ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

তথ্যপ্রযুক্তি আইনের যথাযথ ব্যবহারের অভাব;###;কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যে নারীরাই বেশি হেনস্তার শিকার ;###;প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি প্রয়োজন

সাইবার জগতে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে হয়রানি

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ১ জুলাই ২০১৫

সাইবার জগতে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে হয়রানি

এমদাদুল হক তুহিন ॥ ইন্টারনেটের ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সামাজিক, মানসিক ও যৌন হয়রানি। সমাজের ওপর মহল থেকে নিম্ন পর্যায়ের প্রায় সবাই কোন না কোনভাবে এর শিকার। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুধু নারীরা নন, পুরুষরাও বাদ যাচ্ছেন না। হারাচ্ছেন সামাজিক প্রতিপত্তি ও আত্মসম্মান। অনেক ক্ষেত্রে তারা ভেঙে পড়ছেন মানসিকভাবেও। পুরুষের বিকৃত মানসিকতা চর্চার ফলে কোন কোন নারী আত্মহননের মতো ঘটনাও ঘটাচ্ছে। হয়রানির শিকার হয়ে কোন রূপ প্রতিকার না পাওয়ায় এরই মধ্যে অনেকেই ত্যাগ করছেন ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ড। আইন প্রয়োগের বিধান থাকলেও সমস্যা সমাধানে সামাজিক সচেতনতার দিকেই জোর দেয়া হচ্ছে, তবে এক্ষেত্রে প্রতিকার আসছে খুব কমই। হয়রানি প্রতিরোধে সাইবার জগতে পুলিশি তৎপরতা বৃদ্ধির দাবিও রয়েছে বহুদিন ধরে। সম্প্রতিক সময়ে ক্রিকেটার নাসির হোসেনের ছবিতে ভক্তদের বিরূপ মন্তব্যে সাইবার হয়রানির বিষয়টি আবারও নজরে আসে। ক্রিকেটার কিংবা সমাজের ওপর মহল নন, সদ্য ফেসবুকে নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে আসা নীলিমাও হয়েছেন হয়রানির শিকার। তিনি বলেন, ‘ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে নতুন এসেছি। এখনও সব বুঝে ওঠেনি। তবে এরই মধ্যে ফেসবুকের ইনবক্সে নানা ধরনের আপত্তিকর মেসেজ এসেছে। কুরুচিপূর্ণ ও বিকৃত বক্তব্যে দেখে মনে হয়, নারী বলেই হয়ত এমন করতে পারে ওরা!’ এসব হয়রানি থেকে বাদ যায়নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গার্হস্থ্য অর্থনীতির ছাত্রী শারমিন জাহান অর্পিও। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ‘আমার ছবি ব্যবহার করে ফেস আইডি বানিয়ে নানাভাবে হয়রানি করা হয়েছে। বাশেরকেল্লা টাইপের বিভিন্ন পেজ থেকে সেই আইডি নিয়ে পোস্টও দেয়া হয়েছে। নানা ধরনের আপত্তিকর মন্তব্যে পূর্ণ ছিল সেসব পোস্ট। ভাল কোন ছবি আপলোড করা মাত্রই লিস্টে না থাকা ছেলেরাও এসে বাজে মন্তব্য করে। আর ইনবক্স, সে কথা আর কি বলব! অনেক সময় হয়রানির মাত্রাও ছাড়িয়ে যায়।’ একটি অসাধু শ্রেণী সুন্দরী তরুণীদের বিকৃত ছবি ছড়িয়েও তাদের নানাভাবে হেনস্থা করে বলে অভিযোগ রয়েছে। হয়রানির একই রকম অভিজ্ঞতা হয়েছে বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটার নাসির হোসেনের। ভারতের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক ওয়ানডে সিরিজ জয়ের পর বিমানে চেপে রংপুরে যান তিনি। এ সময় সঙ্গে ছিল তার ছোট বোন। বোনের আবদারে সেলফি তুলে ফেসবুকের নিজস্ব ফ্যান পেজে তা পোস্ট করেন। আর তাতেই আসে নানা আপত্তিকর মন্তব্য। নাসির ও নাসিরের বোনকে জড়িয়ে বিশ্রি ভাষায় আক্রমণ করা হয়। বিব্রতকর পরিস্থিতিতে অনেকটা বাধ্য হয়ে বোনের ছবিটি সরিয়ে নেন নাসির। রাগে দুঃখে অভিমানে পরবর্তী পোস্টে তিনি লিখেন, ‘আপনাদের খারাপ মন্তব্য দেখে অনেক কষ্ট পেলাম। আমার ছোট বোনের আবদার মেটাতে তার সঙ্গে আমার ছবি পেজে পোস্ট করেছিলাম। তাই বলে আপনারা অনেকেই বাজে মন্তব্য করেছেন। যেটা নিয়ে অনেকেই ফান পোস্টও করছেন। পোস্টটা ডিলেট করে দিলাম এখন খুশি তো?’ তিনি আরও লেখেন, ‘আপনাদের মতো ফ্যান আমার দরকার নাই। আমাকে যারা পছন্দ করেন না তারা আমার ছবিতে লাইক দেবেন না। আমাকে ফলো করবেন না। ধন্যবাদ।’ একই রকম আশঙ্কায় বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা তার ফ্যান পেজে বাংলাদেশকে রেস্টিকটেড করেন। ফলে দেশীয় ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা ফেসবুকে মাশরাফির কোন কার্যক্রম দেখতে পাবেন না। যা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। দোষীদের শাস্তির দাবিতেও সোচ্চার অন লাইন জগত। শুধু ক্রিকেটাররা নন, ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডের প্রতিটি বাসিন্দাকে পড়তে হচ্ছে নানা হেনস্থায়। তবে এক্ষেত্রে নারীরাই আক্রান্ত হয় বেশি। অশ্লীল ও অশ্রাব্য ভাষার গালাগালি ছাড়াও আপত্তিকর নানা বক্তব্যে সয়লাব হয়ে ওঠে তাদের ফেসবুকের ইনবক্স। প্রকাশ্য মন্তব্যে করা হয় আক্রমণ। এছাড়া রয়েছে নামে বেনামে আইডি খোলার প্রবণতা। নারীদের ছবি ব্যবহার করে ফেসবুকে নতুন আগন্তুকদের সঙ্গে করা হয় নানা ধরনের প্রতারণা। অর্থের লেনদেন ঘটার অভিযোগও রয়েছে। এছাড়া নিজের স্বামী কর্তৃকও ইন্টারনেটে আক্রান্ত হওয়ার অভিযোগও রয়েছে নারীর। বলা হয়ে থাকে, মানসিকভাবে বিকৃত স্বামী কিংবা প্রেমিক ইন্টারনেট বা মোবাইলে ছড়িয়ে দেন স্ত্রী বা প্রেমিকার ছবি। আর এসব কারণে আত্মহত্যার মতো ঘটনা ঘটছে বলেও জানা যায়। যৌন হয়রানি প্রসঙ্গে ছায়া বীথি বলেন, ‘ফেসবুকে অপরিচিত ছেলেরা মেসেজ দিতে থাকে। বারবার দেয়। উত্তর না দিলে গালাগালি শুরু করে। এছাড়া নানা ধরনের হয়রানি তো আছেই।’ আর অপর এক নারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘জামায়াত শিবির বিরোধী লেখালেখি করার কারণে একটি শ্রেণীর রক্তশূলে পরিণত হয়। শুরু হয় নানাভাবে আক্রমণ, নারী হওয়ায় তার মাত্রাও যেন বেড়ে যায়! ওয়ালে এসে বিশ্রী ভাষায় মন্তব্য করত, দেখে দেখে তাদের ব্লক করতাম। কাজ না হওয়ায় ফোন নম্বর ছড়িয়ে দিতে শুরু করে। তাতেও থেমে না যাওয়ায় ব্যক্তিগত কিছু ছবি কয়েকটি পেজে ছড়িয়ে দেয়। এরা ফটোশপ করতেও ভুল করেনি, বারবার আমাদের বিশ্রীভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছে। অথচ তাদের ঘরে রয়েছে মা-বোন! বাংলাদেশের অধিকাংশ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী এর সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে জানে না বলে মনে করেন একদল বিশেষজ্ঞ। রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যবহারকারীদের ওপর নজরদারি না থাকার ফলেও হয়রানি বাড়ছে বলে মনে করেন একদল। কোন কোন ক্ষেত্রে সচেতনতার অভাবও এর জন্য দায়ী। এছাড়া পুলিশ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণার কারণেও অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে, অভিযোগ দিয়ে লাভ নেই এমন মানসিকতায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হয়রানির অভিযোগ প্রদান করা হয় না। তথ্যপ্রযুক্তি আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব এবং এই আইন সম্পর্কে না জানার কারণে ইন্টারনেটে নারী নির্যাতন বা হয়রানি ক্রমাগত বাড়ছে বলেও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। যৌন হয়রানি প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির পরামর্শ দেন সচেতন মহলের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা, পাশাপাশি ইন্টারনেটের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরী বলে তাদের মতো। মনস্তাত্ত্বিক কারণে হীনম্মন্যতায় ভুগতে থাকা শ্রেণী হয়রানিতে জড়িয়ে পড়ে বলে মনে করেন অনেকেই। তবে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠী ও তাদের মতাদর্শ লালনকারীদের দ্বারা সাইবার হয়রানির ঘটনা ঘটছে। হয়রানির শিকার একাধিক ব্যক্তিও মনে করেন শুধুমাত্র আইনের প্রয়োগ দ্বারা এসব সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়। আর সংশ্লিষ্টরা সাইবার জগতে পুলিশি তৎপরতা বৃদ্ধির দাবি করেন। মানবিক মূল্যবোধ ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি পেলে হয়রানি অনেকাংশেই হ্রাস পাবে বলে মনে করেন অন লাইন বিষেজ্ঞরা। এ প্রসঙ্গে মানবাধিকার কর্মী এলিনা খান জনকণ্ঠকে বলেন, সাইবার হয়রানি বন্ধ করতে দরকার উভয়পক্ষের সচেতনতা। মেয়েরা বা ছেলেরা যদি সাবধানতা অবলম্বন করে তাহলে তা কমে আসতে পারে। আইন করে সব বন্ধ করা না গেলেও, সাইবার হয়রানি বন্ধে আইনের সঠিক প্রয়োগ হলে তা অনেকাংশেই রোধ করা সম্ভব হবে বলে মনে করি।
×