ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এম আর মাহবুব

স্মরণ ॥ আলাউদ্দিন আল আজাদ ॥ প্রতিকৃতি

প্রকাশিত: ০৪:৩৬, ৩ জুলাই ২০১৫

স্মরণ ॥ আলাউদ্দিন আল আজাদ ॥ প্রতিকৃতি

সাহিত্য জগতে আলাউদ্দিন আল আজাদ এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। ভাষাসৈনিক, মুক্তিযোদ্ধা, কবি, সব্যসাচী লেখক, শিক্ষাবিদ নানা বিশেষণ রয়েছে তাঁর নামের পাশে। বিশ্বসাহিত্য জগতেও তিনি একজন দীপ্তিমান প্রতিভা, যিনি স্বকীয় মহিমায় উদ্ভাসিত এক সাহিত্যশিল্পী। তিনি বহু রচনায় সমাজগতি ও মানববিচরণ রূপায়ণে যেমন বিশেষ সার্থকতার সঙ্গে রূপক ও প্রতীক ব্যবহার করেছেন, তেমনি রোমান্টিকতা এবং মাটি ও মানুষের প্রতি কমিটমেন্ট ছিল তাঁর কবিতার স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর। এভাবেই কালক্রমে তিনি নির্মাণ করেছেন মানুষ, তার বসবাসের ভূমি, তার অবস্থান-রাষ্ট্রের কাঠামো ও চরিত্র এবং অমিত সম্ভাবনার সূত্রাবলীর অশেষ কথামালা। আলাউদ্দিন আল আজাদকে তাই বলা চলে আমাদের কালের কবি, আমাদের চেতনার বর্ণনাকারী শিল্পী; পর্যায়ক্রমিক রূপান্তরশীল এক অনন্য প্রতিভা। দেশবরেণ্য এই কবি ২০০৯ সালের ৩ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন। আজ কবির ৭ম মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁকে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়। আলাউদ্দিন আল আজাদ ১৯৩২ সালের ৬ মে নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার রামনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা গাজী আব্দুস সোবহান এবং মা মোসাঃ আমেনা খাতুন। আলাউদ্দিন আল আজাদ অভিজাত, বনেদি ও সাংস্কৃতিক পরিবারে জন্ম নিলেও শৈশবটা তেমন সুখকর ছিল না। গ্রাম্যজীবনে কৃষিভিত্তিক নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের আর্থিক অসচ্ছলতা ছিল তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী। দেড় বছর বয়সে মা মারা যান এবং দশ বছর বয়সে বাবা। সেই থেকে অনেকটা অভিভাবকহীন আজাদের সংগ্রামী জীবনের শুরু। আলাউদ্দিন আল আজাদ ছিলেন বামপন্থী চিন্তাধারার একজন প্রগতিশীল মানুষ। পথে-মাঠে-ময়দানে ও শিল্পকর্মে আলাউদ্দিন আল আজাদ মার্ক্সসীয় ভাবধারাকে সমুন্নত রাখার জন্য ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষাজীবন রামনগর জুনিয়র মাদ্রাসা, ১৯৩৭-৪২, মাধ্যমিক-নারায়ণপুর শরাফতউল্লাহ উচ্চবিদ্যালয়, ১৯৪৯ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আইএ পাস করেন। ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্সে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম এবং ১৯৫৪ সালে প্রথম শ্রেণীতে এমএ পাস করেন। ১৯৫৫ সালে তোলারাম কলেজে প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ঈশ্বর গুপ্তের জীবন ও কবিতা বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন। পরবর্তীকালে সিলেট এমসি কলেজ, চট্টগ্রাম কলেজসহ পাঁচটি সরকারী কলেজে অধ্যাপনা এবং পরবর্তীকালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালে তিনি ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপালও ছিলেন। পেশাগত জীবনে মস্কোর বাংলাদেশ দূতাবাসে সংস্কৃতি উপদেষ্টা, শিক্ষা সচিব, সংস্কৃতিবিষয়ক বিভাগ ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়েও তিনি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্ণাঢ্য ও বিশাল কর্মজীবন ছাড়াও তিনি বিভিন্ন সরকারী, বেসরকারী সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত থেকে দেশ ও জাতির জন্য সেবামূলক কাজ করে গেছেন। রুশ সাহিত্যের ভক্ত, তলস্তয় ও গোর্কির অনুরাগী। বাংলাদেশের সাহিত্যের ইতিকথা এবং আবহমান বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার প্রতিও ছিল তাঁর বিশেষ ঝোঁক। তাঁর স্বাতন্ত্র্য এবং ঐশ্বর্য বাংলা কবিতাভুবনে নিঃসন্দেহে এক অনন্য সংযোজন। স্বদেশপ্রেম, সমাজ-সচেতনতা এবং সংগ্রামী চেতনা তাঁর কবিতাচর্চার প্রধান কেন্দ্রভূমি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ভাষা আন্দোলনে তিনি সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। একুশের রক্তাক্ত ঘটনার পর তারই উদ্যোগে সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় বুলেটিন। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সৈনিক তিনি। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা নিয়ে রচিত ‘ফেরারি ডায়েরি’ সমকালীন ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় দলিল। ছিলেন জনপ্রিয় টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব। তিনি বাংলা একাডেমি, ইউনেস্কো ও একুশে পদকসহ দেশ-বিদেশের বহু সম্মাননা পদক লাভ করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : ছোটগল্প-জেগে আছি ১৯৫০, ধানকন্যা ১৯৫১, জীবন জমিন ১৯৮৮, নির্বাচিত গল্প ১৯৮৫, মনোনীত গল্প ১৯৮৭, শ্রেষ্ঠগল্প ১৯৮৭ এবং ১৯৯৯, শ্রেষ্ঠ ছোটগল্প ১৯৯৯। উপন্যাস : তেইশ নম্বর তৈলচিত্র ১৯৬০, কর্ণফুলী ১৯৬২, ক্ষুধা ও আশা ১৯৬৪, খসড়া কাগজ ১৯৮৬, জ্যোৎ¯œার অজানা জীবন ১৯৮৬, স্বাগতম ভালবাসা ১৯৯০, অপর যোদ্ধারা ১৯৯২, পুরানা পল্টন ১৯৯২, পুরুদ্রুজ ১৯৯৪, ক্যাম্পাস ১৯৯৪, কায়াহীন ছায়াহীন ১৯৯৯, শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ১৯৯৯। কবিতা : মানচিত্র ১৯৬১, ভোরের নদীর মোহনায় জাগরণ ১৯৬২, সূর্য জ্বালার সোপান ১৯৬৫, লেলিহান পা-ুলিপি ১৯৭৫, নিখোঁজ সনেটগুচ্ছ ১৯৮৩, এ্যাসেস এ্যান্ড স্পার্কস ১৯৮৪, সাজঘর ১৯৯০, চোখ ১৯৯৬, শ্রেষ্ঠ কবিতা ১৯৮৭, শ্রেষ্ঠ কবিতা ১৯৯৯। নাটক : ধন্যবাদ ১৯৫১, নিঃশব্দ যাত্রা ১৯৭২, নরকে লাল গোলাপ ১৯৭২, জোয়ার থেকে বলছি ১৯৭৪, মেঠোফুলের ঠিকানা ১৯৭৫, হিজলকাঠের নৌকা ১৯৭৬, হে সুন্দর জাহান্নাম ১৯৮৮। কাব্যনাট্য : ইহুদির মেয়ে ১৯৬২, রঙ্গিন মুদ্রারাক্ষস ১৯৯৪, শ্রেষ্ঠ নাটক ১৯৯৯। জীবনীগ্রন্থ : আজিতকুমার গুহ ১৯৮৯, মুজফ্ফর আহমদ ১৯৯০, হামিদুর রহমান ১৯৯২, রশিদ চৌধুরী ১৯৯৪। শিশু সাহিত্য : উপন্যাস-জলহস্তী ১৯৮২, রসগোল্লা জিন্দাবাদ ১৯৯৪, জন্মভূমি ১৯৯৯। কিশোর সমগ্র ২০০০। বিদেশে প্রকাশিত রচনাবলী : পোত্রেত নোমের ২৩, বুলগেরীয় অনুবাদ জেসকা গিয়োরগিয়েভা পকেটবই, প্রকাশক, নরোদনা কুলতুরা, সোফিয়া ১৯৮২, তেইশ নম্বর তৈলচিত্রের অনুবাদ, হুজান মালয় অনুবাদ আবদুল্লা হোসেন অলঙ্ককরণ আবদুর রহমান, মোহাম্মদ, প্রকাশক বাহানা ব্রুনাই ভাষা ও সাহিত্য বোর্ডের মাসিক পত্রিকা আগস্ট সংখ্যা ১৯৮৮, (ছোটগল্প বৃষ্টির অনুবাদ), পোট্টেট অব পুশকিন, মৌলিক ইংরেজী কবিতা দ্য ইন্টারন্যাশনাল ডাইরেক্টরি অব ডিস্টিংগুইসট লিডারশিপ তৃতীয় সংস্কার ১৯৯১, নর্থ ক্যারোলিনা, যুক্তরাষ্ট্র, সহস্রাব্দের প্রথম। আলাউদ্দিন আল আজাদের মৃত্যুদিনে আমরা তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি।
×