ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষক বঞ্চনার কিছু কথা

প্রকাশিত: ০৪:০৭, ৫ জুলাই ২০১৫

শিক্ষক বঞ্চনার কিছু কথা

শিক্ষকরা জাতি গঠনে ভূমিকা রাখেন। জাতির বিবেক তৈরি করেন। কিন্তু শিক্ষকদের কথা কেউ ভাবে না। দুঃখ এটাই যে, শিক্ষাকে অনুৎপাদনশীল খাত ভাবা হয়। সেজন্য শিক্ষকদের দিকে তাকাতে এত কার্পণ্য। কিন্তু সমৃদ্ধ জাতি গঠনে শিক্ষার অগ্রগতি অনিবার্য। শিক্ষকদের পিছিয়ে রাখার প্রতিযোগিতা ৪৪ বছর ধরে চলছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ার স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে; কিন্তু এমপিওভুক্তি করা হচ্ছে না। শিক্ষক নিয়োগের অনুমতি দেয়া হচ্ছে, অপরপক্ষে শর্ত জুড়ে দিয়ে বেতন আটকে রাখা হচ্ছে। কত অনিয়ম আর কত যে বৈষম্য শিক্ষায় তা লিখে শেষ করা যাবে না। সরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চারুকারু, সঙ্গীত, গার্হস্থ্য অর্থনীতি বিষয়ে শিক্ষক রয়েছেন। কিন্তু বেসরকারী মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এসব বিষয়ে শিক্ষক নিয়োগের সুযোগ নেই। এভাবে বেসরকারী বিদ্যালয়ের ছাত্ররাও শিক্ষা গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা ফি-বছর ইনক্রিমেন্ট পাচ্ছেন, আর বেসরকারী শিক্ষকরা একটি ইনক্রিমেন্ট পেয়ে অবসরে যাচ্ছেন। শিক্ষায় বৈষম্য রেখে, শিক্ষানীতিতে বৈষম্য রেখে শিক্ষায় অগ্রগতির কথা আমরা বলি কিভাবে? প্রধানমন্ত্রী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বড় মাপের সকলের মেধায় শিক্ষকদের মেধার প্রতিফলন রয়েছে। যাঁরা বড় মাপের মানুষ হয়েছেন তাঁরা শিক্ষকদের কাছে হাতেখড়ি নিয়েছেন বিদ্যালয়ে। কাজেই শিক্ষা অনুৎপাদনশীল খাত নয়। বরং সমৃদ্ধ জাতি গঠনে, সুনাগরিক গঠনে শিক্ষকদের শ্রমের বিকল্প নেই। কিন্তু ৪৪ বছরে তাল সোনাপুরের তালেব মাস্টারের কাহিনীর যবানিকা টানা হয়নি ইচ্ছে করেই। শিক্ষকদের পাঁচ শ’ টাকা নামমাত্র বাড়ি ভাড়া দেয়া হচ্ছে। কতকাল শিক্ষকদের বঞ্চিত রাখা হবে। যাঁদের শ্রদ্ধা করা দরকার, তাঁদের সম্মানিত করা দরকারÑ তা আমরা করছি না। ফলে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি পদে পদে বখাটে আর সন্ত্রাসীরা এগিয়ে রয়েছে। ভয়াবহ পরিণাম ভোগ করতে হচ্ছে সেজন্যই। ২০০৮ সালে মহাজোট সরকার বিজয়ী হলো। ক্ষমতায় বসে চারদিকে ঢাকঢোল পিটিয়ে বলে বেড়ায় আমরা শিক্ষকদের স্বতন্ত্র স্কেল দেব। স্বতন্ত্র স্কেল তো দূরে থাক, এখন জাতীয় পে-স্কেলে বেসরকারী শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত করতে নানা টালবাহানা করা হচ্ছে। সরকারী কর্মচারীদের সঙ্গে যাদের মহার্ঘ্যভাতা দেয়া হলো, সেসব বেসরকারী শিক্ষক-কর্মচারীকে ছয় মাস পরে পে-স্কেলে ঘোষিত বেতন দিলে সরকারের কতটা লাভ হবে? সরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানদের উচ্চতর স্কেল দেয়া হয়; কিন্তু বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের দেয়া হয় না। এভাবে বৈষম্যমূলক আচরণ করে, বৈষম্যমূলক সুবিধা দিয়ে শিক্ষার অগ্রগতি আদৌ সম্ভব নয়। শিক্ষা বোর্ডের প্রধান, শিক্ষা অধিদফতরের প্রধান, এমনকি অন্যান্য শিক্ষা অফিসের প্রধানরা শিক্ষকতা পেশা থেকে উঠে আসেন। কিন্তু দেশে চাউর রয়েছে শিক্ষায় দুর্নীতি চলে। এর চেয়ে লজ্জার আর কি থাকতে পারে? না তারা শিক্ষকদের কথা ভাবেন না, শিক্ষামন্ত্রীও শিক্ষকদের কথা ভাবেন না। বুদ্ধিজীবী, সুধীসমাজ, সুজনসমাজ, এমনকি সাংবাদিকরাও কখনও শিক্ষকদের বঞ্চনা নিয়ে টুঁ শব্দটি করেন না। গণতান্ত্রিক এ সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের প্রথমদিকে শিক্ষকের প্রত্যাশা জেগে উঠেছিল পাহাড়সম; কিন্তু সবটাই এখন চরে আটকে গেছে। মাস শেষে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন বিল করতে, ছুটির রেজিস্ট্রার নিয়ে ছুটতে হয় উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের স্বাক্ষরের জন্য। এর চেয়ে নির্মম মানবেতর চাকরিবিধি আর কি থাকতে পারে! শিক্ষকদের বেতন এখন তাদের স্ব-স্ব এ্যাকাউন্টে চলে যায়। অথচ বেতন বিলে ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির প্রতিস্বাক্ষর বাধ্যতামূলক। সকল আর্থিক ও প্রশাসনিক জবাবদিহিতা করতে হয় প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের। অথচ সভাপতিদের দাপটে শিক্ষকরা নিগৃহীত হন যত্রতত্র। বেতন বিল আটকে দেয়ার ঘটনা ঘটে অহরহ। এমনকি ছলছুতার কবলে ফেলে অনেক শিক্ষককে বিদ্যালয়ে ঢুকতেই দেয়া হয় না। এসব আমলাতান্ত্রিক হটকারী আইনের অবসান জরুরী। আমরা যখন দাবি করছি শিক্ষায় যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে তখন শিক্ষক অবমাননার এত হিড়িক কেন চলবে? প্রধানমন্ত্রীকে বলছি, আপনি তো ওয়াদা করেছেন, আমরা ক্ষমতায় গেলে শিক্ষকদের রাজপথে যেতে দেব না, যেতে হবে না। কিন্তু শিক্ষকরা মানববন্ধন করছেন, সংবাদ সম্মেলন করছেন। আপনি দয়া করে শিক্ষকদের দিকে ফিরে তাকান। লেখক : প্রধান শিক্ষক, নারিকেলী উচ্চবিদ্যালয়, জামালপুর
×