ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মসলিনের উত্তরাধিকার বাঙালীর ঐতিহ্য মুগ্ধ ক্রেতা

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ২ জুলাই ২০১৫

মসলিনের উত্তরাধিকার বাঙালীর ঐতিহ্য মুগ্ধ ক্রেতা

মোরসালিন মিজান ॥ ঈদ বলে কথা। কেনাকাটা চলছেই। তবে জামদানির আবেদন চিরন্তন। আর সব কেনাকাটা থেকে আলাদা বলতে হবে। জামদানি বাঙালীর সুপ্রাচীন ঐতিহ্য। পৃথিবী বিখ্যাত মসলিনের উত্তরাধিকার। বহু যুগ ধরে বাঙালীর মেধা, শিল্পবোধ, রুচি ও আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে আছে জামদানি। বিশেষ করে উৎসব অনুষ্ঠানে দেশীয় এই তাঁতবস্ত্র ব্যবহারের কোন বিকল্প হয় না। একই কারণে ঈদে থাকে প্রচুর চাহিদা। রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন শপিংমলে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা হয়। কিন্তু সেগুলো কতটা জামদানি? হ্যাঁ, প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। অসাধু ব্যবসায়ীরা যেনতেনভাবে প্রস্তুত জামদানিকে আসল বলে চালিয়ে দেন। দামও থাকে আকাশ ছোঁয়া। বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখেই এবার দশ দিনব্যাপী বিশেষ জামদানি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে বিসিক ও জাতীয় জাদুঘর। বিশেষ এ কারণে যে, এখানে শাড়ি নিয়ে এসেছেন মূল কারিগররা। বংশ পরম্পরায় যারা জামদানি শিল্পের সঙ্গে যুক্ত, তারা নিজেদের সেরা কাজ নিয়ে এসেছেন। জাতীয় জাদুঘর প্রাঙ্গণে সকালে আনুষ্ঠানিক এ প্রদর্শনীর উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধন করেন শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম। সভাপতিত্ব করেন বিসিক চেয়ারম্যান আহমদ হোসেন খান। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী স্বাগত বক্তব্য রাখেন। এর পর থেকেই সেখানে আসতে শুরু করেন ঐতিহ্যপ্রেমী শৌখিন মানুষ। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শাড়ি দেখেন তারা। একইসঙ্গে চলে কেনাকাটা। প্রদর্শনীতে রূপগঞ্জের বিসিক জামদানি শিল্পনগরী থেকে ৩৮টি জামদানি শাড়ি ও বস্ত্র প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে। স্টলগুলো ঘুরে দেখা যায়, বাহারী সব জামদানির সমাহার। ভাঁজ সামান্য খুলে ওপর থেকে নিচের দিকে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। হাতে তৈরি শাড়ির কী নিখুঁত বুনন! কত কত নকশা! দেখে জামদানির দীর্ঘ ইতিহাস আর ঐতিহ্যের কথা নতুন করে মনে পড়ে যায়। অনেকেই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শাড়ি দেখেন। কোন কোন শাড়ির পুরোটা জুড়ে কারুকাজ। আংশিক কাজও মুগ্ধ করে রাখে। যত বেশি কাজ, দাম ততো বেশি। সুতোর মানের উপরও দামের কম বেশি নির্ভর করে। জিয়াসমিন জামদানি উইভিং ফ্যাক্টরির একটি স্টলে গিয়ে কথা হলো কারিগর আব্দুল মজিদ মোল্লার সঙ্গে। তিনি জানান, তাঁর দাদা নানারাও এ কাজ করতেন। এখন তিনি করেন। দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি, প্রেম-ভালবাসার সবটুকু ঢেলে দিয়ে এই কাজটি করতে হয় বলে জানান তিনি। তাঁর স্টলের একটি শাড়িতে আঙুর ফলের থোকার মতো দেখতে ডিজাইন। কারিগরদের ভাষায়Ñ আঙুর জাল ডিজাইন। পাশের স্টলে আরেকটি জামদানি বেশ দৃষ্টি কাড়ল। এখানে শাড়ির জমিনে মাটির কলসের মতো নকশা। নিজেদের দেয়া নাম তাইÑ কলস তেসড়ি ডিজাইন। ছোপা ডিজাইন, ছোটজাল ডিজাইন ইত্যাদি নামেও আছে কিছু কাজ। হাজী কফিল উদ্দিন জামদানি উইভিং ফ্যাক্টরির স্টলে গিয়ে দেখা গেল, একটি জামদানির দাম ৫০ হাজার টাকা। আলী আজগর জামদানি উইভিং ফ্যাক্টরির স্টলে আজ বৃহস্পতিবার থেকে ওঠছে ১ লক্ষ ও দেড় লক্ষ টাকা দামের জামদানি। এত যে দাম, কেন? জানতে চাইলে কারিগররা জানান, একটি শাড়ি তৈরির কাজ করেন দুইজন কারিগর। এর পরও তিন থেকে সাড়ে তিন মাসও লেগে যায় একটি শাড়ি বুনতে। দাম বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে সুতোও। রিফাত জামদানি উইভিং ফ্যাক্টরির কারিগর শাহজাহান জানান, জামদানি শাড়িতে তিন রকমের সুতো ব্যবহার করা হয়Ñ টানা সুতো, বাইন সুতো ও নকশা সুতো। সব সুতোই যখন কটন হয় তখন শাড়িটি হয় সব দিক দিয়ে উন্নত। দাম তখন বেশি হয়। তবে এই দাম ঢাকার শপিংমলগুলোর তুলনায় অনেক কম বলে জানান তাঁরা। একজন প্রবীণ ভাল বললেন। তাঁর কিছুটা বেদনা মেশানো উচ্চারণÑ টাকা দিয়ে জামদানির দাম কেউ দিতে পারবে না। আমরা আমাদের সব ভালবাসা শ্রম দিয়ে এই জামদানি উপহার দেই। এই কথা থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার যে, প্রদর্শনীতে ভাল কাজটাই প্রাধান্য পেয়েছে। যারা প্রকৃতটা কিনতে আগ্রহী প্রদর্শনী ঘুরে আসতে পারেন। প্রদর্শনী আগামী ১০ জুলাই পর্যন্ত প্রতদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকবে।
×