(পূর্ব প্রকাশের পর)
অধ্যায়-১
ঔপনিবেশিক যুগ ও বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম
অনুধাবনমূলক প্রশ্নোত্তর :
৩. ইংরেজ : ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ড দি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি স্থাপিত হয়। ১৬৫১ সালে হুগলিতে ও ১৬৫৮ সালে কাশিমবাজারে বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করে পরবর্তীতে তারা সৈন্য এনে ব্যবসার অধিকার লাভ করে। এর সাথে স্থানীয় শক্তি ও অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী ইউরোপীয় শক্তির ওপর প্রাধান্য বিস্তার লাভ করে। ঔপনিবেশিক বিজয়ের মাধ্যমে ভারতবর্ষে প্রায় ২শ’ বছরের শাসন শোষণ কায়েম করে।
৪. দিনেমার : ডেনমার্কের লোকদের ডেনিশ বা দিনেমার বলা হয়। ১৬১৬ সালে ডেনিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গঠন করে এ দেশে আসে। তাঞ্জোরের ট্রাঙ্কুবার এবং পশ্চিম বাংলা শ্রীরামপুরে বাণিজ্য কুঠি গড়ে তুললেও তারা খুব বেশি সুবিধা করে উঠতে পারেনি।
৫. ফরাসি : ইউরোপীয় শক্তিগুলোর মধ্যে সর্বশেষে আসে ফরাসিগণ। ১৬৬৪ সালে তারা ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গঠন করে। ধীরে ধীরে তারা সুরাট, পন্ডিচেরি, চন্দননগর, মাহে, কারিকল, মসলি পট্টম, বালেশ্বর, কাশিমবাজার প্রভৃতি স্থানে বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করে। তবে ইংরেজদের সাথে তিন দফা যুদ্ধে হেরে তারাও প্রায় এক শ’ বছরের বাণিজ্য গুটিয়ে ইন্দোচীনের দিকে চলে যায়।
এভাবে ইউরোপীয় নানা শক্তি বাণিজ্যের সূত্র ধরে ভারতবর্ষে আগমন করে ও অর্থনৈতকি শোষণ করতে থাকে।
৭. বহিরাগত শাসনামলে বাংলার অবস্থা কেমন ছিল?
উত্তর : বাংলার ইউরোপীয় শক্তির বিকাশকালীন এদেশের প্রজাদের অবস্থা বেশ শোচনীয় ছিল। মূলত জাহাঙ্গীরের আমল থেকে বাংলা থেকে ক্রমাগত পুঁজি পাচারের ফলে প্রজাদের ওপর শোষণ নিপীড়ন অনেকখানি বেড়ে যায়। সুবেদার শায়েস্তা খানের আমলে জিনিসপত্রের দাম সস্তা হলেও জনগণের অর্থনৈতিক দশা এতটাই খারাপ ছিল যে তাদের ক্রয়ক্ষমতা বলতে আসলে কিছুই ছিল না। তাই চালসহ নিত্য ব্যবহার্য জিনিসের দাম অবিশ্বাস্য রকমের কম হলেও তা প্রজাদের কোনো উপকারে আসেনি। শায়েস্তা খানের কর্মচারীরা সাধারণ মানুষকে এমন শোষণ করতে যে পশুখাদ্যের (মূলত ঘাস) ব্যবসা ও তাদের এক চেটিয়া ছিল। ১৩ বছরের সুবেদারিতে শায়েস্তা খান যে পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়েছিলেন তা তখনকার বিশ্বে বিরল। তিনি অন্তত ৩৮ কোটি টাকার মালিক ছিলেন। তার দৈনিক আয় ছিল দুই লাখ টাকা। তার ওপর ভারতে মারাঠা শক্তির উদ্ভব হলে তারা বাংলার বারবার হামলা চালাতে থাকে। স্থানীয় ভাষায় এদের বর্গী বলা হতো। তাই বাংলার একটি ছড়া থেকে তৎকালীন সমাজের পরিচয় পাওয়া যায়Ñ খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো/ বর্গী এলো দেশে/ বুলবুলিতে ধান খেয়েছে/খাজনা দেবে কীসে?
৮. ছিয়াত্তরের মন্বন্তর কী?
উত্তর : দেওয়ানি লাভের পর বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা ইংরেজদের হাতে চলে যায়। রাজস্বের দায়িত্ব পেয়ে ইংরেজরা প্রজাদের ওপর অতিরিক্ত করের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে তা আদায়ে প্রচ- চাপ সৃষ্টি করে। এর ওপর পরপর তিন বছর অনাবৃষ্টির ফলে দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। তখন বাংলা ১১৭৬ সন। এটি ইতিহাসে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে পরিচিত। এই দুর্ভিক্ষে প্রায় এক কোটি লোক মারা যায় যা সেকালের বাংলার জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ, ধারণা করা হয় প্রকৃত মৃতের সংখ্যা এরও অধিক।
৯। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বলতে কী বোঝায়?
উত্তর : চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বলতে অনুগত জমিদারদের সাথে জমির ইজারা সংক্রান্ত দীর্ঘস্থায়ী বন্দোবস্তকে বুঝায়। বাংলার গভর্নর লর্ড কর্নওয়ালিস কর্তৃক জমি বন্দোবস্তের নতুন ব্যবস্থা গৃহীত হয়। এ লক্ষ্যে তিনি প্রথমে অনুগত জমিদারদের সাথে ১০ বছরের দশসনা বন্দোবস্ত করেন ১৭৯০ সালে। এই দশসনা পরবর্তীতে ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হিসেবে রূপ লাভ করে।
১০. বাংলার পরাজয় ও ঔপনিবেশিক শক্তির বিজয়ের কারণগুলো কী কী?
উত্তর : পাল বংশের পর থেকেই বাংলায় বহিরাগত শাসন চলতে থাকে। বহিরাগত শাসকদের ক্রমাগত পুঁজি পাচার, অর্থনৈতিক শোষণ, অতিরিক্ত করের বোঝা বাংলার জনগণের আর্থিক দুর্দশার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শাসকদের শোষণ, বর্গীদের হামলা, দুর্ভিক্ষের ফলে জনজীবন দুর্বিষহ। নবাব আলীবর্দীর মৃত্যুর পর তার ২২ বছর বয়সী নাতি, নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা সিংহাসনে বসেন, সিরাজের বড় খালা ঘসেটি বেগম, সিপাহসালার মীর জাফর খান, ক্ষমতালোভী স্বার্থন্বেষী বণিকগণ ইংরেজদের সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। এর ফলে পলাশীর যুদ্ধে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব তথা বাংলার পরাজয় ঘটে। এ ছাড়া ২শ’ বছরের শোষণে শাসকদের প্রতি বিমুখ ও উদাসীনতা, স্বাধীনতার অবসান সম্পর্কে ধারণার অভাব। বাংলার শাসকদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, ইংরেজদের ধূর্ত পরিকল্পনা বোঝার মতো রাজনৈতিক-সামাজিক শক্তির অভাবেই বাংলার পরাজয় ও ঔপনিবেশিক শক্তির বিজয়ের প্রধান কারণ।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: