ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

তারেকের হস্তক্ষেপ বন্ধ না হলে বিএনপি ছাড়বেন সিনিয়র নেতারা

প্রকাশিত: ০৬:০০, ২ জুলাই ২০১৫

তারেকের হস্তক্ষেপ বন্ধ না হলে বিএনপি ছাড়বেন সিনিয়র নেতারা

শরীফুল ইসলাম ॥ দলীয় কর্মকা-ে তারেক রহমানের হস্তক্ষেপ মানতে পারছেন না বিএনপির সিনিয়র নেতারা। এই হস্তক্ষেপ বন্ধ না হলে তারা বিএনপির রাজনীতি ছেড়ে দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ইতোমধ্যেই তারা পরোক্ষভাবে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে বিষয়টি জানিয়ে দিয়েছেন। খালেদা জিয়া বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নিলে সুবিধাজনক সময়ে বিএনপির কিছু সিনিয়র নেতা দল ছেড়ে চলে যাবেন। সূত্র মতে, বেশ ক’বছর ধরে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া দল পরিচালনার ব্যাপারে ছেলে তারেক রহমান ছাড়া আর কোন সিনিয়র নেতার মতামত নেন না। এ কারণে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান সম্পর্কে সিনিয়র নেতাদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। আর এ কারণেই, আন্দোলন ও দল গোছানোসহ খালেদা জিয়া যে কাজেই হাত দেন গোপনে সে কাজের বিরোধিতা করেন দলীয় নেতারা। তাই এসব কাজে সফলতা অর্জন করতে পারছেন না খালেদা জিয়া। প্রসঙ্গত: বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালেই হাওয়া ভবন থেকে দল নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করতে থাকেন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান। আর এ কাজে তাকে সহযোগিতা করেন কিছু মধ্যম সারির নেতা। এ কারণে দলের সিনিয়র নেতাদের মধ্যে প্রচ- ক্ষোভের সঞ্চার হয়। দলীয় পদ ও মন্ত্রিত্ব হারানোর ভয়ে সিনিয়র নেতারা প্রকাশ্যে তারেক রহমানের কর্মকা-ের ব্যাপারে কোন প্রশ্ন তুলেননি। তবে ভেতরে ভেতরে তারা এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে শলা-পরামর্শ করতে থাকেন। এরই প্রতিফলন ঘটে বিএনপি ক্ষমতা ছাড়ার পর ওয়ান-ইলেভেনের সময়। এসব সিনিয়র নেতা খালেদা জিয়ার নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে পাল্টা বিএনপি গঠন করেন। সেই সঙ্গে তারা বিএনপি থেকে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে মাইনাস করার জোর চেষ্টা চালান। তবে সে যাত্রায় তারা পুরোপুরি সফল না হলেও খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সে ধাক্কা এখনও সামাল দিতে পারেনি। পর্যবেক্ষক মহলের মতে, ওয়ান-ইলেভেন পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা না নেয়ায় ৫বার রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা বিএনপি এখন পর্যন্ত মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনি। ২০০৮ সালের ২৯ নবেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভরাডুবির এক বছর পর ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর বিএনপির পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। যেই তারেক রহমানের জন্য দল দুরবস্থার কবলে পড়ে সেই তারেক রহমানকে ওই জাতীয় কাউন্সিলে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব থেকে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হয়। সেই সঙ্গে তাকে স্থায়ী কমিটির সদস্যের মর্যাদা দেয়া হয়। এতে করে দলের অন্য সিনিয়র নেতারা চরম ক্ষুব্ধ হন। এখনও এর মাসুল দিতে হচ্ছে দলটিকে। জানা যায়, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়ার আগে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের মতামত নেননি দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। অবশ্য লন্ডন প্রবাসী ছেলে তারেক রহমানের মতামত তিনি ঠিকই নেন। এ কারণে নির্বাচনে অংশ নিলে যাদের বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা ছিল এমন দলীয় নেতারা খালেদা জিয়ার ওপর ক্ষব্ধ হন। তাই ওই নির্বাচন প্রতিহত করতে কেন্দ্রভিত্তিক সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হলেও সিনিয়র নেতারা সহযোগিতা না করায় নির্বাচন বানচাল করতে পারেনি বিএনপি। বরং আওয়ামী লীগ সমমনা দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচন করে সরকার গঠন করে ফেলে। আর রাজনৈতিকভাবে চরম বেকায়দায় পড়ে বিএনপি। দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের মধ্যে দেখা দেয় হতাশা। এই হতাশা থেকে দলের নেতাকর্মীদের মুক্তির কোন পথই খুঁজে পাচ্ছিলেন না খালেদা জিয়া। ৬ জানুয়ারি থেকে সরকারবিরোধী টানা আন্দোলন শুরুর আগে তারেক রহমান ছাড়া বিএনপির আর কোন সিনিয়র নেতার পরামর্শ নেননি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। বাসা ছেড়ে গুলশান দলীয় কার্যালয়ে অবস্থান করে হঠাৎ করে তিনি নিজেই টানা অবরোধ কর্মসূচী পালনের ঘোষণা দেন। খালেদা জিয়ার মুখে এ ঘোষণা শুনে বিএনপির অনেক সিনিয়র নেতাই অবাক হন। তবে এ কর্মসূচীর প্রতি তাদের সায় না থাকায় খালেদা জিয়াকে না জানিয়েই কৌশলে আত্মগোপনে চলে যান তারা। সিনিয়র নেতারা রাজপথে না থাকায় দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতারাও আন্দোলনের সমর্থনে মাঠে নামেননি। এ কারণে খালেদা জিয়ার ডাকা টানা ৯২ দিনের অবরোধ ও দফায় দফায় ডাকা হরতাল ফ্লপ হয়। মাঝখান থেকে আন্দোলন সমর্থনকারী কিছু ক্যাডার ব্যাপক নাশকতামূলক কর্মকা- চালিয়ে জনমনে ঘৃণা ও ক্ষোভের সঞ্চার করেছে। তাই এ আন্দোলনে বিএনপির দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি হয়েছে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন। এদিকে সরকারবিরোধী টানা আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পর বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া সর্বস্তরে দলকে ঢেলে সাজানোর কথা বললেও এতে এখন পর্যন্ত কোন অগ্রগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। তাই দল কোন পথে চলছে তা জানেন না বিএনপির অধিকাংশ সিনিয়র নেতারাও। এ জন্য দলীয় হাইকমান্ডের কর্মকা-ের প্রতি ক্ষুব্ধ থাকলেও প্রকাশ্যে কিছুই বলছেন না তারা। তবে এ নিয়ে তারা অস্বস্তিতে রয়েছেন। সূত্র মতে. টানা অবরোধ-হরতাল কর্মসূচী সফল না হওয়া এবং এ কর্মসূচী চলাকালে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আরও আগেই আন্দোলনের কৌশল পরিবর্তন করতে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে পরামর্শ দিয়েছিলেন দলের সিনিয়র নেতারা। কিন্তু খালেদা জিয়া তাদের পরামর্শকে উপেক্ষা করে লন্ডন প্রবাসী ছেলে তারেক রহমানের পরামর্শকে প্রাধান্য দিয়ে টানা অবরোধ ও দফায় দফায় হরতাল কর্মসূচী পালন করতে থাকেন। কিন্তু ৫ এপ্রিল আন্দোলন স্থগিত করে গুলশানের বাসায় চলে যান খালেদা জিয়া। কিন্তু এ বিষয়েও খালেদা জিয়া দলের সিনিয়র নেতাদের মতামত নেননি। আর এ কারণেই আন্দোলনের পর বিএনপির সিনিয়র নেতারাও খালেদা জিয়াকে এড়িয়ে চলছেন। তবে বিএনপির সিনিয়র নেতারা মনে করেছিলেন, একক সিদ্ধান্তে খালেদা জিয়া টানা আন্দোলন স্থগিত করে বাসায় ফিরে গেলেও পরে সুবিধাজনক সময়ে হয়ত সবাইকে ডেকে পরিস্থিতি পর্যালোচনার সুযোগ দেবেন। কিন্তু দলের ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে খালেদা জিয়া এখনও সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে কথা বলেননি। তাই গায়ে পড়ে সিনিয়র নেতারাও এখন আর খালেদা জিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করেন না। দলীয় কর্মকা- থেকে নিজেদের দূরে রাখতে একেক জন একেক রকম কৌশল নিয়েছেন। কেউ ব্যবসাবাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন, কেউ অসুস্থতাজনিত কারণে চিকিৎসা নেয়ার পাশাপাশি বিশ্রামে সময় কাটাচ্ছেন আবার কেউ কেউ বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। বিএনপি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রাজনীতি করার কথা বললেও দলের গঠনতন্ত্র অনুসারে চেয়ারপার্সন কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য অন্য কোন নেতার মতামত নেয়ার প্রয়োজন পড়ে না। একক ক্ষমতাবলে যে কোন সময় যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন তিনি। তারপরও আগে যে কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সিনিয়র নেতাদের একটি ধারণা দিতেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। কিন্তু ২০১৩ সালের শেষের দিকে সরকারবিরোধী কঠোর আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পর থেকে খালেদা জিয়া অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার লন্ডন প্রবাসী ছেলে তারেক রহমান ছাড়া আর কারও পরামর্শ নেন না। আর এ কারণেই সিনিয়র নেতারা বর্তমান ধারার বিএনপির রাজনীতির প্রতি রুষ্ট বলে জানা গেছে। এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একজন সিনিয়র নেতা জনকণ্ঠকে বলেন, গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে দলের সিনিয়র নেতাদের মতামত নিয়ে যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তবে বিএনপির গঠনতন্ত্রে দল পরিচালনায় যে কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারে চেয়ারপার্সনের একক ক্ষমতা দেয়া আছে। তাই তিনি প্রয়োজন মনে করলে এককভাবেই যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
×