ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

তালিকায় ছেলেরা মেয়েদের আর মেয়েরা ছেলেদের কলেজে

প্রকাশিত: ০৬:০৭, ২ জুলাই ২০১৫

তালিকায় ছেলেরা মেয়েদের আর মেয়েরা ছেলেদের কলেজে

বিভাষ বাড়ৈ ॥ প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত সক্ষমতা না থাকার পরেও এক ধাক্কায় দেশজুড়ে ডিজিটাল পদ্ধতি চাপাতে গিয়ে কলেজ ভর্তি নিয়ে রীতিমতো জগাখিচুড়ি বানিয়ে ফেলেছে শিক্ষা প্রশাসন। ভর্তির সংকট নিরসন তো দূরের কথা, মনোনীত শিক্ষার্থীদের তালিকা প্রকাশের পর চারদিন চলে গেলেও একের পর এক বেরিয়ে আসছে হয়রানি ও দুভোর্গের নানা কাহিনী। বের হয়ে আসছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বোর্ডের ব্যর্থতার নতুন কেলেঙ্কারি। ছেলেদের দেয়া হয়েছে মেয়েদের কলেজে, মেয়েদের দেয়া হয়েছে ছেলেদের কলেজে। আবার যেখানে বিজ্ঞান নেই সেখানে বিজ্ঞান, যেখানে বাণিজ্যের শাখাই নেই সেখানে পাঠানো হয়েছে শত শত বাণিজ্যের শিক্ষার্থীকে। খোদ রাজধানীর বিজ্ঞান কলেজের তালিকাতেই এসেছে ২০০ বাণিজ্যের শিক্ষার্থীর নাম! শত শত শিক্ষার্থীকে এমন সব কলেজের ভর্তির জন্য মনোনীত করা হয়েছে যেখানে ওই প্রতিষ্ঠানের কোন অস্থিত্বই নেই। প্রতিবাদে বোর্ডের সামনে বিক্ষোভ করছেন হাজার হাজার শিক্ষার্থী ও অভিভাবক। চার দিন ধরে দফায় দফায় পিছিয়ে রবিবার মধ্য রাতে মেধাতালিকা প্রকাশ করা হলেও সেই তালিকা নিয়ে এর পর থেকেই চলছে ১২ লাখ ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী ও তাদের ২৪ লাখ অভিভাবকের দুর্ভোগ। তড়িঘড়ি করে গোজামিল দিয়ে তালিকা তৈরি করায় রাজধানীর নামী দামী সব কলেজ থেকে শুরু করে দেশজুড়ে শুরু হয়েছে সংকট। প্রায় ৭০ হাজার হাজার শিক্ষার্থী অনলাইনে আবেদন করেও কোন কলেজে চান্স পায়নি, অথচ বহু কলেজে আসন খালি। চারদিন ধরে চেষ্টা করে ওয়েবসাইট থেকে তালিকা সংগ্রহ করতে পারলেও অসংখ্য ভুল ধরা পড়ায় অনেক শিক্ষার্থীকে ভর্তি করাতে পারছে না বহু নামী প্রতিষ্ঠান। ভিকারুন নিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজের তালিকায় নাম না থাকলেও ছাত্রীদের উপায় না থাকায় নিজ প্রতিষ্ঠান থেকে এসএসসি পাস করা সকলের ভর্তি নিশ্চিত করা হচ্ছে। ওয়েবসাইট থেকে তালিকায় নিয়ে ৫২ জন শিক্ষার্থী দুদিন ধরে ঘুরছে উত্তরার আজমপুরে ‘অবস্থিত’ ইউইউ ল্যাবরেটরী কলেজে ভর্তির জন্য। কিন্তু সেখানে গিয়ে তারা কোন কলেজেরই অস্তিত্ব পাননি। দুদিন ধরে ভুক্তভোগী এ শিক্ষার্থী এ নিয়ে বোর্ডে গিয়ে অবস্থান নিয়েছেন। কেউ কেউ ঠিকানায় যাচ্ছেন বারবার, জানার চেষ্টা করছেন আসলে কোন কলেজ আছে কিনা। বুধবার ওই কলেজের ঠিকানায় গিয়ে দেখা যায় একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম চলছে। বোর্ড কলেজের অস্বিত্ব কোথায় পেল সেই প্রশ্ন তুলছেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের একজন ইকবাল হোসেন। যার রোল নম্বর ১৭৬৯৩৯। ইকবাল কুমিল্লা বোর্ড থেকে এসএসসি পাস করে ঢাকায় এসেছে। কিন্তু ফলাফল এখন ‘দুর্ভোগ’। অপর ছাত্র ছাইফুল ইসলাম। যার রোল নম্বর ৪০০২৬৩। একই সংকট সাইফুলেরও। শিক্ষার্থীরা বলেছেন, আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে। আমরা প্রয়োজনে আদালতে যাব। এটা মানা যায় না। জানা গেছে, এই নামে একটি কলেজের অনুমোদন ছিল বেশ কয়েক বছর আগে। কিন্তু সে সময় কোন শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হয়নি। ফলে প্রতিষ্ঠানটি পরে আরও চালুও হয়নি। সেই সময় যারা এর সঙ্গে ছিলেন তাদের একজন বলছিলেন, আমরা বুঝি না কিভাবে বোর্ড এখন এখানে শিক্ষার্থী পাঠায়। তালিকায় কিভাবে শিক্ষার্থীরা আসে। তিনি বলছিলেন, এভাবে শিক্ষার্থীদের ভুল স্থানে পাঠানো হয়। অথচ পাশেই ট্রাস্ট কলেজে শত শত আসন খালি রাখা হয়েছে। ট্রাস্ট কলেজে ভাল অবকাঠামো থাকার পরেও সে আসন এখন খালি। কোন সমস্বয় নেই আসলে মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। গুলশানে কালাচাঁদপুর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি কেবল মেয়েদের জন্য। সেখানে একাদশ শ্রেণীতে ৩৮টি আসন রয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য বোর্ডের প্রকাশ করা মেধা তালিকায় রয়েছে ২২ জন ছেলে। এ নিয়ে বুধবারও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কলেজের শিক্ষকরা। থমকে গেছে তাদের ভর্তি প্রক্রিয়া। সোহেল আহমেদ ভর্তির জন্য মনোনয়ন পেয়েছে উত্তরা কলেজিয়েট হাইস্কুলে। ভর্তি হতে গিয়ে দেখে, এক বছর আগেই এ কলেজের স্বীকৃতি ও পাঠদানের অনুমতি বাতিল করেছে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ। সোহেল বোর্ড কার্যালয়ে এসে তার সমস্যার কথা লিখিতভাবে জানিয়েছে বোর্ডকে। উত্তরার ইউনিভার্স কলেজের তালিকায় আছে কেবল একজন শিক্ষার্থীর নাম। একটা কলেজ কি একজন শিক্ষার্থী দিয়ে চলবে? এমন প্রশ্নে বোর্ডের কর্মকর্তারা কেউ কথা বলছেন না। মন্ত্রণালয় ও বোর্ডের গাফিলতির কারণে এবার বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান সরকারী বিজ্ঞান কলেজের কাঠামো পাল্টে ফেলতে হচ্ছে। এই প্রতিষ্ঠান থেকে বাণিজ্য বিভাগের কোন শাখাই নেই। তবুও মন্ত্রণালয় ও বোর্ড বাণিজ্য বিভাগের দু’শ’ শিক্ষার্থীকে ভর্তির জন্য মনোনয়ন দিয়েছে। ঘটনা নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। বিজ্ঞান কলেজ কর্তৃপক্ষ মন্ত্রণালয় ও বোর্ডকে জানিয়েছে, এই প্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞানের বাইরের কারোই পড়ালেখার সুযোগ নেই। এমনকি বাণিজ্য বিভাগের কোন শিক্ষকও নেই। কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষের এমন অবস্থানের পরে মন্ত্রালয় ও বোর্ডের কর্মকর্তারা নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে বিজ্ঞান কলেজ কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে বাণিজ্য বিভাগের দু’শ’ শিক্ষার্থীকে ভর্তির জন্য। এ অবস্থায় কলেজ কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে এসব শিক্ষার্থীকে ভর্তি করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যদিও এদের ভর্তি করালে বিশেষায়িত এই প্রতিষ্ঠানের কাঠামোই পাল্টে ফেলতে হবে। আইন পরিবর্তন করে বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। ঢাকা বোর্ডের এক কর্মকর্তা বলছিলেন, ঘটনা এমনটা হয়েছে, আমরা মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি জানিয়েছিলাম কিন্তু সেখান থেকে বলা হয়েছে, ‘যে ধরনের কলেজই হোক আগে ভর্তি করার ব্যবস্থা করো। না হয় মিডিয়ায় আরও সমালোচনা হবে। কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মোঃ হাবিবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেছেন, ‘উর্ধতন কর্তৃপক্ষ আমাকে নিশ্চিত করেছে বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের ভর্তি করলে কোন সমস্যা হবে না। এজন্য নতুন করে শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টি তারাই নিশ্চিত করবে। কিন্তু বিজ্ঞানের শিক্ষার বিশেষায়িত এই প্রতিষ্ঠানের কাঠামো পরিবর্তন সম্পর্কে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি অধ্যক্ষ। এদিকে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এ বিষয়টিতে বলেছেন, এবারই কেবল সেখানে বাণিজ্যের শিক্ষার্থী ভর্তি হবে। আগামী বছর থেকে আর ভর্তি করা হবে না। বুধবার ঢাকা বোর্ডে গিয়ে দেখা গেছে, শত শত ভর্তিচ্ছু আর তাদের অভিভাবকরা বিক্ষোভ করছেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে আনসারদের বেগ পেতে হয়েছে। অভিভাবকদের তোপের মুখে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ায় রাজধানীর ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক ড. আশফাকুস সালেহীনকে। অভিভাবকরা বলছেন, সন্তানের ভর্তি নিয়ে এমন বিপাকে তারা আগে কখনও পড়েননি। তারা তাদের দুর্ভোগের জন্য দায়ী কর্মকর্তাদের শাস্তি দাবি করেন। কুমিল্লার কান্দিরপার এলাকার রিয়াজ ফলাফল দেখতে গিয়ে জানতে পারেন তার পছন্দের কোন কলেজতো কপালে জোটেইনি বরং তার আবেদনের পাঁচটি কলেজের মধ্যে একটি মহিলা কলেজ। মনিপুর স্কুল এ্যান্ড কলেজ থেকে পাস করা মুস্তাকিম হোসেন, লতিফ ইসলাম লিমন, শান্ত চৌধুরীসহ একাধিক শিক্ষার্থী জানান, আমরা এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছি। ধানম-ি আইডিয়াল, বিএএফ শাহীন, হারমানমেইনারসহ একাধিক কলেজে আবেদন করেছি। কিন্তু তালিকা প্রকাশের পর দেখি আব্দুল জব্বার ডিগ্রি কলেজ নামে একটি অজ্ঞাত কলেজে আমাদের মানবিক শাখার তালিকায় নাম এসেছে। এ কারণে তারা বোর্ডে এসেছেন অভিযোগ জানাতে। তাদের অভিযোগ, যে প্রযুক্তি মানুষের হয়রানি বাড়িয়ে দেয় সে প্রযুক্তির প্রয়োজন নেই। কলেজ পরিদর্শকের কার্যালয়ের বাইরে কথা হয় টঙ্গীর পাইলট স্কুলের ছাত্রী আফিয়া খাতুনের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমি আমার পছন্দমাফিক ৫টি কলেজে ভর্তির জন্য আবেদন করেছি। কিন্তু আমাকে একটি ছেলেদের কলেজে ভর্তির জন্য মনোনীত করা হয়েছে। আমি ওই কলেজটির নামও কোনদিন শুনিনি। একই সমস্যা নিয়ে বোর্ডে অভিযোগ করেছেন শাফি কালিমা নামের আরেক ছাত্রী। তাকেও ছেলেদের কলেজে ভর্তির জন্য মনোনীত করা হয়েছে। লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ এমইউ সরকারী হাইস্কুলের শিক্ষার্থী ফারিয়া হোসেন বলেন, আমি জিপিএ-৫ পেয়েছি। কিন্তু আমার কোন কলেজেই ভর্তির জন্য মনোনীত করা হয়নি। আমি আসলে জানতে চাই, এর চেয়ে ভাল ফল করা কি সম্ভব? মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল এ্যান্ড কলেজের দুই সহকারী অধ্যাপক দিলরুবা বেগম ও নাজমা পারভীন অভিযোগ করলেন, আমাদের কলেজে মানবিক বিভাগে ৫০টি আসন রয়েছে। যার বিপরীতে ভর্তির জন্য আবেদন করেছেন ৮৮ জন শিক্ষার্থী। কিন্তু কাউকে মনোনয়ন করা হয়নি। ঢাকা বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, এসএসসি পাস করা সোয়া এক লাখ শিক্ষার্থী অনলাইনে আবেদনই করেনি। এরপর আবেদন করলেও তালিকায় নাম নেই প্রায় ৭০ হাজার এসএসসি পাস করা শিক্ষার্থীর। এছাড়া প্রতিদিন ১০ বোর্ডে যেহারে অভিযোগের পাহাড় চমছে তাতে আরও এক থেকে দেড় লাখ শিক্ষার্থী এখনও সংকটে আছে। আবেদন করা শিক্ষার্থীদের বাদ দিলেও অন্তত দুই লাখ শিক্ষার্থী এখানও ভর্তি হতে পারেনি। এই সংখ্যা আর বেশি হতে পারে বলে বলছেন কর্মকর্তারা।
×