ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অসহায় করেছে আঁখিকে

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ৪ জুলাই ২০১৫

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অসহায় করেছে আঁখিকে

শর্মী চক্রবর্তী ॥ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিচয়। পরিচয় থেকে প্রেম। একপর্যায়ে প্রেমের টানে মোবাইল ফোনে বিয়ে হয় প্রেমিক যুগলের। কিন্তু প্রতারণা আর যৌতুকের জন্য নির্যাতনের ফলে সংসারে শুরু হওয়া টানোপোড়নে আজ সেই প্রেমিকা আইনের দারপ্রান্তে। নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সেলে স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন প্রতারণা আর যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার সুরাইয়া জান্নাত আঁখি। তবে তার এই অভিযোগ স্বামী-সংসার ফিরে পাওয়ার জন্য নয়, ছেলেকে তার অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার জন্য। গত মঙ্গলবার রাজধানীর ইস্কাটনে অবস্থিত নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সেলে হাজিরা দিতে আসেন আঁখি। তখন তার সঙ্গে কথা হলে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমি শিক্ষিত মেয়ে হয়েও একটা বড় ভুল করেছি, কিছু না বুঝে এমন একটা প্রতারককে বিয়ে করেছি। তার জন্য আমার জীবনটা শেষ হয়ে গেছে। এখন আমি বুঝতে পারছি সে আমাকে ভালবেসে নয় আমার বাবার টাকাকে ভালবেসে বিয়ে করেছিল। সে আর আমাদের চায় না। কিন্তু আমার ছেলে তো এই পৃথিবীতে এসে কোন অন্যায় করেনি। সে তো স্বীকৃতিপ্রাপ্ত এই সমাজের সন্তান। তবে কেন সে এতিমের মতো বেঁচে থাকবে? তার অধিকার কেন তাকে দেয়া হবে না? তার অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার জন্যই আমি নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সেলে অভিযোগ করেছি। আমি শুধু ন্যায্য বিচার চাই, আর কিছুই চাই না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেমন অনেক ভাল কিছু হয়, তেমনি অনেকে প্রতারণার শিকার হয়। অনেকের জীবন শেষ হয়ে যায়। এমনই ঘটনা ঘটেছে রামপুরা ওয়াপদা রোডের বাসিন্দা বিবিএ-এমবি করা শিক্ষিত নারী সুরাইয়া জান্নাত আঁখির সঙ্গে। প্রতারণার শিকার হওয়ার পরও প্রেমের টানে বিয়ে করেছিলেন স্বামী আশিক ইকবাল সুভাষকে। কিন্তু স্বামী ও তার পরিবারের সদস্যদের নির্যাতনে সংসার করতে পারেননি আঁখি। পাননি স্ত্রীর অধিকার। দুই বছরের শিশুসন্তান আরহানকেও বঞ্চিত করেছে সকল অধিকার থেকে। ছেলের অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার জন্য আঁখি ঘুরে বেড়াচ্ছেন আইনের দ্বারে দ্বারে। ব্যবসায়ী বাবার একমাত্র মেয়ে আঁখি। পড়াশোনা করেছেন একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে। মা-বাবা আর একটি ছোট ভাই নিয়ে সুখী পরিবার ছিল তাদের। আঁখি জানান, পড়াশোনা করা অবস্থায় ২০১০ সালে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া বন্ধুদের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পরিচয় হয় মুন্সীগঞ্জের বিক্রমপুরের শেখ আশিক ইকবাল সুভাষের সঙ্গে। প্রতিদিন ফেসবুকে তাদের কথা হতো। ছেলেটি তখন তার পরিচয় দিতে গিয়ে বলে, সে অস্ট্রেলিয়াতে থাকে এবং দেশে থাকা অবস্থায় তার পড়াশোনা শেষ হয়ে গেছে, যা ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা। এর কিছুই জানত না আঁখি। দু’জনের সবকিছু জানার পর তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়। ধীরে ধীরে এই বন্ধুত্ব রূপ নেয় প্রেমে। স্কাইপের মাধ্যমে দু’জনের দেখা হতো প্রতিদিন। প্রেমের গভীরতা দিন দিন প্রখর হতে থাকল। সরাসরি দু’জনের দেখা না হলেও একজন আরেকজনের জন্য পাগল। কেউ কাউকে ছাড়া বাঁচবে না। কিন্তু তখনও আঁখি জানে না সত্য কোন কথা। এভাবে চলতে থাকে তাদের যোগাযোগ। এক বছর যাওয়ার পর দু’জনেই সিদ্ধান্ত নেয় তারা বিয়ে করবে। তখনও সুভাষ দেশের বাইরে থাকে। বাইরে থাকা অবস্থায় ২০১১ সালের ২০ আগস্ট দু’জনে কোর্ট ম্যারেজ করে এবং মোবাইল ফোনে বিয়ে করে। তখন দু’জনের পরিবারের কেউ জানে না তাদের এই বিয়ের খবর। এভাবে দুই বছর চলে যায় ফেসবুকে আর মোবাইলে কথা বলে। এরপর এক সময় আঁখির পরিবার তাকে বিয়ে দেয়ার জন্য পাত্র খুঁজতে শুরু করে এবং তাকে জানায়। তখনই আঁখি মরিয়া হয়ে সুভাষকে জানান তার পরিবারের সিদ্ধান্তের কথা এবং তখন সুভাষকে বলে দেশে এসে তার পরিবারের সঙ্গে কথা বলার জন্য। বিয়ে করার জন্য যখন আঁখির পরিবার তার ওপর চাপ দিতে শুরু করে তখনই আঁখি তার পরিবারের কাছে সুভাষের কথা বলে দেন এবং তার সঙ্গে বিয়ের কথাও বলে দেন। এসব কথা শুনে প্রথমে পরিবার রাজি না হলেও একপর্যায়ে মেয়ের অনুরোধে ওই ছেলেকে দেখা করতে বলা হয়। সব কথা শুনে সুভাষ ২০১৩ সালের শুরুতে ছয় মাসের ছুটিতে দেশে আসে। তখনই একে একে সব সত্য আঁখির কাছে প্রকাশ হতে থাকে। সে জানতে পারে সুভাষ অস্ট্রেলিয়াতে নয়, সৌদি আরবে থাকে। এছাড়া সে পড়লেখাও বেশি করেনি। কোন রকম দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ে পড়ালেখা ছেড়ে দেয়। এসব কথা শুনে আঁখির মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। কিন্তু তখন সে নিরুপায়। কারণ একদিকে ভালবাসার মানুষকে ছাড়তে পারছেন না, অন্যদিকে দু’জনেই বিবাহিত। তখন আঁখি সবকিছু ভেবে সিদ্ধান্ত নেন তাকেই বিয়ে করবেন। সেই ভাবনা থেকেই ২০১৩ সালের মার্চের ১ তারিখে দুই পরিবারের সম্মতিতে তাদের বিয়ে হয়। বিয়ের শুরুতে প্রথম ভালই যায় তাদের। এরপরই শুরু হয় পরিবারের সদস্য আর স্বামীর নির্যাতন। শাশুড়ি আর ননদরা কথায় কথায় টাকার জন্য চাপ দিত। এমনকি সারাদিন কাজ করেও ঠিকমতো খাবার পেতো না। খেতে বসলেই বলত, বাপের বাড়ি থেকে কী দিছে তোরে যে তুই খাবি। তখন আঁখি অন্তঃসত্ত্বা। অন্যদিকে স্বামী সুভাষও তাকে বাবার বাড়ি থেকে টাকা আনার জন্য চাপ দিতে শুরু করে। সৌদি আরবে তার আয় তেমন ভাল না তাই সে দেশে ব্যবসা করবে। তাদের নির্যাতনের একপর্যায়ে আখি তার বাবার কাছ থেকে এক লাখ টাকা এনে দেয়। টাকা আনার পর সুভাষ চলে যায় সৌদি আরব। স্বামী চলে যাওয়ার পর শাশুড়ি আর ননদদের নির্যাতন দিন দিন বাড়তেই থাকে। একপর্যায়ে সে বাবার বাসায় চলে যায়। তখন থেকেই শুরু হয় আঁখির জীবনের সব কষ্ট। সুভাষ দেশের বাইরে গিয়ে আঁখির সঙ্গে যোগাযোগ প্রায় বন্ধ করে দেয়। ফোন দিলেই বলে তোর বাবার বাড়ি থেকে পাঁচ লাখ টাকা এনে দে তাহলে আমি তোর সঙ্গে সংসার করব। অনেক চেষ্টা করেও সুভাষকে বোঝাতে পারেননি আঁখি। সে অন্য মেয়েদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে কিন্তু নিজের ছেলের খবর নেয় না, এমনকি তার পরিবারের কেউ আয়হানের জন্মের পর থেকে এখন পর্যন্ত দেখতে আসেনি। আঁখি বলেন, তার সঙ্গে সংসার করার জন্য অনেক চেষ্টা করেছি আমি কিন্তু তাকে কোনভাবেই বুঝাতে পারিনি। সে টাকা ছাড়া আমার সঙ্গে সংসার করবে না। আমি তার পরিবারের সঙ্গেও অনেকবার যোগাযোগ করেছি। তারা আমাকে বলে, তোর মতো মেয়ে আমাদের দরকার নেই। আমার ছেলেকে অন্য জায়গায় বিয়ে দিলে ভাল টাকা পাব। এসব কথা শোনার পর ২০১৫ সালের এপ্রিলে আঁখি সুভাষকে ডিভোর্স দেন। ডিভোর্সের পরও চেষ্টা করেছেন সংসার করার জন্য কিন্তু তা হলো না। এখন সন্তানকে তার অধিকার ফিরিয়ে দিতে পারবেন কি-না, তাও জানেন না। এ বিষয়ে সুভাষের বড় ভাই শেখ মারুফের সঙ্গে কথা বললে তিনি এ বিষয়ে কোন কথা বলতে রাজি হননি। এছাড়া এসব তার ভাইয়ের বিষয় বলে এড়িয়ে যান।
×