ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

তদন্তে পুলিশ ও কাস্টমস একে অপরকে দোষারোপ করছে

প্রকাশিত: ০৭:২৬, ৭ জুলাই ২০১৫

তদন্তে পুলিশ ও কাস্টমস একে অপরকে দোষারোপ করছে

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ চট্টগ্রাম বন্দরে ভোজ্যতেলের সঙ্গে মাদক তরল কোকেন আসার ঘটনার তদন্তে পুলিশ ও কাস্টমসের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সহযোগিতার ঘাটতি ঘটায় আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও সোমবার পর্যন্ত নতুন করে নমুনা সংগ্রহ করা যায়নি এবং জব্দ তালিকাও আদালতে পেশ করা সম্ভব হয়নি। এ ঘটনা নিয়ে গোয়েন্দা পুলিশের পক্ষে গঠিত ১০ সদস্যের কমিটি দুষছে কাস্টমসকে। আর কাস্টমস বলছে, পুলিশের পক্ষে সময়মতো না আসায় বন্দরে সিলগালা করে রাখা ড্রামগুলো থেকে আলামত সংগ্রহ করা যায়নি। এদিকে, এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত ৪ আসামিকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু এদের কাছ থেকে নতুন কোন তথ্য মিলেনি। আগে যা বলেছে তাই বলা হচ্ছে। তবে পুলিশ নিশ্চিত এ ঘটনার সঙ্গে গ্রেফতারকৃত খান জাহান আলী গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান প্রাইম হ্যাচারির ব্যবস্থাপক গোলাম মোস্তফা সোহেল ও ঢাকার গার্মেন্টস রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান ম-ল গ্রুপের বাণিজ্যিক নির্বাহী আতিকুর রহমান সরাসরি যুক্ত। সোহেল ভোজ্যতেলের এই চালান আনার ক্ষেত্রে জালিয়াতির মাধ্যমে খান জাহান আলী গ্রুপের প্যাড ও অন্যান্য কাগজপত্র সরবরাহ করেছে। আর আতিক এ ব্যাপারে সর্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করেছেন তার ব্যবহৃত ল্যাপটপে সংরক্ষিত তথ্য উদঘাটন করার পর নিশ্চিত হওয়া গেছে। তদন্তকারী সংস্থা সিএমপি গোয়েন্দা পুলিশের সংশ্লিষ্ট একটি অনুসন্ধানে দলের একটি সূত্র জানিয়েছে, যেহেতু এই ভোজ্যতেলের চালান প্রেরণের লন্ডনে বসবাসরত বাংলাদেশী নাগরিক বকুল মিয়া ও ভারতে অবস্থানরত রাজু নামে এক ব্যক্তি সরাসরি জড়িত তাদের গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ না করা পর্যন্ত এ চালানের মূল গডফাদারের পরিচয় উদঘাটন করা যাবে না। এরই মধ্যে গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃত ৪ জন যেসব তথ্য দিচ্ছে তাতে তদন্তে কোন অগ্রগতি হচ্ছে না। কেননা, গোলাম মোস্তফা সোহেল স্বীকার করেছে তিনি পণ্যটি আনার জন্য খান জাহান আলী গ্রুপের কাগজপত্র প্রতিষ্ঠানের মালিককে না জানিয়ে ব্যবহার করেছেন। আর আতিকও বলছেন লন্ডনে অবস্থানরত বকুল মিয়া এই ভোজ্যতেলের চালান ছাড়ানোর ক্ষেত্রে তার সহযোগিতা চাওয়ায় এতে সংশ্লিষ্ট হয়েছে। এ চালানে যে কোকেন রয়েছে তা তাদের সম্পূর্ণ অজানা। তবে তদন্তকারী দলের সদস্যদের সূত্রে জানানো হয়েছে, যেভাবেই হোক এই দুজন কোনভাবে পার পাবে না। কেননা, তাদের পক্ষে যে ভোজ্যতেলের এই চালান আমদানিতে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে তা প্রমাণ করতে যথেষ্ট তথ্য রয়েছে। এদিকে, এ সংক্রান্তে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার (উত্তর) মোঃ কামরুজ্জামান জানিয়েছেন, কাস্টমস ও শুল্ক গোয়েন্দাদের অনুপস্থিতির কারণে নতুন করে আলামত সংগ্রহ ও আলামত জব্দ করা যায়নি। এই অবস্থায় সোমবার বিকেলে পরবর্তী নির্দেশনা চেয়ে চট্টগ্রাম মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে আবেদন জানানো হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তা জানান, কাস্টমস ও শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে গেলেও তারা আবার কিছুই না জানিয়ে চলে যান। ফলে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে তার নেতৃত্বে পুলিশ দল ফিরে আসে। উল্লেখ্য, কাস্টমস শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরসহ উক্ত কন্টেনার সিলগালা করে দেয়ার সময় যে ৬টি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হাজির ছিলেন তাদের উপস্থিতিতে আলামত সংগ্রহ ও মালামাল জব্দের জন্য আদালতের নির্দেশনা রয়েছে। অপরদিকে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের যুগ্ম কমিশনার (জেটি) আশরাফুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, তদন্ত কর্মকর্তা তাদের একটি চিঠি দিয়েছে। চিঠিটি নিয়ে তারা কাস্টম কমিশনারের সঙ্গে পরামর্শ করতে যাওয়ার পর এই ফাঁকে তদন্তকারী পুলিশ সদস্যরা চলে যান। এমনকি ইতোপূর্বে সিলগালা করে দেয়ার সময় যেসব প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন তারাও ছিলেন না। উল্লেখ্য, গত রবিবার কোকেন সংক্রান্ত মামলা শুনানিতে আদালতের পক্ষ থেকে প্রশ্ন করা হয় মামলার নথিতে জব্দ তালিকা নেই কেন। এর জবাবে তদন্ত কর্মকর্তা সহকারী পুলিশ কমিশনার কামরুজ্জামান জানিয়েছেন, এ সংক্রান্ত আলামত চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে রয়েছে। কিন্তু কাস্টমসের প্রয়োজনীয় সহযোগিতার অভাবে জব্দ তালিকা করা যায়নি। এরপর মহানগর হাকিম ফরিদুল আলম কোকেন আটক সংক্রান্তে ও নমুনা সংগ্রহে জড়িত ৪ সংস্থাকে সহযোগিতা দিয়ে তদন্ত কার্যক্রম এগিয়ে নিতে নির্দেশ দেন। এদিকে, কোকেন নিয়ে মামলায় চট্টগ্রাম মহানগর আদালতে নির্দেশের উপর আপীল করতে সোমবার কয়েকজন কাস্টমস কর্মকর্তা মহানগর পিপি মোঃ ফখরুদ্দিনের সঙ্গে বৈঠক করলেও পিপি এতে সম্মতি দেননি। পিপি ফখরুদ্দিন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, কয়েকজন কাস্টমস কর্মকর্তা তার কাছে এসেছিলেন রিভিসনের জন্য। কিন্তু আমি এতে সম্মতি দেইনি। কারণ এতে চট্টগ্রাম মহানগর হাকিমের আদালতে কোন ত্রুটি নেই। উল্লেখ্য, গত ৬ জুন রাতে চট্টগ্রাম বন্দরে খালাস হওয়া ১০৭ ড্রাম ভর্তি সানফ্লাওয়ার ব্র্যান্ডের ভোজ্যতেল আটক করে সিলগালা করা হয়। পরবর্তীতে নমুনা সংগ্রহে একটি ড্রামে তরল কোকেনের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এরপর বন্দর থানায় এ সংক্রান্তে একটি মামলা দায়ের হয়। মামলায় ইতোপূর্বে গ্রেফতারকৃত প্রাইম হ্যাচারির ব্যবস্থাপক গোলাম মোস্তফাকে শোন এরেস্ট দেখানো হয়। এছাড়া খান জাহান আলী গ্রুপের চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদকে মামলার আসামি করার পর থেকে তিনি গা ঢাকা দিয়ে রয়েছেন। এরপর গোয়েন্দা পুলিশ ঢাকা থেকে আতিকুর রহমান, একে আজাদ ও মোস্তফা কামালকে গ্রেফতার করে। এদের পর থেকে ১০ দিনের রিমান্ডে রয়েছেন। এছাড়া গোলাম মোস্তফা সোহেল রয়েছেন ৫ দিনের রিমান্ডে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সিএমপি কমিশনারের নির্দেশে ১০ সদস্যের একটি অনুসন্ধানী টিম গঠিত হয়েছে। এই অনুসন্ধানী টিমের সঙ্গে জড়িতদের অনেকে জানিয়েছেন, এই কোকেন আনার নেপথ্যের শেকড় অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। তাই গ্রেফতারকৃত ৪ জনের কাছ থেকে আসল তথ্য উদঘাটন করা সম্ভব নাও হতে পারে। তবে এ জন্য স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড পুলিশের মাধ্যমে যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত বকুল মিয়াকে এবং ভারতে অবস্থানরত রাজুকে গ্রেফতারের জন্য ইন্টারপোলের সহায়তা চাওয়া হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে এদের আদৌ ধরা যাবে কিনা। উল্লেখ্য, দক্ষিণ আমেরিকা বলিভিয়া থেকে ভোজ্যতেলের সঙ্গে তরল কোকেন আসার পর ইন্টারপোলের তথ্যের ভিত্তিতে চট্টগ্রাম গোয়েন্দা পুলিশ শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে তা আটক করে সিলগালা করে। পরে চট্টগ্রামে দুটি ল্যাবে নমুনা পাঠানো হলে তাতে কোকেনের আলামত মিলেনি। পরবর্তীতে ঢাকায় পুনরায় আলামত পরীক্ষার পর দুটি ল্যাবে এর আলামত নিশ্চিত হয় শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ। কিন্তু বর্তমানে এর তদন্ত প্রক্রিয়ায় পুলিশ ও শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের মধ্যে এক ধরনের শীতল যুদ্ধ চলছে বলে প্রতীয়মান। শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ সূত্রে জানানো হয়েছে, তদন্ত এবং মামলা তাদের মাধ্যমে হওয়াটা বাঞ্ছনীয় ছিল। কিন্তু পুলিশ আগ বাড়িয়ে নিজে বাদী হয়ে এ মামলা কেন টুকে দিল তা তাদের অজানা। এ অবস্থায় কোকেন সংক্রান্তে মামলা তদন্ত সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবে কিনা তা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে।
×