ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সংস্কৃতি সংবাদ

প্রয়াণবার্ষিকীতে কথা ও কবিতায় কবি আবুল হোসেন স্মরণ

প্রকাশিত: ০৬:৪২, ৩ জুলাই ২০১৫

প্রয়াণবার্ষিকীতে কথা ও কবিতায় কবি আবুল হোসেন স্মরণ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ একটানা সত্তর বছর কাটিয়েছেন কবিতার সঙ্গে। সাত দশক ধরে নিবিড় পরিচর্যায় করে গেছেন কবিতার চাষ। কাব্যের চরণে চরণে বলেছেন সমাজ, রাজনীতি ও মানুষের কথা। তিনি হচ্ছেন আধুনিক বাংলা কবিতার পথিকৃৎ কবি আবুল হোসেন। থরথর কম্পন তোলা আবেগের পরিবর্তে কবিতার শরীরজুড়ে সৃজন করেছিলেন বাকসংযম। উচ্ছ্বাসের রঙকে ছাপিয়ে পরিশীলনপ্রবণতাই ছিল তাঁর কাব্যের বৈশিষ্ট্য। আর এভাবেই আবুল হোসেন বাংলাদেশ ও বাংলা কবিতায় আধুনিক বোধ ও মননের প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। গত ২৯ জুন ছিল ত্রিকালদর্শী এই কবির প্রথম প্রয়াণবার্ষিকী। এ উপলক্ষে বৃহস্পতিবার আষাঢ়ের বিকেলে স্মরণ করা হয় কবিকে। কবি, কথাসাহিত্যিক ও বিশিষ্টজনদের নিবেদিত কথায় অঞ্জলি জানানো হয় আবুল হোসেনকে। সঙ্গে ছিল তাঁর রচিত কবিতার শিল্পিত উচ্চারণের আবৃত্তি এবং স্বজনদের স্মৃতিচারণ। প্রদর্শিত হয় কবিকে নিয়ে নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র। বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্য মিলনায়তনে এ স্মরণানুষ্ঠানের আয়োজন চন্দ্রাবতী একাডেমি। স্মরণসভায় আবুল হোসেনকে নিবেদিত আলোচনায় অংশ নেন বরেণ্য কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, প্রখ্যাত কবি আসাদ চৌধুরী, কবি ও প্রাবন্ধিক মনজুরে মওলা এবং প্রাবন্ধিক, গবেষক ও ফোকলোরবিদ শামসুজ্জামান খান। এমিরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্মৃতিচারণ করেন আবুল হোসেনের শ্যালিকা অধ্যাপিকা সালমা রহমান। আর কবিকে নিয়ে পারিবারিক কিছু উদ্যোগের কথা জানান তাঁর ছেলে সেলিম আর এফ হোসেন। স্বাগত বক্তব্য রাখেন চন্দ্রাবতী একাডেমির নির্বাহী পরিচালক কামরুজ্জামান খন্দকার। আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে আবুল হোসেনের কবিতা থেকে পাঠ করেন খ্যাতিমান আবৃত্তিশিল্পী মাহিদুল ইসলাম। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন শিশুসাহিত্যিক আলী ইমাম। সভাপতির বক্তব্যে আনিসুজ্জামান বলেন, গত শতকের ত্রিশের দশকের শেষ দিকে নতুন বাঁক নেয় মুসলিম সাহিত্যচর্চা। এই কবি ও সাহিত্যিকদের মধ্যে সামনের সারিতে ছিলেন ফররুখ আহমেদ, আবুল হোসেন, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। এদের মধ্যে সবার আগে আবুল হোসেনের নববসন্ত শিরোনামের কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। যদিও গ্রন্থটিতে তাঁর কবিতার বৈশিষ্ট্য আধুনিকতার সম্পূর্ণ প্রতিধ্বনি নেই। তাঁর পরবর্তী কাব্যগ্রন্থগুলোর খুঁজে পাওয়া যায় সেই কাক্সিক্ষত আধুনিকতার প্রতিচ্ছবি। আবুল হোসেন মানুষের মুখের ভাষাকে কবিতার ভাষায় রূপ দিয়েছিলেন। চারপাশের দেখা জগতকে মেলে ধরেছিলেন কবিতায়। শান্তি নিকেতনে গিয়ে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সরাসরি সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের প্রতি অনুরাগ থাকলেও সমর সেনের কাব্যরীতি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন আবুল হোসেন। আর অসাধারণ সব কবিতার জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন কবিতানুরাগীদের হৃদয়ে। তাঁর আত্মজীবনী পড়লে বোঝা যায় তিনি কতটা সমাজ ও রাজনীতি সচেতন ছিলেন। নিজের সঙ্গে সম্পর্কের কথা তুলে ধরে বলেন, তাঁর সান্নিধ্য পাওয়াটা ছিল আমার কাছে অনেক বড় প্রাপ্তি। আর তিনি আমাকে স্নেহ করতেন সেটা ছিল আমার সৌভাগ্য। সেলিনা হোসেন বলেন, নববসন্ত কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের পর থেকেই কবি হিসেবে সবার নজর কাড়েন আবুল হোসেন। সুর-ব্যঞ্জনা ও জীবনবোধের চৈতন্য ছিল তাঁর কবিতার বৈশিষ্ট্য। সমাজের অসঙ্গতির কথা তুলে ধরে তাঁর কবিতার চরণে নিপুণভাবে উঠে এসেছে শাণিত বিদ্রƒপ। নিভৃতচারী কবি হলেও চারপাশকে দেখার দৃষ্টি ছিল অনেক প্রসারিত। কবিতাকে একইসঙ্গে বিস্তৃত ও শিল্পিত রূপ দিয়েছিলেন তিনি। আসাদ চৌধুরী বলেন, তাঁর কবিতা যখন পড়ার কথা ছিল তখন পড়িনি। পড়েছিলাম ষাটের দশকে। সমকালীন বিষয়কে তিনি অনায়াসে উপস্থাপন করেছিলেন কবিতায়। কারণ, তিনি সমাজের খুঁটিনাটি বিষয়কে উপলব্ধি করতে পারতেন। আর মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন মুক্ত মনের। কথা শেষে আবুল হোসেনের ‘আমি একা’ ও ‘আমি যাবার’ আগে কবিতা দুটি পাঠ করেন আসাদ চৌধুরী। মনজুরে মওলা বলেন, অসামান্য অবদান না রাখলে কাউকে স্মরণ করা হয় না। কবিতায় তেমনই অবদান রেখেছেন আবুল হোসেন। এ কারণেই আজ তাঁকে স্মরণ করা হলেও প্রকৃত অর্থে কবির মৃত্যু নেই। কবি কখনও যায় না। আবুল হোসেন এমন মানুষ ও কবি ছিলেন যিনি সময়ের স্মরণীয়। তিনি ছিলেন আমাদের সময়ের কবিতার দুরন্ত প্রাণপুরুষ। স্মরণসভায় পারিবারিক জীবনের স্মৃতিচারণ করেন কবির শ্যালিকা সালমা রহমান। আর বাবাকে নিয়ে পারিবারিক কিছু উদ্যোগের কথা জানান কবির ছেলে সেলিম আর এফ হোসেন। তিনি বলেন, তাঁর স্মরণে অনলাইনে একটি ওয়েবসাইট খোলা হবে। এতে তাঁর জীবনীসহ কবিতা ও অন্যান্য লেখা থাকবে। এছাড়া উইকিপিডিয়াতেও তার জীবনী তুলে ধরার উদ্যোগ নেয়া হবে। কবি আবুল হোসেন সাহিত্য ও কবিতা পদক প্রবর্তন করা হবে। এছাড়াও তিনি কবি আবুল হোসেন স্মারকগ্রন্থ প্রকাশের জন্য তিনি বাংলা একাডেমির প্রতি অনুরোধ জানান। আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে মাহিদুল ইসলামের কণ্ঠে আবুল হোসেনের কবিতার শিল্পিত উচ্চারণ ভিন্ন মাত্রা যোগ করে স্মরণসভায়। এই আবৃত্তিশিল্পী পাঠ করেন ‘পুত্রদের প্রতি’, ‘কয়েকজন বিদেশী সংবাদদাতার উদ্দেশে’, ‘এ দেশ আমার একা’, ‘উত্তরাধিকার’, ‘তিরিশ টাকার মাইনেতে’, ‘নায়ক’ ও ‘দেব, সব দেব’ শিরোনামের একগুচ্ছ কবিতা।
×