ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কানাগলিতে সালাফিরা

প্রকাশিত: ০৪:০৬, ৫ জুলাই ২০১৫

কানাগলিতে সালাফিরা

ইসলাম ধর্মের সবচেয়ে রক্ষণশীল অনুসারী সালাফিদের পক্ষে রাজনীতি করা কঠিন হয়ে পড়ায় তারা অন্য পথের আশ্রয় নিচ্ছে। আল কায়েদা ও ইসলামিক স্টেটের (আইএস) মতো চরমপন্থী সংগঠনগুলোর সদস্যরা হলো সালাফি। সৌদি আরবে এই মতের লোকদের বলা হয় ওয়াহাবি। উভয়ের দৃষ্টিভঙ্গি ও দর্শন এক ও অভিন্ন। ইসলামের প্রতি এদের দৃষ্টিভঙ্গি মৌলবাদী। অর্থাৎ এরা ইসলাম ও মহানবী মোহাম্মদ (দ)-এর শিক্ষাকে অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ ও অনুকরণ করার পক্ষপাতী। এ ব্যাপারে কোনরকম সংস্কার, পরিবর্তন বা পরিমার্জন তারা মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। সালাফিদের রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার ব্যাপারে এক ধরনের নির্লিপ্ততার ঐতিহ্য থাকলেও, তারা এখন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। আরব বসন্তের আগে কিছু সালাফি মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান ইসলামী আন্দোলন মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্য ছিল। ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক কর্মকা-ের দীর্ঘ ঐতিহ্য আছে। তবে বেশির ভাগ সালাফি রাজনীতি পরিহার করে এসেছে। ব্রাদারহুডের আন্দোলন আজ তিনটি ধারায় বিভক্ত। সবচেয়ে সংখ্যায় বেশি বিশুদ্ধবাদীরা, যারা বিশ্বাস করে যে রাজনীতি আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে খর্ব করে এবং সে কারণে একে পরিহার করাই সর্বোত্তম। সৌদি আরবের ওয়াহাবিদের মতো অধিকাংশ সালাফি ফিতনা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি এড়ানোর জন্য মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে নতিস্বীকার করেÑ তা সেই রাষ্ট্রপ্রধান যতই অপ্রিয় বা অপছন্দের হোক না কেন। সালাফিদের সবচেয়ে সংখ্যালঘু অংশ হচ্ছে জিহাদীরা। আর রাজনীতিতে সেসব সালাফি সক্রিয়ভাবে যুক্ত তারা হলো তৃতীয় গ্রুপ। আরব বসন্তের পর রাজনীতি ও ধর্মের মধ্যকার সীমারেখা ঘোলাটে আকার ধারণ করলে এই তৃতীয় স্তরের সালাফিদের সংখ্যা স্ফীত হয়ে ওঠে। জ্যাকব ওলিভর্ট নামে এক গবেষক বলেন, পছন্দ-অপছন্দের চাইতে তখন পরিবর্তনশীল ঘটনাপ্রবাহকে সংজ্ঞায়িত করা ও কাঠামো দেয়া প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছিলÑ বিশেষ করে এসব ঘটনার ওপর মন্তব্য করার জন্য সালাফিদের ওপর যখন মিডিয়া ও অন্যান্য ইসলামী গ্রুপের তরফ থেকে চাপ আসছিল। অপেক্ষাকৃত অল্প সংখ্যক সালাফি এসব বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিল। তবে কেউ কেউ তাদের এই দুয়ার উন্মোচনকে একটা সুযোগ হিসেবে দেখে। তারা যুক্তি দেয় যে, এখন রাজনীতির মাধ্যমে শরিয়তী আইন প্রণয়ন করা যেতে পারে। কুয়েতে রাজনৈতিক সালাফিরা আগে থেকেই সুপ্রতিষ্ঠিত। কুয়েতের সহধর্মীদের দ্বারা উৎসাহিত হয়ে মিসরের সালাফিরা সুযোগ গ্রহণ করে। দেশের প্রধান সালাফি সংগঠন ছিল আলেকজান্দ্রিয়াভিত্তিক ‘সালাফিস্ট কল’। সেই সংগঠন থেকে গড়ে ওঠা নূর পার্টি দেশের প্রথম অবাধ নির্বাচনে পার্লামেন্টের ২০ শতাংশের বেশি আসনে বিজয়ী হয়। ফলে দলটি দেশের নতুন সংবিধানের গায়ে ইসলামী পরশ সুনিশ্চিত করে তোলে। একই সময় পুরাতন শাসকদের প্রতি সমর্থন এবং বিক্ষোভের বিরোধিতা করার জন্য বিশুদ্ধবাদীদের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়। সৌদি আরবের শীর্ষ ধর্মীয় নেতারা এক ডিক্রি জারি করে বলেÑ ‘বিক্ষোভ আন্দোলন ও অন্যান্য উপায়ে এবং সমাজে অসন্তোষ ও বিভাজন দেখা দিতে পারে, এমন পন্থায় সংস্কার করা উচিত নয়।’ ২০১১ সালে এক ভাষণে জর্ডানের বিশিষ্ট ধর্মীয় নেতা আলী আল-হালাবি বলেন, ‘আল্লাহর আইন থেকে বিক্ষোভের অবস্থান বহু দূরে এবং তা বস্তুবাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত। তবে সেই সময় বিশুদ্ধবাদীদের বক্তব্য প্রায়শই উপেক্ষিত হয়েছিল। এখন তারা মনে করে তাদের বক্তব্যের যথার্থতা প্রমাণিত হয়েছে। হালাবি বলেন, ‘আরব বসন্তের দেশগুলো ধ্বংস, দুর্নীতি এবং নিরাপত্তাহীনতা ছাড়া আর কিছুই লাভ করতে পারেনি।’ মিসরে সালাফিদের রক্ষণশীল প্রভাব প্রেসিডেন্ট ও মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতা মোহাম্মদ মুরসির পতনে অবদান রেখেছিল। নূর পার্টি মুরসির অপসারণ এবং আবদেল ফাতাহ আল সিসির অভ্যুত্থান সমর্থনের সিদ্ধান্ত নেয়। এতে দলের সমর্থকদের অনেকে দল থেকে বেরিয়ে যায়। তবে এর ফলে সিসি যেমন ব্রাদারহুডকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছেন, তেমনি ব্রাদারহুডের মতো একই পরিণতি সালাফিদেরও ভোগ করতে হবে তেমন সম্ভাবনা নেই। ওয়াশিংটনের ব্লুকিং ইনস্টিটিউশনের উইল ম্যাকক্যান্টস বলেন, নূর পার্টি নীরবতাবাদীদের মধ্যে এ ধারণা জোরদার করে তুলেছে যে, রাজনীতিতে থাকতে হলে শয়তানের কাছে হয় নিজেকে বিক্রীত হতে হবে, নয়ত তার সঙ্গে সমঝোতা করতে হবে। রাজনীতিতে সংশ্লিষ্ট হওয়ার প্রশ্নে বিশুদ্ধবাদীরা যে বিরোধী মনোভাব প্রদর্শন করে আসছে, সে ব্যাপারে তিউনিসিয়ার দৃষ্টান্ত থেকে তারা সমর্থন লাভ করতে পারে। বলাবাহুল্য, তিউনিসিয়াই হলো আরব বসন্ত থেকে আবির্ভূত একমাত্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। রাজনীতিতে সক্রিয় অনেক সালাফি তিউনিসিয়া মুসলিম ব্রাদারহুড অনুপ্রাণিত নাহদা পার্টির ওপর আশাভরসা ন্যস্ত করেছিল। ২০১১ সালে তিউনিসিয়ায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনে এই দলটি সর্বাধিক আসনে জয়ী হয়। নাহদার নেতা রাশেদ খানুচি নিজেকে সালাফি বলেও দাবি করে থাকেন। তবে দলটি রক্ষণশীল মুসলমানদের সাদরে কাছে টেনে নিলেও একই সঙ্গে তাদের প্রভাব খর্ব করারও পদক্ষেপ নিয়েছে। দলটি তার প্রণীত খসড়া সংবিধানে শরিয়াকে আইনের প্রধান উৎস হিসেবে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপনের সিদ্ধান্ত নেয়ায় অনেক সালাফি রীতিমতো ক্ষেপে যায়। তেমনি তারা ক্ষেপে ওঠে মেয়েদের ওপর বোরকা না চাপানো এবং মদ্যপান ও সুদ খাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ না করার প্রতিশ্রুতিতে। দেশটা ধর্মনিরপেক্ষতার পথ পরিগ্রহ করায় এবং রাজনীতিতে নিজেদের তেমন কোন ভূমিকা না থাকায় অসন্তুষ্ট হয়ে অনেক সালাফি দেশে-বিদেশে বিক্ষোভ ও সহিংসতার পথ বেছে নিয়েছে। সালাফিরা রাজনীতিতে সংশ্লিষ্ট হওয়ার ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দেয়ায় জিহাদীরা লাভবান হওয়ার ঝুঁকি দেখা দিয়েছে। তিউনিসিয়া এখন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) বিদেশী যোদ্ধাদের সর্ববৃহৎ উৎস। অন্যান্য যেসব দেশে সালাফিদের রাজনৈতিক প্রভাব তেমন কিছু নেই, যেমন- জর্ডান, লেবানন ও মরক্কোÑ সেসব দেশেরও বিপুল সংখ্যক যোদ্ধাকে টেনে নিয়েছে আইএস। তবে কুয়েত অর্থাৎ যেখানে সালাফিদের এখনও শক্তিশালী প্রভাব আছে সেখান থেকে তেমন বেশি একটা যোদ্ধাকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। জঙ্গীরা তাদের ওপর চড়াও হতে পারে এই ভাবনায় অস্বস্তিতে থাকা সরকারগুলো সালাফি নেতাদের সাহায্য নিয়েছে। কেউ কেউ বিশুদ্ধবাদীদের তাদের অন্তর্মুখী দৃষ্টিভঙ্গির জন্য জিহাদী মতবাদের বিরুদ্ধে পাল্টা শক্তি হিসেবে দেখছে। মরক্কো আরও বেশি সংখ্যক সালাফিকে রাজনৈতিক অঙ্গনে টেনে আনার চেষ্টা করেছে। ২০০৩ সালে সন্ত্রাসবাদের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত বিশিষ্ট সালাফি নেতা আবদুল করিম শাদলি সম্প্রতি সেখানকার সরকারবান্ধব রাজনৈতিক দল ডেমোক্রেটিক এ্যান্ড সোশ্যাল মুভমেন্টে যোগদান করেছেন এবং অন্যান্য সালাফিকেও তার সঙ্গে নিয়ে আসার অঙ্গীকার করেছেন। সালাফিরা এখন আর রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হওয়ার কোন কারণ হয়ত দেখছেন না। মিসরের নূর পার্টির মুখপাত্র নাদের বাকার স্বীকার করেন যে, ‘অনেকে বলে আমরা বিপ্লবের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি। আমরা সরকার ও কর্তৃপক্ষকে সমর্থন দিয়েছি।’ তিনি মনে করেন, তার দল যে টিকে আছে সেটাই দলটির প্রধান সাফল্য বা অর্জন। তবে রাজনীতিতে সক্রিয় সালাফিরা ইসলামী রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যের পথে তেমন কোন অগ্রগতি অর্জন করতে পারেনি। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×