ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মোস্তাফা জব্বার

একুশ শতক ॥ হাওড় বাংলার রূপান্তর

প্রকাশিত: ০৪:১১, ৫ জুলাই ২০১৫

একুশ শতক ॥ হাওড় বাংলার রূপান্তর

॥ তিন ॥ অনেক দিন পর, বহু বছর বিরতিতে বাড়িতে যাওয়া। মা মারা যাওয়ার পর আর বাড়ি যাইনি। মা থাকতে কারণে-অকারণে বাড়ি যেতাম। কোন কোন সময় সপ্তাহ দুয়েকও থাকতাম। শৈশবে স্কুলে ছুটি হলে তো বটেই, ছুটি ছাড়াও মার কোলে ছুটে যেতাম। মার হাতের রান্না আর মায়ের যতœ ষাট বছর বয়সেও ভাল লাগত। আমার মনে আছে যখন স্কুলে পড়তাম তখন বহুবার বাবার হাতে মার খেয়েছি স্কুল খোলা খাকতেও বাড়ি যাওয়ার জন্য। বাবাকে বোঝানো যায়নি যে, ১২ বছর বয়সে মা ছাড়া থাকা কত কষ্টের। বাবা কেবল বুঝতেন লেখাপড়া না করলে কোনভাবেই চলবে না। তখন আমার মনে হতো তিনি একটা রোবট- শরীরে দয়া মায়া বলে কিছু নেই। আমার মায়ের কথাও উল্লেখ করা উচিত। তার পৈত্রিক বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জের চর চারতলায়। ওখানে আমারও জন্ম। আশগুঞ্জে বাবার ব্যবসা ছিল বলে মাকে তিনি তার শ্বশুড়বাড়িতেই রেখেছিলেন। নানা নানির বড় সন্তান বলে তার প্রথম সন্তানের জন্ম মার বাড়িতেই হয়েছিল। আমার নানা নানির পুত্র সন্তান ছিল না বলে আমি সেই জায়গাটাও দখল করেছিলাম। ফলে জন্মের পরও কয়েক বছর নানার বাড়িতেই থেকে যাই। কিন্তু সেটি আমার মায়ের পছন্দ ছিল না। আমার যখন প্রায় ৪ বছর বয়স তখন আমার মা একরকম জেদ করে তার বাপের বাড়ি ছেড়ে নিজের শ্বশুরবাড়িতে আসেন। আমাজনের জঙ্গলের আদিবাসীদের বাসস্থান ও জীবন জীবিকার আদলে বিরাজ করা তার শ্বশুরবাড়িতে তিনি তার আধা শহুরে জীবনকে খাপ খাওয়ান। হাঁড়ি হাঁড়ি ভাত-তরকারি রান্না করার পাশাপাশি গোবরের চট লেপা থেকে শুরু করে বোরো চাষের সকল ব্যবস্থাই মা শিখে নেন। পুরো অচেনা এক জগতকে আপন করে নেন। বাবা প্রধানত বাইরে বাইরে থাকতেন বলে ছেলে মেয়েদের দেখাশোনা থেকে সবটাই মাকেই করতে হয়েছে। আমার মা সম্ভবত বাংলাদেশের সকল নারীর প্রতীক। আমাদের মেয়েরা কেবল যে সর্বংসহা তাই নয়, বিশ্বের যে কোন স্থানে যে কোন প্রতিকূলতার মাঝে তারা নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেন। এত দ্রুত শেখার ক্ষমতাও বোধহয় আর কোন জাতির মেয়েদের নেই। আমার মায়ের আরেকটু বাড়তি গুণ ছিল যে তিনি আমার পিতার শূন্যতাটাকেও পূরণ করেছিলেন। তিনি বাবা মারা যাওয়ার পর তো বটেই তার আগেও পুরো সংসারটা একাই সামাল দিয়েছেন। তিলে তিলে ৫টি সন্তানের তিনজনকে মাস্টার্স, ১ জনকে গ্র্যাজুয়েট ও ১জনকে এসএসসি পাস করান। গ্রামের মেয়েদের হাইস্কুলটি তিনিই আমাকে তৈরি করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। আমার মনে আছে, স্বাধীনতার পরপরই যখন হাইস্কুলটি সচল হয়ে পড়ে তখন গ্রামের অবস্থাপন্ন মানুষের ছেলেরা লেখাপড়ায় উদ্যোগী হয়। কিন্তু আশপাশে কোথাও কলেজ না থাকায় শতকরা ৯০ জনের লেখাপড়া এসএসসিতেই থেমে যায়। ৮৬ সালে আমি সাহস করি যে একটা কলেজ করা যেতে পারে। যেখানে কোন থানা সদরে কলেজ নেই সেখানে একটি গ্রামে কলেজ করার চিন্তা করাও দুঃসাহসের বিষয় ছিল। কিন্তু সেই কাজটি আমরা করেই ফেললাম। জমি কেনা হলো। নিজের পকেট থেকে ১০ হাজার টাকা দিয়ে একটা পুরনো টিনের ঘর কিনে সেটিকে কলেজ ঘোষণা করা হলো। আমার ছোট ভাই কিবরিয়া ততদিনে মাস্টার্স পাস করেছে। ওকে অবৈতনিক অধ্যক্ষ নিয়োগ দেয়া হলো। এরপর আমার ভাগিনা আবুল কালাম আজাদ ও ছোট বোনের স্বামী নাজিমউদ্দিনের কলেজে যোগদান কলেজটি প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করে দেয়। পাশের গ্রামের মোশারফ, রফিক ওরা না থাকলেও সেখানে শিক্ষক পাওয়া যেত না। এরই মাঝে আমাদের নিজেদের জমিতে একটি ডিগ্রী মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত করি আমরা। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় মেয়েদের লেখাপড়া নিয়ে। আমার মা-ই প্রথমে এই বিষয়ে দৃষ্টি দেন। তিনি বলতেন, বাবারে এই গ্রামের কোন পরিবর্তন হবে না যদি তুমি মেয়েদের পড়াতে না পার। চারপাশে দেখে মনে হয়েছিল, মা ঠিক বলেছেন। আমাদের বাড়ির ছেলেরাও লেখাপড়া করত কিন্তু মেয়েগুলো পড়ত না। মার ইচ্ছায় ৯৬ সালে একদমই একক প্রচেষ্টায় গড়ে তুলি একটি বালিকা বিদ্যালয়। সেটি মা-বাবার নামেই গড়ে তোলা-আবদুল জব্বার-রাবেয়া খাতুন বালিকা বিদ্যালয়। আজ সেই স্কুল উপজেলায় সেরা স্কুলে পরিণত হয়েছে। শত শত মেয়ে ওখানে কেবল নানা বিষয় পড়ে না, কম্পিউটার নিয়ে সময় কাটায়। সেদিন আমি বিস্মিত হয়েছি এই স্কুলের এক মেয়ের ফেসবুক স্ট্যাটাস দেখে। সে লিখেছে তার জীবনের স্বপ্ন ডাক্তার হওয়ার। আরেকটি মেয়ে লিখেছে, সে আউটসোর্সিং করতে চায়। মা বুঝেছিলেন, মেয়েরা লেখাপড়া করলেই জীবনধারা বদলাবে, যেমনটি তিনি তার পরিবারকে বদলে দিয়েছিলেন। সেই মা আজ আর নেই। মা নেই বলে বাড়ির অবস্থা অন্যরকম। আমার ছোট একটা বোন পাশের গ্রামে থাকে। আমরা বাকি ভাই-বোনরা কেউ বাড়িতে থাকি না। বাড়িতে ভাত-তরকারি রান্না করে খাওয়ানোরও কেউ নেই। ছোট ভাই কিবরিয়া যতদিন উপজেলা চেয়ারম্যান ছিল ততদিন বাড়িতে একটা রমরমা ভাব ছিল, এখন তো সেও ঢাকাতেই বেশি সময় থাকে। তবুও যেতে হয়েছিল। অসুবিধা হয়নি এজন্য যে, ছোট ভাইয়ের স্ত্রী ও আমার চাচাত বোন রাকিয়া আমাদের সঙ্গেই বাড়ি গিয়েছিল। এবার মনে হলো একেবারে নতুন করে দেখলাম গ্রামটা। একদম নতুন। সেই গ্রাম; যেখানে আমার শৈশব কেটেছে। সেই গ্রাম; যেখানে আমার পিতা-মাতার কবর। সেই গ্রাম; যার ওপর আমার একাত্তর দাঁড়িয়েছে। সেই গ্রাম; যে গ্রামটাকে আমার নানা উত্তইরা ভূতের বাড়ি বলতেন। সেই গ্রাম; যাকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠেছিল আমার স্বপ্নের ভিত। এখন হয়ত আর সেই গ্রামে যেতে মন চায় না- কিন্তু এক সময় সারা দুনিয়ার সবচেয়ে বড় আশ্রয়স্থল সেই গ্রামটাকেই মনে হতো। কত কষ্ট করে যেতে হতো- তবুও যেতাম। মা ছিলেন যে! আজ সেই গ্রাম এখন আলোকিত দ্বীপ। এরই মধ্যে নিশ্চয়ই জানা হয়ে গেছে যে, নেত্রকোনা জেলার খালিয়াজুরী থানার কৃষ্ণপুরে আমার পৈত্রিক বাড়ি। এটি বাংলাদেশের প্রত্যন্ত হাওড় এলাকার গভীরে অবস্থান করে। ইতিহাস বলে, এটি প্রাচীনকালের কালিদহ সাগরের অংশ ছিল। বেহুলার বাসর ঘর ছিল সেখানে। সাপ আর বন্য প্রাণী ছাড়া ওখানে কোন মানুষ বাস করত না। দেশের ৭টি জেলার যে কয়টি উপজেলার পুরোটাই হাওড়ে তার মাঝে খালিয়াজুরী একটি। ৯০টি গ্রামের এই উপজেলাটিতে উপজেলা সদর, মেন্দিপুর, সাতগাঁও এবং আমার গ্রাম কৃষ্ণপুর ছাড়া আর কোথাও সারা বছর চলার মতো এক কিলোমিটারের বেশি সড়কপথ এখনও নেই। বলা হয়ে থাকে যে, একটি ভূমিকম্পে এই অঞ্চলটি তৈরি হয়েছে। ১৭৬২ সালের ভূমিকম্পে এর ভূপ্রাকৃতিক পরিবর্তন হয় বলে অনেকেই মনে করেন। এই অঞ্চলটি প্রত্যন্ত ও দুর্গম বলে ২শ’ বছর আগেও এখানে জনবসতি ছিল না বলা যায়। ভৈরবের ভাটি (ভাটি বলতে হাওড় অঞ্চলকে বোঝানো হয়। ভৈরব থেকে নরসিংদীর দিকে মেঘনার ভাটিতে) থেকে বিপুল পরিমাণ মানুষ সেই সময়ে ওই এলাকায় বসবাস করা শুরু করে যারা আবাদী নামে পরিচিত। ১৭৬২ সালের ভূমিকম্পের ফলে এই এলাকায় ব্রহ্মপুত্র গতিপথ পরিবর্তন করে বলে অনেকের ফসলী জমি কমে যায় এবং সেই কারণে তারা আবাদী হয় বলে মনে করা হয়। আমার দাদাও তেমন একজন আবাদী। এই গ্রাম থেকে ঢাকা আসতে এক সময়ে ৩ দিন ২ রাত সময় লাগত। এর মাঝে ৩০ কিলোমিটার পথ ছিল যেটুকুতে হেমন্তকালে হাঁটা ও বর্ষাকালে নৌকা ছাড়া বিকল্প কোন উপায় এখনও নেই। এই পথটা হেঁটে পাড়ি দিতে একদিন যেত। পরের দিন লেগে যেত লঞ্চে-আজমিরীগঞ্জ থেকে ভৈরব। এর পরের দিন ভৈরব থেকে ট্রেনে ঢাকা আসতে হতো। আমার নানার বাড়ি ছিল আশুগঞ্জে। নৌকায় যদি আসতাম তবে পুরো ২ রাত ৩ দিন নৌকায় থাকতে হতো। এবার ঢাকা থেকে বাড়ি গেলাম আট ঘণ্টায়। সড়কপথে সাত ঘণ্টা আর নদীপথে এক ঘণ্টা। সামনের দুয়েক বছরে নদীপথটার আর দরকার হবে না। গাড়ি নিজের বাড়ির ওঠানেই যাবে। ১৯৬১ সালে আমি আমার বাড়ির চারপাশে প্রায় ৪০ কিলোমিটারের মাঝে একটি হাইস্কুল পাইনি ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার জন্য। সেই সময়কার হাওড়ের বিবরণ তুলে ধরা হলে মনে হবে যে, এটি মানুষের আদি সভ্যতার সময়কালের কথা বলা হচ্ছে। হতে পারে আমাজনের জঙ্গল। আমি আমার পুরো গ্রামে একজন মাত্র মানুষকে জুতা পায়ে দিতে দেখতাম- সেটি আমার বাবা। পুরো গ্রামের কোন মানুষকে ব্রাশ বা পেস্ট দিয়ে দাঁত মাজতে দেখিনি। গ্রামটিতে দুয়েকটা টিনের ঘর ছাড়া সব ঘরই ছিল ছনের। আমার এক চাচার একটি দোতলা দালান ছিল। সেই দালানের জন্য ইট আনা হয়েছিল শত মাইল দূর থেকে। বৈশাখ মাসের শুরুতে গ্রামের মানুষের প্রধানতম কাজ ছিল হাওড় থেকে ছন কেটে এনে ঘরের ছাদ ঠিক করা। আমার নিজের গ্রামে লেখাপড়ার হার বলতে কিছু ছিল না। আমার চাচাত ভাইদের মাঝে আমার আগে মোট ৪জন ম্যাট্রিক পাস করেছেন। এদের একজন এইচএসসি পাস করেছেন। আমার সঙ্গে আরেক চাচাত ভাই এসএসসি পাস করেন। আমাদের গ্রামের প্রথম গ্র্যাজুয়েট ছিলেন আমার ফুফাত ভাই, যিনি আবার আমার বড় বোনের স্বামীও। আমার আগে অন্য বাড়ির মোট ২ জন ম্যাট্রিক পাশ করেন। এছাড়া আর কেউ কোন পাশ-টাশ করেনি। গ্রামে মেয়েদের লেখাপড়া নামক কিছু ছিলোনা। আমার চাচাতো বোনেরা কেউ প্রাথমিক বিদ্যালয় অতিক্রম করেননি। গ্রামের প্রথম মহিলা স্নাতক আমার ছোট বোন হেলেন। আর মেয়েদের মাস্টারস পাস করা, প্রকৌশলী, স্থপতি বা ডাক্তার হওয়ার পালাটা আমাদের সন্তানদের সময় থেকে শুরু হয়েছে। আমার বড় মেয়ে ডাক্তার, ছোট মেয়ে স্থপতি। ছেলে কম্পিউটার বিজ্ঞানে গ্র্যাজুয়েশন করছে। আমার ছোট ভাই কিবরিয়ার দুই মেয়ে ও ১ ছেলে মাস্টার্স পাস করেছে। ছোট ভাই রাব্বানীর মেয়ে ডাক্তার, ছেলে মাস্টার্স পড়ছে। বোনদের ছেলেরাও গ্র্যাজুয়েশন বা তার পরের স্তরে পড়াশোনা করছে। অথচ এই গ্রামের মেয়েদের ১২-১৪ বছর বয়স হলেই বিয়ে দেয়াটা অতি সাধারণ ঘটনা ছিল। আদিবাসীদের মতো গামছার লেংটি পরা মানুষ হাওড়ে চোখে পড়তই। ঢাকা, ৩ জুলাই, ২০১৫ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক ॥ ই-মেইল : [email protected] ওয়েবপেজ:ww w.bijoyekushe.net,ww w.bijoydigital.com
×