোতা এখন অত্যাসন্ন। তাছাড়া সৌদিদের প্রাসাদ রাজনীতি সেভাবে খেলে চলেছে, সেটাও পরিবর্তনের একটা কারণ। কূটনীতিকদের মতে, মোহাম্মদ বিন সালমান এমন এক ব্যক্তি, যার হাতে কলকাঠির কার্যকর নিয়ন্ত্রণ আছে, যদিও রিয়াদের পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য নির্ধারণে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন নায়েফও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। উইকিলিকসের ফাঁস করা সৌদিদের গোপন নথিতে এ অঞ্চলে রিয়াদের উচ্চাভিলাষ সম্পর্কে নতুন কিছু জানার অবকাশ নেই। সবাই জানে যে, আরব বসন্তকে সৌদিরা ঘৃণার চোখে দেখে এবং যে কোন মূল্যে সেটাকে ধ্বংস করে দিতে চায়। তিউনিসিয়ার মিডিয়ার অবকাঠামো উন্নয়নে সৌদিদের বিনিয়োগ করা এবং তিউনিসিয়ায় সাংবাদিকদের সঙ্গে খায়খাতির জমানোর পরিকল্পনায় অবাক হওয়ার কিছু নেই বলে এক কূটনীতিক মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, আরব বসন্তে ক্ষমতা থেকে উৎখাত হওয়া প্রথম আরব শাসক তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট জয়নাল আবেদিন বেন আলীকে আশ্রয় দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল সৌদি আরব। ২০১১ সালের প্রথম দিকে মিসরের ২৫ জানুয়ারির গণঅভ্যুত্থানের প্রাক্কালে তারা এই প্রস্তাব দিয়েছিল। বেন আলী এখনও সৌদি আরবেই আছেন। উইকিলিকসের ফাঁস করা তারবার্তা থেকে দেখা যায় যে, বেন আলী উৎখাত হওয়ার চার মাসেরও কম সময়ের পর ক্ষমতাচ্যুত মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক যাতে জীবনের বাকি দিনগুলো সৌদিদের অতিথি হিসেবে কাটাতে পারেন, তার জন্য রিয়াদ জোর প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। জানা গেছে যে, মোবারকের ব্যাপারে রিয়াদের অবস্থানের তেমন কোন পরিবর্তন ঘটেনি। মিসরের এক অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, ‘সৌদিদের সেই প্রস্তাব এখনও আছে যদিও সেটা প্রস্তাব হওয়ার যোগ্যতা রাখে কিনা, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। সৌদিরা মিসরকে সর্বাত্মক সমর্থন দেয়ায় এই প্রস্তাবটা এখন ইচ্ছার চেয়ে বেশি কিছু। এই ইচ্ছাটা সাগ্রহে ব্যক্ত করা হচ্ছে এবং মোবারকের বিচার যেভাবে চলছে, তার প্রেক্ষাপটে ওটা মঞ্জুর হওয়া থেকে খুব দূরে বলে মনে হয় না।’ কূটনীতিকরা বলেন, বেন আলীকে আশ্রয় দেয়া ও মোবারককে সমর্থন দেয়ার মধ্য দিয়ে রিয়াদ এই বার্তা পাঠিয়ে দিতে চায় যে, সৌদি আরব এমন এক আঞ্চলিক শক্তি যা মিত্রদের কখনও পরিত্যাগ করে না। এক কূটনীতিক বলেন, মিসরের জানুয়ারি বিপ্লবের প্রথম দিকের দিনগুলোর খবর যদি উইকিলিকসের নথিতে থাকত, তাহলে মোবারককে রক্ষা করার জন্য সৌদি হস্তক্ষেপের কিছু অবিশ্বাস্য বিবরণ পাওয়া যেত। এ অঞ্চলে সৌদিদের অগ্রাধিকারের কি কোন পরিবর্তন ঘটেছে? এমন প্রশ্ন জাগ্রত হওয়া স্বাভাবিক। এটা ঠিক যে, সৌদিরা তাদের মিত্রদের দ্বারা শাসিত দেশগুলোতে আরব বসন্তের আবির্ভাব ঠেকাতে পারেনি। অন্যদিকে সিরিয়ার মতো দেশগুলোর গণঅভ্যুত্থানের সুযোগে সৌদিদের অপছন্দের শাসকদের সরিয়ে দিতেও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। তথাপি সৌদি আরব যেভাবে তার স্বার্থকে দেখে থাকে, সেই দৃষ্টিভঙ্গিতে এক ফোঁটাও পরিবর্তন ঘটেনি বলে অনেক কূটনীতিক মনে করেন। তাদের মতে, সৌদি শাসকগোষ্ঠীর লক্ষ্য বরাবরই হলো তাদের শাসনের প্রতি যে কোন হুমকি এড়িয়ে চলা। আর তার অর্থই হলো পরিবর্তনের পথ বন্ধ করে দেয়া। কূটনীতিকরা একটা ব্যাপারে একমত। তা হলো, আরব বসন্তের প্রতি সৌদি শাসকদের ভয়ঙ্কর রকমের ঘৃণা। আরব বসন্তের উদ্দেশ্য ছিল পরিবর্তন আনা এবং এই পরিবর্তন এমন এক শব্দ যেটিকে সৌদি শাসকরা ঘৃণার চোখে দেখে। অনেকটা একই কারণে সৌদিরা বিশাল শিয়া জনগোষ্ঠী আছে, এমন সুন্নি শাসিত দেশগুলোতে যেমন, বাহরাইনে অর্থ ঢালছে। ইরাক আগে সুন্নি শাসিত ছিল, এখন নেই। তথাপি সেখানকার সুন্নিদের অর্থ জোগাচ্ছে রিয়াদ। তেমনি অবস্থা লেবাননেরও। অন্যদিকে ইরান যাতে উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোকে কাছে টেনে না নিতে পারে, তার জন্য রিয়াদের দিক থেকে এই দেশগুলোর ওপর বিরামহীন চাপ আসছে। উইকিলিকসের ফাঁস করা সৌদি নথি থেকে এ ধরনের একটা কিছু নিশ্চিতরূপে জানা যায়। এক কূটনীতিক বলেন, লিবিয়াসহ উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোতে ইন্নাহাদা ও মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো সুন্নি রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার জন্য সৌদিরা মিসরের হাত দিয়ে বিপুল অঙ্কের টাকা ঢালছে, যদিও মিসরীয়রা তা স্বীকার করতে চাইবে না। এক মিসরীয় কূটনীতিক স্বীকার করেন যে, মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতি সৌদিদের আগের মনোভাব বা ভূমিকার পরিবর্তন কতখানি হচ্ছে, সে ব্যাপারে কায়রো যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। তিনি বলেন, ‘রিয়াদের ভাবগতিক নিয়ে আমরা খানিকটা অস্বস্তিতে আছি। পাশ্চাত্যের কূটনীতিকদের মতে, পরমাণু প্রশ্নে পাশ্চাত্যের সঙ্গে ইরানের সমঝোতা আসন্ন। এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে সৌদি আরব একটা সুন্নি ফ্রন্ট গড়ে তুলতে বদ্ধপরিকর। তার জন্য যদি মুসলিম ব্রাদারহুডকে অংশীদার হিসেবে আনতে হয়, তাতেও তাদের আপত্তি নেই। সোজা কথায়, ইরানী-শিয়া প্রভাবের প্রসার ঠেকাতে সৌদিরা নতুন-পুরনো মিত্রদের নিয়ে একটা জোট গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। তার জন্য রিয়াদ লেবাননের রাজনৈতিক নেতৃবর্গকে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে এটা যেমন সত্য, তেমনি আবার অন্যত্র বিশেষ বিশেষ কুর্দি সংগঠনকে সৌদি অর্থ সহায়তা দেয়ার ব্যাপারটিও এখন ওপেন সিক্রেট। মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুড নেতাদের সঙ্গে রিয়াদের যোগাযোগের চ্যানেল খোলার ব্যাপারে কায়রো হয়ত খুশি নয়। তেমনি রিয়াদও সচেতন যে, এটা এমন এক ইস্যু যা অত্যন্ত সাবধানে নাড়াচাড়া করতে হবে। রিয়াদের নতুন মিত্র হিসেবে দেখা দিয়েছে তুরস্ক। তুরস্ককে ধরে রাখার প্রয়োজনে সৌদিরা কুর্দিদের সঙ্গে একত্রে কাজ কারবারের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতার সম্মুখীন হয়েছে। সৌদি আরবের ঝানু পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন সৌদ আল-ফয়সল। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন আদেল আল-জুবায়ের। এই রদবদলের প্রেক্ষাপটে সৌদি পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পুনর্মূল্যায়ন করে দেখা হবে, এটাই প্রত্যাশিত। সৌদিদের দৃষ্টিতে ২০১১ সালের পর থেকে যে অঞ্চলটিতে ইতোমধ্যে বিপর্যয়কর পরিবর্তন ঘটে গেছে এবং ইরানের তিন দশকের কূটনৈতিক একাকিত্বের অবসানের মধ্য দিয়ে যে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ আবির্ভূত হয়েছে, তেমন এক অঞ্চলে নিজের কূটনৈতিক লক্ষ্যসমূহ সর্বোত্তম কি উপায়ে অর্জন করা যায়, সেটাই এখন বিবেচনা করে দেখছে রিয়াদ। কূটনীতিকরা মনে করেন যে, নিজের আধিপত্য বজায় রাখা ও প্রসারিত করা এবং তেহরানের প্রত্যাবর্তন ও তার আরব মিত্রদের সম্ভাব্য ক্ষমতায়নের কারণে যে কূটনৈতিক ক্ষতি হতে পারে, তা সীমিত করার জন্য নয়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী আল-জুবায়ের রিয়াদের স্ট্র্যাটেজিতে নতুন তাগিদ সঞ্চার করেছেন। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সৌদি আরব উত্তরোত্তর অসহিষ্ণু ও অধৈর্য হয়ে উঠছে। সূত্র : আল-আহরাম উইকলি
×