ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শিকড়ে ফেরা, না ফেরা

প্রকাশিত: ০৪:১০, ৯ জুলাই ২০১৫

শিকড়ে ফেরা, না ফেরা

রহমান তৌহিদ বাসা আর বাড়ির পার্থক্য বুঝিয়েছিলেন এক বন্ধু। বাড়ি হলো নিজের বাড়ি অর্থাৎ স্থায়ী ঠিকানা; যদিও স্থায়ী বলে কিছু আছে কিনা সে বিতর্ক থেকেই যায়। আর বাসা হলো ভাড়া বাসা- অস্থায়ী। আজ এখানে কাল ওখানে। সেই অস্থায়ীকে স্থায়ী করতে ঢাকা শহরে কেউ বানালেন বাড়ি, কেউ কিনলেন ফ্ল্যাট। হোল্ডিং নম্বর হলো। ঘরের দরজায় টানালেন : হোম, সুইট হোম। ঈদের ছুটিতে যাওয়া হয় গ্রামে। বৃদ্ধ মা বাবা দেখতে চায় পুত্র-পুত্রবধূ, নাতি-নাতনি। বিপুল উৎসাহে সেহরি খেয়ে লাইনে দাঁড়ায় বাসের টিকেটের জন্য। মার্কেট ঘুরে কেনা হয় উপহার সামগ্রী। তারপর একদিন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত অপেক্ষা বাস কাউন্টারে। দীর্ঘ যানজট পেরিয়ে খানাখন্দ ভরা রাস্তার ঝাঁকি খেয়ে এক সময় পৌঁছে গ্রামে। মায়ের মমতামাখা মুখ সব ভুলিয়ে দেয়। আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষা, বাল্যবন্ধুর সঙ্গে আড্ডা আর স্কুলের শিক্ষকের উপদেশ শুনে গ্রাম গড়ার শপথ নিয়ে ফিরে আসা। সময় বয়ে যায় বহতা নদীর মতো। সন্তান বড় হয়, বড় হয় তাদের জগত। মা- বাবা গত হন, ক্ষীণ হয় পারিবারিক বন্ধন। তারপরও যাওয়া হয় শিকড়ের টানে। একা। যানজট পেরিয়ে নয়, অসময়ে প্রাইভেট কারে। ঘর মানে কি? ঘর কি শুধু বস্তুগত এক জায়গা? না, ঘর হলো প্রিয়জনের স্পর্শ। ঘর হলো আশপাশের মানুষকে নিয়ে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন। ঘর হলো আগামীর স্বপ্নে ভরা দু’চোখ। ‘আগামী ঈদে অবস্থার উন্নতি হবে’ ভাঙ্গা রেকর্ডের মতো একই প্রতিশ্রুতি। বাঙালীর দুর্ভোগ ঘোচে না। তবুও সব দুর্ভোগ হাসিমুখে বরণ করে ঘরে ফেরে বাঙালী। আর শিকড়হীন কিছু মানুষ একসময় টিভি পর্দায় মানুষের ভোগান্তি দেখে সান্ত¡না খোঁজে : না গিয়েই ভাল করেছি। শাহবাগ, ঢাকা থেকে সঙ্কটের সমাধান বেনজীর পায়েল ঘুরে ফিরে যাহা ৫২ তাহাই ৫৩। ঈদের ছুটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে, তাই ঈদে ঘরে ফেরা মানেই যেমন আনন্দ তেমনি বাস টার্মিনাল, রেলস্টেশন, লঞ্চঘাট, ফেরিঘাটের যানজটের কথা ভাবলেই শঙ্কা। একসঙ্গে এত মানুষ! এত যানবাহনের চাপ, তবু মানুষ উর্ধশ্বাসে ছোটে প্রিয়জনদের সঙ্গে ক্ষণিক আনন্দ ভাগাভাগি করার জন্য। কিন্তু কয়জনের কপালে জোটে এ আনন্দ। ঘরে ফেরা তো দূরের কথা, ঈদগাহে গিয়ে ঈদের জামাতে শামিল হওয়া থেকে বঞ্চিত হতে হয় অনেক যাত্রীর। বেড়ে যায় যানবাহনগুলোর ভাড়া। অল্প আয়ের মানুষরা চিন্তায় পড়ে। পরিবারের কেনাকাটা যদিও ফুটপাথে সেরে ফেলে; কিন্তু টিকেট তো মানে না উঁচুতলা নিচুতলার ব্যবধান। তাই যাত্রীরা শত কষ্টে টিকেট কেটে এক বুক আশা নিয়ে ঘরে ফেরে একটু হলেও পরিবারের মুখে হাসি ফোটাবে বলে। যানবাহনের সংখ্যা সরকার সাময়িক বাড়িয়ে দিলেও তা ঘরে ফেরা মানুষের তুলনায় অতি সামান্য। দেশের মানুষকে আর কত সীমিত আয়, সীমিত যানবাহন, সীমিত রাস্তাঘাট ইত্যাদি সীমিত কথাটির নিচে পিষ্ট হতে হবে? কতকাল কতযুগ বলতে পারেন কেউ? প্রতিবছর ঈদ এলেই যানজটের কাহিনী আর ভারি করা হয় পত্রিকার পাতা। ঈদ শেষ, ভাবনাও শেষ। এটা তো সমাধান নয়। দেশের এত বড় বড় সঙ্কটের সমাধান হয়। তবে ঈদে ঘরে ফেরা বিড়ম্বনার কেন অবসান হয় না? কুড়িগ্রাম থেকে বাস্তবতার ছোঁয়া শওকত আরা বেগম ‘তুমি, আমি আর আমাদের সন্তান’Ñ নাগরিক জীবনের এই চালচিত্র হঠাৎ বদলে যায় ঈদ আনন্দ ঝড়ে। শুরু হয় শেকড়ের টানে ছুটে যাওয়ার তোড়জোড়। ফেলে আসা অজস্র প্রিয় মুখ আর মুহূর্তকে ক্ষণিকের ক্যানভাসে আটকে রাখার সুবর্ণ সুযোগ ঈদ। তাই চল সবাই গ্রামে। কিন্তু আবেগের তাড়নায় ছুটে যাওয়া এখন আর সহজ নয়। আবেগের সঙ্গী এখন বহুমাত্রিক দুর্ভোগ। ছোট ও দরিদ্র দেশ। সীমাবদ্ধ সুযোগ। তাই সবকিছুই অপ্রতুল। শুধু অপ্রতুল নয় জনসংখ্যা এবং দুর্নীতিবাজ, কালবাজারি ব্যবসায়ীরা। তাই বিঘিœত হয় চাওয়া-পাওয়ার হিসেবটা। টিকেট না পাওয়া, বেশি দামে কেনা, দীর্ঘ যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকাÑ এটা এখন স্বাভাবিক ঘটনা। আবেগের এই প্রবল বেগকে আটকানোর কোন উপায় না পেলে দুর্ভোগের তীব্রতা কোন শব্দ দিয়ে সম্ভবত নিরূপণ করা যাবে না। নানা দুর্ভোগ আর অনিশ্চয়তায় ইচ্ছেগুলো ক্লান্ত-শ্রান্ত আর ধূসর হয়ে যায়। অবশিষ্ট থাকে শুধু দীর্ঘদিনের চলে আসা রীতি-রেওয়াজ। এটি বিস্ময়কর যে চারশো বছরের পুরনো ঢাকা কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা, শিক্ষা, চিকিৎসা, শিল্প-সংস্কৃতি, ব্যবসা-বাণিজ্যের আর বিলাসী জীবনের সব উপকরণ দিলেও তার বুকে প্রোথিত হয়নি নাগরিকদের শেকড়। উৎসবকে তো আর বাদ দেয়া যায় না, অস্বীকার করা যায় না শেকড়ের টানকে। তাই প্রয়োজন ছোট্ট একটু ত্যাগ, একটু পরিবর্তন। সেই ত্যাগ ও পরিবর্তনের জন্য সমাজচিন্তাবিদদের পথ দেখাতে হবে। মোহাম্মদপুর, ঢাকা থেকে দুর্ভোগ লাঘব হোক শাহ্ আলম বাচ্চু ঈদ মানে খুশি, ঈদ মানে আনন্দ। এই আনন্দ ও খুশি ভাগাভাগি করতে প্রতিবছর নাড়ির টানে মানুষ ছুটে যায় নিজ নিজ আপন গন্তব্যে। একঘেয়েমি ও ক্লান্তিকর জীবন থেকে ছুটি নিয়ে ক’টা দিন আপনজনের সান্নিধ্যে কাটাতে মানুষ যায় শিকড়ের কাছে। কিন্তু সে জায়গায় যেতে পোহাতে হয় নানা দুর্ভোগ। ঈদের সময় ঘরে ফেরা মানুষের প্রচ- চাপ থাকে। তখন মানুষ ছোটে যেন উর্ধশ্বাসে। যানবাহনের ছাদ বাম্পার, দরজার হ্যান্ডেলে, ইঞ্জিন কভারে ট্রাকে মানুষ ঘরে ফিরতে চায়। বাস, ট্রেন, লঞ্চ, স্টিমার, ফেরিÑ কোথাও যেন তিল ধারনের ঠাঁই থাকে না। থাকে শুধু পদে পদে বিপদ উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা নানা প্রতারণা, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের জবরদস্তি আর অশেষ দুর্ভোগ ও ভোগান্তির দীর্ঘ খতিয়ান। ট্রেনের টিকেট তো সোনার হরিণ। দীর্ঘ সময়ে অপেক্ষার পর এই হরিণ ধরা দেয়। হাতে এলেও এর সিডিউল বিপর্যয় জীবনকে অতিষ্ঠ করে তোলে। কয়টার ট্রেন কয়টায় ছাড়ে তার খবর কে রাখে। ঈদে ঘরে ফেরার জন্য ট্রেনের ছাদে শিশু, তরুণ-তরুণী এমন কি বৃদ্ধ নারী-পুরুষকেও উঠতে হয়। কেউ কেউ আবার যাত্রী না হয়েও ট্রেনের সিট দখল করে রাখে। পরে সেই সিট ২০-৫০ টাকা বিক্রি করে পরের স্টেশনে নেমে পড়ে। লঞ্চের যাত্রাও একই অবস্থা। সিডিউল বিপর্যয় ও অতিরিক্ত যাত্রীÑ ঠাসাঠাসিভাবে ওঠানো, টিকেট নিয়ে চলে কালোবাজারি। যানবাহনের ভোগান্তি ও সঙ্কট মোকাবেলা করে আরও কিছু অনাকাক্সিক্ষত সমস্যা জীবনকে অসহনীয় করে তোলে। চুরি, ছিনতাই, অজ্ঞান ও মলম পার্টির হাত থেকে নিজেদের হেফাজতে রাখতে হয়। সকল প্রতিকূলতা পার করে যখন গাড়িতে উঠে বসি তখন পড়তে হয় মহাদুর্ভোগে। আর সেই দুর্ভোগ হলো যানজট। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অলস ও অসহ্য যন্ত্রণাময় সময় রাস্তার ধুলাবালি ও ভেঁপুর শব্দে কাটাতে হয়। এ যেন এক বিদঘুটে ও যন্ত্রণাময় পরিবেশ। কার কাছে কে বলবে এসব কথা। কারও কোন মাথাব্যথা নেই। সবাই বুঝছে নিজের লাভ। ক্ষতির খতিয়ান যেন ঈদের সময় বন্ধ। প্রশাসনের চোখ যেন অন্ধ, কান যেন বধির। তবুও যেতে হবে। তাই যাই ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে। তবে দুর্ভোগের দিকে সরকার ও প্রশাসনের নজর দেয়া অতি জরুরী। যাত্রীদের দুর্ভোগ লাঘব করে নিরাপদে ঘরে ফিরতে পারলেই সার্থকতা। আর তখনই দায়িত্ব পালনে হবে যথাযথ। মানবপ্রেম ও স্বদেশ প্রেমে আসবে পরিপূর্ণতা। রাধানগর, পাবনা থেকে
×