ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ঋতু পরিবর্তনে স্বাস্থ্য সচেতনতা

প্রকাশিত: ০৬:৩৮, ১ জুলাই ২০১৫

ঋতু পরিবর্তনে স্বাস্থ্য সচেতনতা

ঋতু পরিবর্তনের সময় সবচেয়ে বেশি রোগব্যাধির প্রকোপ দেখা যায় শ্বাসতন্ত্রের ওপর। বেশি দেখা দেয় ছোট বাচ্চা থেকে শুরু করে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত সবার সর্দি-কাশি বা কমন কোল্ড। প্রায়ই দেখা যায় দুই-তিন দিন নাক বন্ধ থাকে বা নাক দিয়ে পানি ঝরে। গলাব্যথা করে, শুকনা কাশি থাকে, জ্বরও থাকতে পারে। এগুলো বেশিরভাগই ভাইরাসজনিত। লক্ষণভিত্তিক কিছু চিকিৎসা, এমনকি কোন চিকিৎসা ছাড়াই ভাল হয়, কোন এ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন হয় না। তবে শুকনা কাশিটা কয়েক সপ্তাহ ভোগাতে পারে। ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ, এন্টি হিস্টামিন খেতে হবে। আর গরম পানিতে গড়গড়া করতে হবে। গরম গরম চা বা গরম পানিতে আদা, মধু, লেবুর রস, তুলসী পাতার রস ইত্যাদি পান করলে উপকার পাওয়া যায়। অনেক ক্ষেত্রে ভাইরাসের পরপরই ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করতে পারে। কাশির সঙ্গে হলুদ বা সবুজ রঙের কফ বের হলে, সঙ্গে জ্বর থাকলে ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। সেক্ষেত্রে এ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন হয়। এই সময়টাতে আরও একটি ভাইরাস রোগের প্রাদুর্ভাব হতে পারে, যাকে বলে সিজনাল ফ্লু। এই রোগের লক্ষণগুলোও কমন কোল্ডের মতোই। আলাদা কোন চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। ওপরের কমন কোল্ডের মতোই উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসা দিলেই ঠিক হয়ে যায়। জলবসন্তর মতো রোগের প্রকোপও এই সময়ে বেশি বেশি হয়। প্রথমে একটু জ্বর-সর্দি, তারপর গায়ে ফোস্কার মতো ছোট ছোট দানা। সঙ্গে থাকে অস্বস্তিকর চুলকানি, ঢোক গিলতে অসুবিধা। গায়ে ব্যথা থাকতে পারে। এটাও কোন মারাত্মক অসুখ নয়। জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল, শরীর চুলকালে এ্যান্টিহিস্টামিন জাতীয় ওষুধ, ক্যালামিন লোশন ইত্যাদি ব্যবহার করলেই রোগের প্রকোপ কমে আসবে। তবে সংক্রমণ হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত। বর্ষায় ফাঙ্গাল ইনফেকশন, নিউমোনিয়া ও পানিবাহিত রোগ বেশি হতে দেখা যায়। মুষলধারায় বৃষ্টির ফলে রাস্তাঘাটসহ বিভিন্ন জায়গায় পানি জমে থাকে। আবহাওয়াও স্যাঁতসেঁতে হয়ে ওঠে। এই জমে থাকা পানিতে এডিস মশা জন্ম নেয়। এ মশা ডেঙ্গুজ্বরের জীবাণু বহন করে। এডিস মশা সাধারণত দিনের বেলায় কামড়ায়। তাই যেসব স্থানে পানি জমে থাকতে পারে যেমনÑ টব, ডাবের খোসা, প্লাস্টিক কনটেইনার পরিষ্কার ও শুকনো রাখতে হবে। অনেকে ড্রইংরুম গাছ দিয়ে সাজাতে পছন্দ করেন। সেক্ষেত্রে প্রতিদিন টব রাখার স্থান ভালভাবে মুছে পরিষ্কার রাখতে হবে। ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ দেখা দিলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। বর্ষায় জমে থাকা বৃষ্টির পানি এবং স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ার কারণে যে রোগটি বেশি সংক্রমিত হয় তা হচ্ছেÑ ফাঙ্গাল ইনফেকশন বা চর্মরোগ। দাদজাতীয় গোল চাকাচাকা ফাঙ্গাল শরীরের নানা জায়গায় হতে পারে। অসহ্য চুলকানি হয় এগুলোতে। এগুলো গোলরিং আকারে শরীরে বাড়তে থাকে। তাই অনেক সময় একে রিংওয়ার্মও বলা হয়ে থাকে। আঙ্গুলের ফাঁকে ঘা বর্ষাকালে একটি অতিপরিচিত সমস্যা এবং এতে মিক্সব্যাকটেরিয়াল ও কেনডিডাল ইনফেকশন হতে পারে। ছুলি বর্ষার সময় বাড়তে পারে। এক ধরনের ছোপছোপ সাদা অথবা কালচে দাগ মুখে-পিঠে বা বুকে হয়ে থাকে। এসব সমস্যা এড়াতে বর্ষায় ত্বকের যতœ নেয়া প্রয়োজন। নিয়মিত ত্বক পরিষ্কার রাখা, সাবান দিয়ে গোসল করা, জামা-কাপড় নিয়মিত পাল্টানো বা পরিষ্কার রাখা এসব সমস্যা থেকে দূরে থাকতে সাহায্য করে। ফাঙ্গাল ইনফেকশনে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত। এছাড়া বর্ষার সময় নিউমোনিয়া হতে পারে। এর সঙ্গে জ্বর ও শ্বাসকষ্টও হয়ে থাকে। নিউমোনিয়া বেড়ে গিয়ে বুকে বসে যেতে পারে। তাই কালক্ষেপণ না করে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত। বর্ষায় ছোটবড় সব বয়সে সাধারণত যে রোগটি বেশি হয়, তা হচ্ছে পানিবাহিত রোগ। এজন্য সবাইকে বিশুদ্ধ বা ফুটিয়ে পানি পান করতে হবে। এ সময় একটু সচেতন থাকলে রোগবালাই আমাদের কাবু করতে পারবে না। সাইনুসাইটিস এবং টনসিলাইটিস জাতীয় রোগগুলোও এই সময়ে দেখা দিতে পারে। টনসিলের সমস্যা যে কারোরই হতে পারে, তবে ছোট বাচ্চারাই বেশি আক্রান্ত হয়। হঠাৎ শীত চলে যাওয়ার প্রাক্কালে গরমের শুরুতে ঠাণ্ডা পানীয় বা আইসক্রিম খাওয়ার প্রবণতার কারণে। এমনকি বাচ্চারা স্কুলে বা অন্যান্য জায়গায় ধুলাবালিতে খেলাধুলা করলেও এ সমস্ত রোগ বাড়ার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া যারা হাঁপানি, ব্রংকাইটিস বা শ্বাসজনিত অন্যান্য রোগে ভোগেন, তাদের রোগের প্রকোপ শীতের পর বসন্তে এমনকি গরমের শুরুতে বাড়তে পারে। আরও কিছু কিছু রোগ হওয়ার প্রাদুর্ভাব লক্ষ্য করা যায়। যেমন, প্রচ- গরমে পিপাসার কারণে রাস্তাঘাটে পানি বা শরবত খাওয়া আর খাবার। দ্রুত নষ্ট হয়ে যাওয়া খাদ্যদ্রব্য, ফলমূল গ্রহণ করার ফলে প্রায়ই ডায়রিয়াজনিত রোগব্যাধি দেখা দেয়। এমনকি এসব গ্রহণ করার কারণে টাইফয়েড, প্যারাটাইফয়েড, জন্ডিস, সাধারণ আমাশয়, রক্ত আমাশয়ও হতে পারে। আবার তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অতিরিক্ত তাপমাত্রায় হিটস্ট্রোক বা হিট এক্সহসশানের মতো জটিল সমস্যারও প্রকোপ দেখা দিতে পারে। ধুলাবালি পরিহার করতে হবে। অতিরিক্ত গরমে যাওয়াও এড়িয়ে চলুন। ঘাম হলে মুছে ফেলুন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঠাণ্ডা পানি বা খাবার খাওয়া, ধুলাবালিতে যাওয়া ইত্যাদি পরিহার করলে এসব রোগ থেকে নিরাপদ থাকা সম্ভব। ভাইরাসজনিত অসুখে আক্রান্ত রোগীর কাছ থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকতে হবে। সবসময় পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে। যেখানে-সেখানে দূষিত পানি বা অন্যান্য পানীয় খাওয়া বর্জন করতে হবে। পানি বা অন্য তরল জাতীয় খাবার পান করুন। অন্য সময়ের চেয়ে একটু বেশি, শুধু যেন হয় বিশুদ্ধ। বিশেষ করে যারা অতিরিক্ত গরম পরিবেশে কাজকর্ম করেন, তাদের বেলায় তরল পানীয়র সঙ্গে লবণ মিশিয়ে নেবেন। ওরস্যালাইনও খেতে পারেন। লেখক : অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ ডিন, মেডিসিন অনুষদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
×