ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চেন্নাই ইমিগ্রেশনের বাগড়া- দেশে ফেরা হলো না ৭ তরুণীর

প্রকাশিত: ০৬:৪১, ৫ জুলাই ২০১৫

চেন্নাই ইমিগ্রেশনের বাগড়া- দেশে ফেরা হলো না ৭ তরুণীর

গাফফার খান চৌধুরী ॥ শুধুই ভুল বোঝাবুঝির কারণে দেশে ফেরা হলো না ভারতে পাচার হওয়া বাংলাদেশী সাত তরুণীর। যদিও তরুণীদের দেশে ফেরত আনার সঙ্গে জড়িতরা বলছেন, আগামী সপ্তাহেই সাত তরুণী দেশে ফিরছেন। তাতে কোন সন্দেহ নেই। চেন্নাই বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ না বুঝেই সাত তরুণীর দেশত্যাগের সনদ চেয়ে বসে। এ নিয়ে কথাবার্তা চলতে থাকে। ওদিকে বিমানের নির্ধারিত সময় পার হয়ে যায়। যখন ইমিগ্রেশনের কর্তাব্যক্তিরা বিষয়টি বুঝতে পারেন, ততক্ষণে বিমানের সময় শেষ। বিমানকে তরুণীদের রেখেই আকাশে উড়াল দিতে হয়। আর তাতেই সাময়িকভাবে স্বপ্নভঙ্গ হয় সাত তরুণীর। পরিবারের কাছে ফেরার অধীর আগ্রহ ফিকে হয়ে যায়। তরুণীরা বিমানবন্দরেই হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন। এমন খবরে সাত তরুণীর বাংলাদেশে থাকা পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও কান্নার রোল পড়ে যায়। তারা হতাশ হয়ে অজানা আশঙ্কায় প্রহর গুনছেন। আজ বিষয়টি বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) তরফ থেকে পুলিশ সদর দফতরের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হচ্ছে। ওই সাত তরুণী দেশে ফেরার আগ পর্যন্ত চেন্নাইয়ের এমসিসিএসএস নামের ওই এনজিওর সেফ হোমেই থাকবেন। এনজিওটি বিষয়টি নিয়ে আগামীকাল সোমবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শরণাপন্ন হচ্ছেন। চেন্নাইয়ের এনজিওটি বাংলাদেশের লাইট হাউস নামের এনজিওর মাধ্যমে সাত তরুণীকে দেশে ফেরত পাঠাচ্ছে। তরুণীদের দেশে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি দুই দেশের পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র ও দূতাবাস কর্তৃপক্ষ অবহিত। সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের ওই সাত তরুণীকে ভারতের চেন্নাইয়ে ভাল চাকরি দেয়ার নাম করে সীমান্ত পথে পাচার করে একটি মানব পাচারকারী চক্র। সুন্দরী সাত তরুণীর বাড়ি যশোর ও খুলনায়। তারা বাংলাদেশে সাত থেকে দশ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করতেন। পাচারকারীরা তরুণীদের চেন্নাইয়ে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা বেতনে চাকরির লোভ দেখিয়ে সীমান্তপথে ভারতীয় মানবপাচারকারীদের কাছে বিক্রি করে দেয়। তারা সাত তরুণীকে চেন্নাইয়ের একটি পতিতালয়ে বিক্রি করে দেয়। তারপর থেকেই শুরু হয় সাত তরুণীর অন্ধকার জীবন। অন্ধকার জীবনে তাদের ওপর চলতে থাকতে অমানুষিক বর্বর নির্যাতন। গত বছরের নবেম্বরের শেষ দিকে চেন্নাইয়ের ওই পতিতালয়ে অভিযান চালায় ভারতের পুলিশ। ভাষাগত পার্থক্যের কারণে সাত তরুণী ধরা পড়ে। পুলিশ তরুণীদের এমসিসিএসএস (মাদ্রাস খ্রীস্টান কাউন্সিল ফর সোস্যাল সার্ভিস) নামের একটি এনজিওর সেফ হোমে রাখে। সেখানেই ভারতীয় টাস্কফোর্স সাত তরুণীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। পাচারের সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে। বিষয়টি ভারত সরকারের তরফ থেকে বাংলাদেশকে জানানো হয়। বাংলাদেশ সরকারকে সাত তরুণীর পরিচয় নিশ্চিত করতে বলা হয়। বাংলাদেশ তা নিশ্চিত করে। এরপর শুরু হয় সাত তরুণীকে বাংলাদেশে পাঠানোর প্রক্রিয়া। মাদ্রাজের এনজিওটির সঙ্গে যোগাযোগ হয় বাংলাদেশের লাইট হাউস নামের একটি এনজিওর সঙ্গে। লাইট হাউস এনজিওর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হারুণ অর রশীদ জনকণ্ঠকে বলেন, পাচারের শিকার হওয়া সাত তরুণীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র এমনকি দুই দেশে থাকা দুই দেশের দূতাবাসও জানে। বাংলাদেশের তরফ থেকে সাত তরুণীকে দেশে ফেরত পাঠাতে প্রয়োজনীয় সব কাগজ এনজিও ছাড়াও বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে ভারত সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এমনকি চলতি বছরের ২০ মে সাত তরুণীর ট্রাভেল পারমিট হয়। সমস্ত প্রক্রিয়া শেষ হয়। শনিবার সাত তরুণী ও চেন্নাইয়ের ওই এনজিওটির তিনজন প্রতিনিধি যথারীতি চেন্নাই বিমানবন্দরে হাজির হন। বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ তাদের সমস্ত কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করেন। কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করতে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা অনেক সময় নেন। শেষ পর্যায়ে কর্মকর্তারা সাত তরুণীর কাছে দেশ ত্যাগের ভারতীয় সনদপত্র চেয়ে বসেন। চেন্নাইয়ের এনজিও কর্মকর্তাদের তরফ থেকে এসব কাগজপত্র না লাগার যৌক্তিক কারণ ব্যাখ্যা করা হয়। কিন্তু এনজিও কর্মকর্তাদের ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হতে পারেননি ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা। দীর্ঘ সময় এ নিয়ে এনজিও প্রতিনিধি দল, সাত তরুণী ও ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের কথাবার্তা হয়। শেষ পর্যন্ত বিষয়টি ইমিগ্রেশনের উর্ধতন কর্মকর্তাদের পর্যন্ত গড়ায়। ইমিগ্রেশনের কর্তাব্যক্তিরা যখন সাত তরুণী ও এনজিও কর্মকর্তাদের বাংলাদেশ যেতে অনুমতি দেয়, ততক্ষণে বিমান আকাশে উড়াল দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয় পুরো মিশন। ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ এর জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। লাইট হাউস এনজিওর কর্মকর্তা আরও জানান, সাত তরুণীর পরিবারকে ঢাকায় আসার জন্য বলা হয়েছে। তারা যথারীতি ঢাকায় চলে এসেছেন। তরুণীদের পিতামাতা, এনজিও কর্তৃপক্ষ এবং সিআইডি কর্মকর্তারা বিমানবন্দরে পৌঁছার কিছুক্ষণ পরই সাত তরুণীর দেশে না ফেরা সংক্রান্ত ঘটনা তাদের জানানো হয়। তরুণীদের নিয়ে চেন্নাইয়ের এনজিওটির তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধি দলের শনিবার বিকেল সোয়া তিনটায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামার কথা ছিল। সাত তরুণীকে লাইট হাউস এনজিও অধীনে বাংলাদেশ সরকারের সেফ হোমে রাখার কথা ছিল। না আসতে পারার সংবাদ শুনে তরুণীদের পিতামাতা, ভাই বোন ও আত্মীয়স্বজনরা হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন। সাত তরুণীর পিতামাতারা অজানা আশঙ্কায় প্রহর গুনছেন। আজ রবিবার চেন্নাইয়ের এমএসএসসিসি এনজিওর তিন সদস্যের প্রতিনিধি দলের সদস্য দীলিপ কুমার, প্রসন্ন গানামান ও জে আর সিলভানাস, বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (রাজনৈতিক) আবু হেনা মোঃ রহমাতুল মুনীমের উপস্থিতিতে সাত তরুণীকে রাজধানীর বনানীর একটি বাড়িতে তরুণীদের পিতামাতার কাছে হস্তান্তরের কথা ছিল। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের সিআইডি পুলিশের অর্গানাইজড ক্রাইম (সংঘবদ্ধ অপরাধ) বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মীর্জা আবদুল্লাহেল বাকী ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জনকণ্ঠকে জানান, সাত তরুণীর দেশে না ফেরার বিষয়টি রবিবার পুলিশ সদর দফতরের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানানো হবে। তবে দ্রুত তরুণীদের দেশে ফেরত আনা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টদের তরফ থেকে সিআইডিকে নিশ্চিত করা হয়েছে। ভারতের সেফ হোমে ভারতীয় টাক্সফোর্সের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া অনেক তথ্যই বিভিন্ন মাধ্যমে সিআইডির হাতে এসেছে। সেই তথ্য মোতাবেক পাচারকারীদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত আছে। এছাড়া দেশে ফিরলে তরুণীদের জবানবন্দী রেকর্ড করা হবে। জবানবন্দী অনুযায়ীও পাচারকারীদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। তবে সামাজিক মর্যাদার কথা চিন্তা করে সাত তরুণীকে জিজ্ঞাসাবাদ থেকে শুরু করে পুরো প্রক্রিয়াটিই সম্পন্ন করা হচ্ছে অত্যন্ত গোপনে।
×