ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আইএসে যোগ দিতে আকাশ-কুসুম স্বপ্ন দেখায় জঙ্গীরা

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ৬ জুলাই ২০১৫

আইএসে যোগ দিতে আকাশ-কুসুম স্বপ্ন দেখায় জঙ্গীরা

শংকর কুমার দে ॥ ইসলামী রাষ্ট্রের আকাশ-কুসুম কল্পনাবিলাস বিক্রি করে জিহাদে অংশ নিতে প্রলুব্ধ করে ভারতীয় উপমহাদেশের আল কায়েদা শাখা (একিউআইএস)। গণতান্ত্রিক সরকার উৎখাত করে খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বিক্রি করছে ইসলামী স্টেট (আইএস)। বাংলাদেশে খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন পূরণে জিহাদী পুরুষের পাশে দাঁড়াতে যাচ্ছে নারীরা আর হুরপরীর মতো সুন্দরী নারী পাওয়ার আশায় যাচ্ছে পুরুষরা। কিন্তু একবার সিরিয়া-ইরাক ভিত্তিক আইএসের সীমানায় গেলে সেখান থেকে আর ফিরে আসা সম্ভব নয়, যারা গেছেন তারা আর ফিরে আসতে পারেননি। ইসলামী স্টেট (আইএস) যাওয়ার বিষয়ে অনুসন্ধান ও গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে এ ধরনের তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। একিউআইএসের বাংলাদেশের প্রধান সমন্বয়কারী ও সাবেক হুজি নেতা মুফতি মাইনুল ইসলাম এবং একিউআইএসের উপদেষ্টা মাওলানা জাফর আমিনসহ মোট ১২ জনকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৩ দিনের রিমান্ড আনার রবিবার ছিল দ্বিতীয় দিন। সিরিয়া-ইরাকভিত্তিক আইএস জঙ্গী সংগঠনে যোগদান এবং জঙ্গী সংগ্রহের জন্য কার্যক্রম চালাচ্ছিল তারা। আইএস সংগঠনটি খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে যা করছে, তা সঠিক বলে মনে করেন গ্রেফতারকৃতরা। নতুন এক বা একাধিক খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর সেসব রাষ্ট্রের মাধ্যমে অনান্য রাষ্ট্রেও খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব বলে গ্রেফতারকৃতদের ধারণা। র‌্যাবের গোয়েন্দা ইউনিটের প্রধান লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ বলেন, একিউআইএসের বাংলাদেশের প্রধান সমন্বয়কারী মাওলানা মাইনুল ইসলাম ওরফে মাহিম ওরফে নানা ওরফে বদিউল, উপদেষ্টা মুফতি জাফর আমিন ওরফে সালমান, সক্রিয় সদস্য মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম, মোঃ মোশাররফ হোসেন ও আব্দুল রহমান ব্যাপারী, আল আমিন ওরফে ইব্রাহিম, মোজাহিদুল ইসলাম, আশরাফুল ইসলাম, রবিউল ইসলাম ও মোঃ হাবিব উল্লাহ, মোঃ শহিদুল ইসলাম ও আলতাফ হোসেনসহ ১২ জনকে আটক করার পর জিজ্ঞাসাবাদে আইএস এবং একিউআইএস সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে শতাধিক যুবক ও তরুণ সিরিয়াভিত্তিক উগ্রপন্থী জঙ্গী সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) যুক্ত ও যোগদানের চেষ্টা করার সময়ে শনাক্ত করেছে গোয়েন্দারা। গত ৬ মাসে অন্তত প্রায় পঞ্চাশ জনকে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সিরিয়া অথবা ইরাকে গিয়ে আইএসে যুক্ত হয়ে জিহাদে অংশ নিতে ব্যাকুল ছিলেন আটক হওয়া যুবক ও তরুণরা। বিশেষ করে খিলাফত রাষ্ট্রের আকাশ-কুসুম স্বপ্নে বিভোর হচ্ছে উচ্চ শিক্ষিত ও প্রযুক্তিবিদ্যায় পারদর্শীরা। ফিরে আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ ॥ বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত তিন ব্রিটিশ স্কুলছাত্রী জঙ্গী সংগঠন ইসলামিক স্টেটে (আইএস) যোগ দিতে সিরিয়ায় গেছে বলে জানিয়েছে, ব্রিটিশ দৈনিক টেলিগ্রাফ। পূর্ব লন্ডনের বেথনাল গ্রীন স্কুলের তিন ছাত্রী হচ্ছে শামিমা বেগম (১৫), খাদিজা সুলতানা (১৬) ও আমিরা আবাস (১৫)। গত ফেব্রুয়ারি মাসে ব্রিটেন থেকে পালিয়ে সিরিয়ায় যায় তারা। সিরিয়ায় যাওয়ার পর আইএসের শক্তঘাঁটি সিরীয় শহর রাকার একটি কম্পাউন্ডে সংগঠনটির প্রতি আনুগত্য পরীক্ষার জন্য প্রথম কয়েক মাস তাদের কঠোর নজরদারির মধ্যে রাখা হয়। বিধবা ও হবু জিহাদী কনেদের জন্য তৈরি করা হয়েছে কম্পাউন্ডটি। এই তিনজনের মধ্যে দু’জন আইএসের অনুমোদিত দুই ব্যক্তিকে বিয়ে করেছে বলে তাদের পরিবার জানিয়েছে। আরেক ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানকে। যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ায় আতঙ্কের মধ্যে আছে তারা। তাদের বিয়ের খবরে তাদের পরিবার ভেঙে পড়েছে এবং তাদের মেয়েদের যে ফিরে আসার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। প্রবাসী ১২ সদস্যের খোঁজ নেয়া হচ্ছে ॥ যুক্তরাজ্য প্রবাসী ১২ সদস্যের ওই পরিবার দেড় মাস ধরে যুক্তরাজ্য থেকে নিখোঁজ থাকার বিষয়ে বিবিসির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, যুক্তরাজ্যে প্রবাসী বাংলাদেশী একটি পরিবার চরমপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) কাছে রয়েছে। এই পরিবরাটির সিরিয়া যাওয়ার আগে বাংলাদেশে তাদের গ্রামের বাড়ি এসে গেছে। গোটা পরিবারটিই কট্টর ধর্মান্ধ বলে খবর পেয়েছে গোয়েন্দারা। আইএস যোগদানের আকাশ-কুসুম স্বপ্ন ॥ আমিনুল ইসলাম বেগ (৪৫) ও সাকিব বিন কামাল নামের দু’জনকে গত মে মাসে রাজধানী থেকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দারা। সিরিয়াভিত্তিক জঙ্গী সংগঠন আইএস-এ যোগ দিতে যুবক ও তরুণরা মরিয়া কেন সেই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দারা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, টুইটারের মাধ্যমের ছদ্মনামের বিভিন্ন ধরনের পেজ খুলে বিশ্বের অন্তত ৮০টি দেশের ১৫ হাজার যোদ্ধার নামের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ, এমনটাই তাদের দাবি। ইসলামিক রাষ্ট্রের কাল্পনিক রাজনীতির প্রলোভোনের টোপে পড়ে আইএস-এ যোগ দিচ্ছে ইউরোপ-আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্বের মেয়েরাও। আইএস-এ যোগদানে উদ্বুদ্ধ করে জঙ্গীকর্মী সংগ্রহ করার অভিযোগে গ্রেফতারকৃত মোঃ আমিনুল ইসলাম বেগ ও সাকিব বিন কামালকে গ্রেফতারের পর রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদে এ ধরনের তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দারা। পাঁচ বাংলাদেশী যুবক ॥ জিজ্ঞাসাবাদ ও তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উচ্চ পদস্থ এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, ইউটিউবে প্রকাশিত এক ভিডিওতে দেখা গেছে, ইসলামিক স্টেট (আইএস) প্রধান আবু বকর আল বাগদাদির কাছে জিহাদের শপথ নিচ্ছেন পাঁচ ‘বাংলাদেশী’ যুবক। তারা শপথ নেন বাংলায়। সুন্নিপন্থী সশস্ত্র সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) সঙ্গে বাংলাদেশের যুবক ও তরুণরা মূলত ফেসবুক আর টুইটারের মাধ্যমেই যোগাযোগ করে। আর এখন এই পেজগুলো থাকে ছদ্মনামে। থাকে ব্যক্তিগতও। আর যোগাযোগের ভাষায়ও এসেছে পরিবর্তন। গত বছর আইএস বাংলাদেশ নামে একটি ফেসবুক পেজ শনাক্ত করা পর এখন তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সেই পেজে লাইক ছিল দেড় লাখেরও বেশি। এই যুবক ও তরুণদের একাংশ জেএমবির সঙ্গে জড়িত যারা আইএস-এর উত্থানে উদ্বুদ্ধ হয়ে সেদিকে ঝুঁকছে। আর কিছু রয়েছে যারা আইএস-এর ভাবধারা এবং নানা টেক্সট পড়ে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সূত্র ধরেই বাংলাদেশের গত বছর থেকে এদের শনাক্ত করা শুরু করেন গোয়েন্দারা। গত ছয় মাসে অন্তত অর্ধশত জনকে আইএসএর সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে আটক করা হয়েছে, যারা সিরিয়া অথবা ইরাকে গিয়ে আইএস-এ যুক্ত হয়ে ‘জিহাদে’ অংশ নিতে ব্যাকুল ছিলেন। এমআইএসটি ছাত্র এখনও নিরুদ্দেশ ॥ ঢাকার মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) প্রকৌশল বিভাগের ছাত্র আশেকুর রহমানের সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেটে যোগদানের খবর নিয়ে বাংলাদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। সিরিয়ায় যাওয়ার লক্ষ্যে তিনি টার্কিশ এয়ারের একটি ফ্লাইটে ঢাকা থেকে তুরেস্ক গিয়ে নিরুদ্দেশ হন। তাঁকে খুঁজে পেতে তুরস্ক সরকারের সাহায্য চাওয়া হয়েছে। ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে গত ১১ মার্চ চিঠি দিয়ে বিষয়টি জানানো হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ দেশের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাকে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এ সংক্রান্ত চিঠিতে বলা হয়, ঢাকার মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) প্রকৌশল বিভাগের ছাত্র আশেকুর রহমান গত ২১ ফেব্রুয়ারি একটি সম্মেলনে অংশগ্রহণের কথা বলে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে যান। ২৭ ফেব্রুয়ারি তার ঢাকায় ফেরার কথা ছিল। কিন্তু তিনি দেশে না ফিরে ইস্তাম্বুল থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। সরকার উৎখাতের পরিকল্পনা ॥ গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা জানান, ইরাক ও সিরিয়ার মতো গণতান্ত্রিক দেশের সরকার ব্যবস্থাকে উৎখাতের মাধ্যমে আইএস নির্দেশিত খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য ইন্টারনেটে ও সরেজমিনে গিয়ে কর্মী সংগ্রহ করছিল আটককৃতরা। আটককৃত একিউআইএসের বাংলাদেশের প্রধান সমন্বয়কারী মাওলানা মাইনুল ইসলাম ওরফে মাহিম ওরফে নানা ওরফে বদিউল, উপদেষ্টা মুফতি জাফর আমিন ওরফে সালমানসহ ১২ জনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে আইএস এবং একিউআইএস এর তৎপরতা সম্পর্কে গুরুত্বপর্ণ তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা।
×