ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

তালিকায় নানা অসঙ্গতি, বিভ্রান্তি ;###;হাজার হাজার শিক্ষার্থী কোন কলেজেই সুযোগ পায়নি

কলেজে অনলাইনে ভর্তি নিয়ে হযবরল অবস্থা

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ৩০ জুন ২০১৫

কলেজে অনলাইনে ভর্তি নিয়ে হযবরল অবস্থা

বিভাষ বাড়ৈ ॥ কলেজ ভর্তিতে অনলাইনের আবেদন নিয়ে কেলেঙ্কারির পর এবার মহাকেলেঙ্কারির জন্ম দিয়েছে শিক্ষা প্রশাসন। চার দিন ধরে দফায় দফায় পিছিয়ে রবিবার মধ্য রাতে মেধাতালিকা প্রকাশ করা হলেও সেই তালিকা নিয়ে এবার শুরু হয়েছে ১২ লাখ ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী ও তাদের ২৪ লাখ অভিভাবকের মহাদুর্ভোগ। তড়িঘড়ি করে গোঁজামিল দিয়ে তালিকা তৈরি করায় রাজধানীর নামী দামী সব কলেজ থেকে শুরু করে দেশজুড়ে শুরু হয়েছে নতুন বিড়ম্বনা। হাজার হাজার শিক্ষার্থী অনলাইনে আবেদন করেও কোন কলেজে চান্স পায়নি, অথচ বহু কলেজে ১০০ থেকে ২০০ আসন খালি। ভর্তির প্রথম দিন চলে গেলেও ওয়েবসাইটে তালিকাই পায়নি বহু প্রতিষ্ঠান। ভিকারুননিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজের তালিকায় নাম না থাকায় ছাত্রীদের কান্নার রোল পড়েছে। ছেলে শিক্ষার্থীকে মেয়ে শিক্ষার্থী বানিয়ে দেয়া, আবেদনের বাইরে কলেজে চান্স পাইয়ে দেয়াসহ নানা অভিযোগে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে। এদিকে পুরো প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলে আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। সোমবার নিজ নিজ কলেজ ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে গিয়ে প্রতিবাদ বিক্ষোভ করেছেন তারা। তারা অবিলম্বে তালিকা সংশোধনেরও দাবি তুলেছেন। এর আগে কারিগরি জটিলতার দাবি করে নির্ধারিত সময়ের চার দিন পর রবিবার মধ্যরাতে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তিচ্ছুদের মেধাতালিকা প্রকাশ করেছে মন্ত্রণালয় ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ড। ভর্তি কমিটির প্রধান শিক্ষা সচিব নজরুল ইসলাম খান তালিকা প্রকাশ করেন। এ দিনই শিক্ষা সচিব কলেজ ভর্তিতে সৃষ্ট জটিলতার দায় স্বীকার করে নিয়ে বলেন, আমার নিজের কারণেই জটিলতা। আমি নিজে অনলাইনে ভর্তিতে পুশ করেছি। আমার বিরুদ্ধেই লিখেন। এদিকে শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশ অমান্য করে ভর্তি নিয়ে ইচ্ছেমতো সচিবের সিদ্ধান্ত নেয়ার ঘটনা নিয়ে সোমবার দিনভর ছিল আলোচনা। গণমাধ্যমে এ সংক্রান্ত নানা খবর প্রকাশ হওয়ার পর সকাল থেকেই সচিবালয়ে বৈঠকে সাংবাদিকদের কাছে তথ্য দেয়ার জন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ছিলেন তটস্থ। বৈঠকে সাংবাদিকদের তথ্য দেয়ার ঘটনা নিয়ে তদন্ত করার কথাও বলেছেন। তবে তারপরও দীর্ঘ জটিলতা কাটিয়ে মেধাতালিকা প্রকাশ হওয়ায় সকাল থেকেই কলেজগুলোর প্রতি নজর ছিল সকলের। কিন্তু সময় যত যেতে থাকে ততই জটিলতা বাড়ছে তালিকা নিয়ে। প্রথমেই সারাদেশের শিক্ষার্থী অভিভাবকরা জানতে পারেন, সাড়ে ১১ লাখ শিক্ষাথী ভর্তির আবেদন করলেও তালিকায় নাম আছে ১০ লাখ ৯৩ হাজার ৩৭৪ জনের। ফলে বাকিদের ভবিষ্যত নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে অনিশ্চয়তা। এছাড়া অনলাইনে আবেদন না করা আরও সোয়া এক লাখ এসএসসি পাস শিক্ষার্থীদের নিয়েও উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। যদিও সচিব বলছেন, আরও তালিকা প্রকাশ হবে। কিন্তু সেই তালিকার ভবিষ্যত কী তা জানতে চান অভিভাবকরা। দুপুরেই জানা যায়, মেধাতালিকা প্রকাশ করার পর ভর্তি কার্যক্রম শুরুর প্রথম দিন তালিকাই পাচ্ছে না অনেক প্রতিষ্ঠান। নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের নাম না পেয়ে জটিলতায় অনেক প্রতিষ্ঠান। মেধা তালিকায় নাম না থাকলেও ভিকারুননিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজ তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে এসএসসি উত্তীর্ণদের এই কলেজে ভর্তি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে ভর্তি জটিলতা নিয়ে বোর্ড সমন্বয় সাব-কমিটিসহ দায়িত্বশীল কেউ কথা বলছেন না। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অনুযায়ী শিক্ষা বোর্ড মনোনীত তালিকা ধরেই সব কলেজকে একাদশ শ্রেণীতে শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে হবে। এ নিয়মের বাইরে এবার শিক্ষার্থী ভর্তির কোন সুযোগ নেই। আবার নিয়ম অনুসারে স্ব স্ব কলেজের শিক্ষার্থীদের অবশ্যই ভর্তি নিশ্চিত করার কথা। কিন্তু সবচেয়ে বড় সঙ্কটে পড়েছে রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজের ছাত্রীরা। তারা এই প্রতিষ্ঠান থেকে এসএসসি পাস করলেও অনেকেই ভর্তি হতে পারছেন না সেখানে। জিপিএ-৫ পেয়েও নিজের প্রতিষ্ঠানের মেধা তালিকায় তাদের নাম নেই। অথচ সেখানে আছে বাইরের ছাত্রীদের নাম। এ কারণে সকাল থেকেই ভিকারুননিসার অনেক ছাত্রী কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছেন। কলেজের অধ্যক্ষ সুফিয়া আক্তার সাংবাদিকদের জানান, বহু ঝামেলার পর দুপুর দুইটায় সব বিভাগের তালিকা পেয়েছি। আমাদের এখান থেকে অনেকে ভাল রেজাল্ট করে এসএসসি পাস করেছে, কিন্তু বোর্ডের প্রকাশিত তালিকায় তাদের নাম নেই। এখন মেয়েরা অনেক কান্নাকাটি করছে। এতদিন এই প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করে এখন কলেজে ভর্তি হতে পারছে না, এটা কেমন কথা? অধ্যক্ষ সুফিয়া আক্তার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তার স্কুল থেকে পাস করা বেশ কয়েকজন ছাত্রীর নাম বোর্ডের মেধাতালিকায় আসেনি। বোর্ডের মেধাতালিকায় তাদের নাম আসুক আর নাই আসুক, আমরা তাদের (এই স্কুল থেকে পাস করা ছাত্রী) ভর্তি করাব। কারণ ১০ বছর ধরে তারা এখানে পড়াশোনা করছে। মেধাতালিকার বাইরে থাকা শিক্ষার্থীদের ভর্তি করালে মোট আসনের অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হবে কিনাÑ এই প্রশ্নে তিনি বলেন, দুই হাজার আসনে শিক্ষার্থী ভর্তি করায় ভিকারুননিসা। প্রয়োজনে আমরা বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাব। মেধা তালিকায় নাম না দেখে ভিকারুননিসার বেশ কয়েকজন ছাত্রী সোমবার কলেজে এসে কান্নাকাটি শুরু করেন। পরে অধ্যক্ষ তাদের নিজের কক্ষে নিয়ে ভর্তির নিশ্চয়তা দেন বলে একজন ছাত্রী জানান। সোমবার ভর্তির সময় চলে গেলেও তালিকা পায়নি মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল এ্যান্ড কলেজ। অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগম জানান, তালিকার জন্য বহু কষ্ট করতে হচ্ছে। তবু আমরা পাচ্ছি না। তালিকা না পাওয়ায় শিক্ষার্থীদের ভর্তি করানো যাচ্ছে না জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করা যেসব শিক্ষার্থী মোবাইলে এসএমএস পেয়েছে, আমরা শুধু তাদের ভর্তি করেছি। অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যেসব শিক্ষার্থী আইডিয়ালে চান্স পেয়েছে, আমরা তাদের ভর্তি করাতে পারছি না। শিক্ষার্থী অভিভাবকরা প্রতিষ্ঠানে জড়ো হয়ে আছেন। তালিকা পাননি মিরপুরের মনিপুর স্কুল এ্যান্ড কলেজ। সেখানে দিনভর শিক্ষার্থী অভিভাবকরা বিক্ষোভ করেছেন। অধ্যক্ষ ফরহাদ হোসেন বলেন, কোন তালিকা না পাওয়ায় কাউকেই ভর্তি করাতে পারছি না। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের অভিভাবকরাও কলেজে ভিড় করছেন। আমরা সবাই বেশ উদ্বিগ্ন। ভর্তি ও ক্লাস শুরুর সময় বার বার বদলানো নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন এই অধ্যক্ষ। ঢাকা সিটি কলেজ, ট্রাস্ট কলেজেও একই অবস্থা। সিটি কলেজের অভিভাবকরা দিনভর জড়ো হয়েছিলেন। আজকের মধ্যে সমাধান চায় সেখানকার শিক্ষার্থীরা। উত্তরা সিটি কলেজে ৪০০ আসন থাকলেও সেখানে মাত্র ২০০ শিক্ষার্থীর তালিকা দেয়া হয়েছে। এভাবে বিভিন্ন কলেজে শিক্ষার্থী ভর্তিতে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে বলে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন। এদিকে ছেলের স্থলে মেয়ে ও নাম ভুলের কারণেও ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। সিটি কলেজে ভর্তি করাতে ব্যর্থ হয়ে অভিভাবক আকবর আলী জনকণ্ঠ অফিসে ফোন করে বলেছেন, আমার সন্তানের মোবাইলে এসএমএস এসেছে। কিন্তু ভর্তি হতে গেলে বলা হচ্ছে ওয়েবসাইটে নাম নাই। বোর্ড থেকে ঠিক করে আনতে হবে আগে; তারপর ভর্তি। এভাবে চলতে পারে না বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন এই অভিভাবক। খিলগাঁও সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে রায়হান জিপিও-৫ পেয়েও কোন কলেজে চান্স পাননি। তিনি বলেন, আমি ৫টি কলেজের নাম দিয়েছি। একটিও পাইনি। আমার থেকে খারাপ ফল করেও এসব কলেজে অনেকে চান্স পেয়েছেন। তিনি দরকার হলে আদালতে যাওয়ার হুমকি দেন। বাংলাদেশ অভিভাবক সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নিপা সুলতানা বলছিলেন, অভিভাবকরা দাবি নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে প্রতিবাদ জানাবে। এসব কী হচ্ছে? কলেজে ভর্তি জটিলতার বিষয়ে সারাদেশ থেকে অভিযোগ আসছে। এসব অভিযোগ নিয়ে বোর্ড কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলবেন জানিয়ে তিনি বলেন, অনেকে বিজ্ঞান শাখা থেকে পাস করলেও তাকে নাকি কমার্সের তালিকায় রাখা হয়েছে। আবার অনেকে কম জিপিএ পেয়েও নাকি চান্স পেয়েছে। এসব কিভাবে হলো? কোন মানদ-ের ভিত্তিতে মেধা তালিকা করা হয়েছে? কলেজে সন্তানদের ভর্তি নিয়ে এবার অভিভাবকরা ক্ষুব্ধ ও হতাশ। জটিলতা নিয়ে কথা বলতে চাইলে ঢাকা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ড. শ্রীকান্ত কুমার চন্দ সাংবাদিকদের কলেজ পরিদর্শক অধ্যাপক আসফাকুস সালেহীনের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন। এদিকে ঢাকা বোর্ডে গিয়ে জড়ো হচ্ছে শত শত অভিভাবক শিক্ষার্থী। তারা তুলছেন একের পর এক অভিযোগ। শিক্ষার্থীদের ভোগান্তির বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক ড. আসফাকুস সালেহীন বলেন, আমরা সব অভিযোগ আমলে নিচ্ছি। যতদ্রুত সম্ভব আমরা সমাধানের চেষ্টা করছি। বিকেল সাড়ে ৩টায়ও তার কার্যালয়ের সামনে শত শত শিক্ষার্থী অভিযোগ নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
×