স্টাফ রিপোর্টার ॥ গ্যালারিতে ঢুকেই চোখে পড়বে এক প্রান্তিক নারীর ছবি। ভাঙ্গা খড়ের ঘরের মধ্যে হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে আছে। ঘরের বেড়ার অর্ধেক বন্যার পানিতে ডুবে গেছে। নির্বাক তাকিয়ে যেন বাঁচার প্রহর গুনছে। এরপর চেখে পড়বে পলিথিন দিয়ে ঘেরা অসহায় নারী ও শিশুর ছবি। বন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে গেছে ঘরবাড়ি। কোনমতে জীবন বাঁচানোর তাগিদে পলিথিন দিয়ে ঢেকে বৃষ্টি থেকে রেহাই পাওয়ার নিষ্ফল চেষ্টা। নদীর পাশে দাঁড়িয়ে আর এক গ্রাম্য রমণী। প্রবল স্রোতে নদী উত্তাল। বন্যা পরবর্তী নদী ভাঙ্গনে ঘরবাড়িশূন্য। কোথাও ভিটেটুকুরও চিহ্ন নেই। রমণী শুধু তাকিয়ে আছে নদীর স্রোতের দিকে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় ২০০৭ সালের বন্যার এক ভয়াবহ চিত্র ক্যামেরায় ধারণ করেছেন আলোকচিত্রী আবীর আব্দুল্লাহ। দেশের গ্রাম্য অঞ্চলে ঘটে যাওয়া বন্যার এই সকল চিত্র নিয়ে রাজধানীর বনানীতে চলছে আবীর আব্দুল্লাহর ‘নী ডীপ’ শীর্ষক একক আলোকচিত্র প্রদশনী।
‘লঙ্গিটিউড ল্যাটিটিউড সিক্স’ শীর্ষক চার মাসব্যাপী শিল্প প্রদর্শনীর অংশ হিসেবে বে ডেভেলপমেন্টের নতুন গ্যালারি বে বেলাভিস্তায় ১১ দিনব্যাপী এ প্রদর্শনীর আয়োজন। ‘লঙ্গিট্যুড ল্যাটিট্যুড’Ñএমন একটা শিল্প প্রদর্শনী যা প্রতিবারই ভিন্ন ভিন্ন ভেন্যুতে আয়োজিত হয়। এই প্রদর্শনীর মূল ভাবনা হলো ‘যে কোন জায়গাই শিল্প প্রদর্শন কিংবা উপভোগের জন্য একটি ভাল জায়গা হতে পারে। ২০০৩ সাল থেকে কিউরেটর শেহ্জাদ চৌধুরী এবং তার সহযোগীরা মিলে এ প্রদর্শনীর আয়োজন করে আসছে। এর আগে রাজধানীর বিভিন্ন গ্যালারিতে এই ধরনের ৫টি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে।
আবীর আব্দুল্লাহর একক প্রদর্শনীতে উপস্থাপিত হয়েছেÑ জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে দেশের উপকূলীয় অধিবাসীদের জীবন-সংগ্রামের গল্প নিয়ে তোলা বিভিন্ন প্রকার আলোকচিত্র নিয়ে পোর্টেট সিরিজ। পুরো প্রদর্শনীতে প্রকাশ পেয়েছে যেন এক বাস্তব ও নির্বাক কাব্যময়তা। প্রদর্শনী প্রসঙ্গে আবীর আবদুল্লাহ বলেন, বাংলাদেশে বসবাস প্রাকৃতিক নানা কারণে কখনই খুব সহজ নয়। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনার সঙ্গমে-গঙ্গার বদ্বীপে বাংলাদেশের অবস্থান। প্রতি বছর বর্ষায় বন্যার সম্ভাবনা থাকে। সাইক্লোন আর টর্নেডোর মতন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হয় উপকূলবাসী। বন্যার সময়ে উপকূলবর্তী সমগ্র অঞ্চল হাঁটু পানিতে ডুবে যাওয়া খুবই সাধারণ ঘটনা। এ সকল ঘটনা বৈশ্বিক উষ্ণতারই ফলাফল-এ সম্পর্কে বিস্তারিত গবেষণা এখন পর্যন্ত না হয়ে থাকলেও, সকল গবেষণাপত্রেই এর ইঙ্গিত থাকে যে বাংলাদেশের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য প্রভাব। একটি দেশ যার অধিকাংশ মানুষ কোনদিন গাড়ি ব্যবহার করেনি, কখনও এয়ার-কন্ডিশন ব্যবহার করেনি সেই মানুষগুলোকেই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের শিকার হতে হচ্ছে এবং তারা তার মোকাবেলা করে চলেছে।
প্রদর্শনীর সব ছবিতে আলোকচিত্রী নারীকে প্রাধান্য দিয়েছেন। একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে ঘরের ভেতর প্রায় কোমর সমান পানিতে দাঁড়িয়ে আছে এক নারী। শরীর পানিতে ভেজা। একচালা ঘর ধসে পড়ার উপক্রম। অন্য একটি ছবিতেও জলমগ্ন ঘরে এক আধাবয়সী নারী। একটিতে দেখা যাচ্ছে বন্যার পানিতে তলানো ঘরের মধ্যে খাটের ওপর বসে আছে মা তার শিশুকে কোলে নিয়ে। ছবিগুলোর মধ্যে বাস্তবতার নিষ্ঠুরতা থাকলেও সাহসিকতার ছাপও কোন কোন ক্ষেত্রে বিদ্যমান। নারীরা যে সাহসী, শত প্রতিকূলতার মধ্যে তাঁকে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে হয়, এর ছাপ পড়েছে প্রতিটি ছবিতে। বন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া ঘরবাড়িতে খাবার খেয়ে বেঁচে থাকার মতো পরিস্থিতি যে থাকে না, এটা প্রকাশ পেয়েছে এক নারীর হাঁড়ি-পাতিল নিয়ে খাটের ওপর বসে থাকার দৃশ্যটিতে। ঘরে ডুবন্ত খাটের সঙ্গে রয়েছে নৌকা বাঁধা। ঘরের হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে এক নারীর নির্লিপ্ত চাহনী তাঁকে বেঁচে থাকার সাহস যুগিয়ে চলেছে। এক কিশোরী ঘরের মধ্যে কোমর পানিতে দাঁড়িয়ে আছে। এক বৃদ্ধা পানিভর্তি ঘরের এক খাটে বসে আছে হতাশা নিয়ে। এমনি সব দুর্লভ চিত্র তাঁর ক্যামেরায় তুলে এনেছেন আবীর আব্দুল্লাহ।
একজন ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফার হয়েও আবীর আব্দুল্লাহ শিল্পের মধ্যের কাব্যময়তাকে এড়িয়ে চলেন না। যেমনটি ছিল তাঁর সহোদর কবি রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর। আলোকচিত্রী আবীরের ছবিতে ফুটে ওঠে সেই সব মানুষেরই গল্প যাদের জীবন কোন না কোনভাবে তাঁকে আন্দোলিত করেছে। বিগত ৫ বছর ধরে তিনি বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প, বিল্ডিং ধস এবং আগুন লাগার মতন ভয়াবহ বিপর্যয়ের সময়কালীন এবং তার পরবর্তী সময়ের ওপর কাজ করছেন।
প্রদর্শনীটি চলবে আগামী ১৪ জুলাই পর্যন্ত। সকলের জন্য উন্মুক্ত এই প্রদর্শনীটি প্রতিদিন দুপুর ১২টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকবে।