ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পাল্টে গেছে ইলিশের মৌসুম, ধরা পড়ছে ঝাঁকে ঝাঁকে

প্রকাশিত: ০৭:২৪, ৭ জুলাই ২০১৫

পাল্টে গেছে ইলিশের মৌসুম, ধরা পড়ছে ঝাঁকে ঝাঁকে

শংকর লাল দাশ, গলাচিপা থেকে ॥ আকস্মিকভাবে এ বছর বঙ্গোপসাগরে ইলিশের মৌসুমের পরিবর্তন ঘটেছে। গত কয়েক বছরের রেকর্ড ভেঙ্গে মৌসুম এগিয়ে এসেছে অন্তত দুই মাস। ইলিশের আকার-ওজনেও এসেছে পরিবর্তন। বেড়েছে ইলিশের ব্যাপক উৎপাদন। মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তাদের এমন অভিমতের সঙ্গে উপকূলের প্রান্তিক পর্যায়ের সমুদ্রগামী জেলেরাও একমত পোষণ করেছেন। সরকারের নানামুখী উদ্যোগ-আয়োজনের কারণেই এমন অসম্ভব কাজ সম্ভব হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট সকল মহল। এদিকে, ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং মৌসুম এগিয়ে আসায় জেলেরা সাগরে নেমেছেন কোমর বেঁধে। ব্যবসায়ীরা আশা করছেন মোটা লাভের। জেলেপল্লীগুলোতেও লেগেছে আনন্দের ছোঁয়া। মৎস্য অধিদফতরের হিসাবমতে, দেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার থেকে শুরু করে দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তের সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাটসহ উপকূলের ১৬ জেলায় সমুদ্রগামী প্রায় সাত লাখ জেলে রয়েছে। এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আরও ২৫ লাখ মানুষ জড়িয়ে আছে। এ বিপুলসংখ্যক মানুষের পুরোটাই ইলিশনির্ভর। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে সমুদ্রে ইলিশের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমতে শুরু করে। কিন্তু সরকারের নানামুখী উদ্যোগের কারণে গত ১০ বছরের ব্যবধানে ইলিশের উৎপাদন দ্বিগুণ ছাড়িয়ে গেছে। ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে সরকারের যেসব উদ্যোগ সবচেয়ে বেশি ফলপ্রসূ হয়েছে, তারমধ্যে রয়েছে অক্টোবর মাসে প্রজননকালীন ইলিশ ধরা পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা। বছরের সাত মাস জাটকা আহরণ বন্ধ করা। জাটকা শিকারি জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থানসহ বিভিন্ন সহায়ক কর্মসূচী গ্রহণ এবং এ বিষয়ক গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করা। মৎস্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, প্রতি বছর প্রজননকালীন নিষেধাজ্ঞা থাকায় কমপক্ষে দেড় কোটি মা ইলিশ আহরণ থেকে রক্ষা পায়। এর থেকে প্রায় ৪৭ হাজার কেজি ডিম প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদন হয়, যা থেকে শতকরা ৫০ ভাগ হিসাবে প্রায় ৩০ হাজার কোটি রেণু উৎপাদিত হয়। এরমধ্যে শতকরা মাত্র ১০ ভাগ রেণু আহরণ থেকে রক্ষা পেলেও তিন হাজার কোটি ইলিশের উৎপাদন বাড়ে। এর প্রমাণ মেলে ইলিশ আহরণের হিসাব থেকে। গত ২০০৩-০৪ অর্থবছরে দেশে ইলিশ মাছের উৎপাদন ছিল দুই লাখ ৫৬ হাজার মেট্রিক টন, যা গত ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বেড়ে তিন লাখ ৮৫ হাজার মেট্রিক টনে দাঁড়িয়েছে। চলতি অর্থবছরে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে চার লাখ মেট্রিক টন। উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি জেলেদের সমুদ্রে ইলিশ আহরণ নির্বিঘœ করার উদ্দেশ্যে নেয়া হয়েছে জলদস্যু দমনে বিভিন্ন কার্যকর পন্থা। সরকারের বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিশেষ করে র‌্যাবের গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি সফল অভিযানে সুন্দরবনভিত্তিক অধিকাংশ শীর্ষস্থানীয় জলদস্যু বাহিনী প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এর ফলেও বেড়েছে ইলিশ আহরণের পরিমাণ। বর্তমানে দেশে জিডিপি খাতে ইলিশের অবদান শতকরা এক ভাগ এবং মোট মাছের উৎপাদনে ১১ শতাংশ জায়গা করে নিয়েছে। রফতানি খাতেও বেড়েছে ইলিশের অবদান। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ইলিশ রফতানি হয়েছে প্রায় দেড় শ’ কোটি টাকা, যা ২০১১-১২ অর্থবছরে বেড়ে প্রায় তিন শ’ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। পটুয়াখালী জেলা ভারপ্রাপ্ত মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ আজহারুল ইসলাম জানান, জেলায় সমুদ্রগামী জেলে রয়েছে প্রায় ৫৪ হাজার। গত বছর জেলায় চার শ’ কোটি টাকা মূল্যের ৫৩ হাজার মেট্রিক টন ইলিশ আহরিত হয়েছিল। এবার লক্ষ্যমাত্রা ৭০ হাজার মেট্রিক টন নির্ধারণ করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, গত কয়েক বছরে সরকারী নির্দেশনায় মাঠপর্যায়ে নিরলসভাবে নানামুখী কর্মকা-ের কারণে ইলিশের উৎপাদন ব্যাপকভাবে বেড়েছে। বিশেষ করে গত ৬-৭ বছরে ইলিশের উৎপাদন দ্বিগুণ ছাড়িয়ে গেছে। সমুদ্র ছাড়াও অভ্যন্তরীণ নদ-নদীতেও ইলিশের বিস্তৃতি বেড়েছে। মৌসুমেরও পরিবর্তন ঘটেছে। এদিকে, উৎপাদন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ বছর ইলিশ খাতে আরও একটি সুখবর যোগ হয়েছে। আকস্মিকভাবে এ বছর ইলিশের মৌসুম অন্তত দুই মাস এগিয়ে এসেছে। জুন মাসের প্রথমার্ধ থেকেই গভীর সাগরে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরা পড়তে শুরু করেছে, যা গত ১০ বছরে ঘটেনি। বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করে কলাপাড়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ কামরুল ইসলাম জানান, বাংলাদেশে আবহমানকাল থেকে জুন মাস হতে বর্ষাকালীন ইলিশের মৌসুম শুরু হতো। জেলেরা এপ্রিল-মে মাসে সাগরে নেমে পড়ত। কিন্তু গত ১০-১২ বছর ধরে মৌসুম পাল্টে যায়। আগস্ট থেকে শুরু হয় ইলিশের বর্ষাকালীন মৌসুম। এ নিয়ে মৎস্য বিশেষজ্ঞরা নানামুখী গবেষণা করেছেন। এজন্য জলবায়ু পরিবর্তন ও ইলিশের গতিপথ পাল্টে যাওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়কে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু এ বছর আকস্মিকভাবে ইলিশের মৌসুমের পরিবর্তন ঘটেছে। গত জুন মাসের ৫-৬ তারিখ থেকেই জেলেদের জালে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরা পড়তে শুরু করে, যা প্রায় ২০-২২ দিন অব্যাহত ছিল। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ২-৩ দিনের মধ্যে পূর্ণিমা পরবর্তী ‘জো’-এর প্রভাবে আবারও ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরা পড়বে। আকস্মিক মৌসুম পাল্টানোর কারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে সঠিক কারণ বলা যাবে না। তবে ধারণা করা হচ্ছে, এ বছর জুন মাসে ব্যাপক বৃষ্টিপাত হয়েছে। সাগরে একাধিক নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়েছিল। সাগর ফুলেফেঁপে উঠেছিল। ঝড়-ঝঞ্ঝার অনুকূল আবহাওয়ায় ইলিশ ঝাঁকবেঁধে তীরে চলে এসেছে।’ সাগরে প্রচুর ইলিশ অথচ উপকূলে ইলিশ নেই। এর কারণ প্রসঙ্গে কামরুল ইসলাম জানান, মূলত ৬-৭ মাস বিরতির পরে ইলিশ ধরা পড়ায় মোকামে এর দাম ও চাহিদা দু’টোই বেড়েছে। ফলে জেলেরা অধিক লাভের আশায় সাগর থেকেই মোকামগুলোতে ইলিশ পাঠিয়ে দিয়েছে, যে কারণে উপকূলে ইলিশ সঙ্কট দেখা দিয়েছে। ইলিশের মৌসুম পাল্টানোর বিষয়ে গলাচিপা উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা অঞ্জন বিশ্বাস জানান, এটি বাংলাদেশের মৎস্য খাতের বিশাল ঘটনা, যা গত কয়েক বছরে ঘটেনি। মূলত প্রজননকালীন মাছ ধরা নিষিদ্ধ করার কারণেই প্রকৃতিতে এ পরিবর্তন আনা সম্ভব হয়েছে। তিনি আরও জানান, ইলিশের মৌসুমই শুধু এগিয়ে আসেনি, এর সঙ্গে আরও যোগ হয়েছে অনেক বিষয়। যেমন ইলিশের আকার ও ওজন অনেক বেড়েছে। এখন যেসব ইলিশ ধরা পড়ছে, তার কোনটারই ওজন ৭-৮শ’ গ্রামের নিচে নয়। উপরে এক-দেড় কেজি ওজনের ইলিশও ধরা পড়ছে। এটিও একটি বিশাল সাফল্য। ইলিশের গতিপথেও পরিবর্তন এসেছে। অভ্যন্তরীণ নদ-নদী ও সাগর মোহনাগুলোতে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ছে। এই মুহূর্তে কিছুটা কম ধরা পড়ছে জানিয়ে অঞ্জন বিশ্বাস জানান, দিন কয়েকের মধ্যে পূর্ণিমা ও অমাবস্যার মধ্যবর্তী ‘জো’ শুরু হবে। তখন আবার ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরা পড়বে, যা একেবারে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। মৎস্য কর্মকর্তাদের এমন অভিমতের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন প্রান্তিক পর্যায়ের জেলেরা। পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে সাগরে ইলিশ শিকার করে বেড়ানো রাঙ্গাবালী উপজেলার চরমোন্তাজের জেলে আবদুল কাদের সরদার জানান, এ বছর বর্ষা শুরু হওয়ার পর থেকেই যে এভাবে ইলিশ ধরা পড়বে, তা তিনি ভাবতে পারেননি। আগে বর্ষার পরে ২-৩ মাস ইলিশের জন্য অপেক্ষা করতে হতো। কিন্তু এ বছর সে অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। ১৫-১৬ দিনে গভীর সাগরে চার পন অর্থাৎ ৩শ’ ২০টি ইলিশ শিকার করে ফেরা একই উপজেলার মৌডুবির জেলে মহিবর রহমান জানান, এর আগে কোন বছরেই কম সময়ে এতটা ইলিশ শিকার করেননি। এমন অভিমত দিয়েছেন আরও কয়েকজন জেলে। অপরদিকে, আরও কয়েকটি আড়ত ঘুরে ইলিশের মৌসুমের পরিবর্তন ও বাজারে ইলিশের ব্যাপক সরবরাহের চিত্র পাওয়া গেছে। গলাচিপা সদরের মৎস্য ব্যবসায়ী মোঃ ইমন জানান, দুই মাস আগেও ৭-৮শ’ গ্রাম ওজনের প্রতি কেজি ইলিশের দাম দুই হাজার টাকা ছিল। তার দাম এখন এক হাজারে চলে এসেছে। চরমোন্তাজের ইলিশ আড়তদার মোঃ জামান জানান, ৭-৮ দিন আগ পর্যন্ত সাগরে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়েছিল। দামও কমে এসেছিল। এখন একটু বেড়েছে। তারপরও এক কেজি এবং তার বড় সাইজের প্রতি কেজি ইলিশ গড়ে দেড় হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সামনে এর দাম আরও কমে আসবে। মৌসুম ফিরে আসায় ইলিশনির্ভর উপকূলের জেলেপল্লীগুলোতেও লেগেছে খুশির হাওয়া। জেলে, মহাজন, আড়তদার- সবাই রয়েছেন ফুরফুরে মেজাজে। সাগরে গেলেই মিলছে ইলিশ, এ দৃশ্য পাল্টে দিয়েছে জীবনধারার অনেক কিছুই।
×