ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

২০১৪ বস্তি শুমারির উল ॥ বেড়েই চলেছে বস্তি

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ৩০ জুন ২০১৫

২০১৪ বস্তি শুমারির উল ॥ বেড়েই চলেছে বস্তি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দেশে বস্তির সংখ্যা বাড়ছে। ১৯৯৭ সালে মোট ২ হাজার ৯৯১টি বস্তি থাকলেও সেটি বেড়ে গিয়ে ২০১৪ সালে দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ৯৯৪টিতে। বর্তমানে এসব বস্তিতে বাস করছে ২২ লাখ ৩২ হাজার ১১৪ জন মানুষ। এর মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ১১ লাখ ৪৩ হাজার ৯২৫ জন এবং মহিলা ১০ লাখ ৮৬ হাজার ৩৩৭ জন। মূলত পাঁচটি কারণে গ্রাম ছেড়ে বস্তিতে আসছে মানুষ। এগুলো হচ্ছে দারিদ্র্য, কাজের সন্ধান, নদী ভাঙ্গন, ডিভোর্স এবং নিরাপত্তাহীনতা। অন্যদিকে দেশে ঠিকানাবিহীন (ভাসমান) মানুষ রয়েছে ১৬ হাজার ৬২১ জন। যাদের কোন স্থায়ী ঠিকানা নেই। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে এ সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। দুটি সিটি কর্পোরেশনে ভাসমান লোক রয়েছে ৭ হাজার ২৪৭ জন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর বস্তিশুমারি ও ভাসমান লোক গণনা ২০১৪ জরিপের ফলাফলে এসব চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পরিসংখ্যানের নিয়মিত কার্যক্রমের পাশাপাশি ক্রমবর্ধমান চাহিদার আলোকে দেশের আর্থ-সামাজিক খাতের নতুন নতুন ক্ষেত্র চিহ্নিত করে আন্তর্জাতিক মান ও পদ্ধতি অনুসরণ করে বিভিন্ন শুমারি ও জরিপ পরিচালনা করে আসছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বস্তি শুমারি ও ভাসমান লোক গণনা করা হয়েছে। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন, দারিদ্র্যবিমোচন কর্মসূচী বাস্তবায়ন, নগর দারিদ্র্য পরিস্থিতি নিরূপণে এ শুমারিটি বিশেষ গুরুত্ব রাখবে। সোমবার বিকেলে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে এ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব কানিজ ফাতেমা। সভাপতিত্ব করেন পরিসংখ্যান ব্যুরোর মহাপরিচালক মোহাম্মদ আবদুল ওয়াজেদ। মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন কর্মসূচী পরিচালক জাফর আহাম্মদ খান। প্রতিবেদনে বস্তির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, জনসংখ্যার ঘনত্ব খুব বেশি এবং ঘরবাড়ির সংখ্যাধিক্য থাকে এবং একটি কক্ষে অধিক লোক বাস করে, এক শতাংশ জমিতে তিন বা তার বেশি ঘরবাড়ি থাকে, বস্তির জমির মালিকানা বস্তিসমূহ সাধারণত সরকারী, আধা-সরকারী, ব্যক্তি মালিকানাধীন খালি জমিতে, পরিত্যক্ত বাড়ি বা ভবনে, পাহাড়ের ঢাল বা সড়ক বা রেললাইনের ধারে গড়ে ওঠে, পানি সরবরাহ ও পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা : বস্তিসমূহে সাধারণত অপর্যাপ্ত বা অপরিষ্কার পানি সরবরাহ, অপ্রতুল, পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা (একটি টয়লেট ১৫ বাসার বেশি লোক ব্যবহার করে) ও সর্বোপরি অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ বিরাজ করে, বস্তিসমূহের রাস্তায় আলোর ব্যবস্থা ও চলাচলের রাস্তা অপর্যাপ্ত বা একেবারেই থাকে না, বস্তিসমূহের অধিবাসীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা খুব নিম্নমানের হয়ে থাকে এবং বস্তিবাসীরা সাধারণত অপ্রাতিষ্ঠানিক অকৃষি কাজে নিয়োজিত থাকে। প্রতিবেদনের ফলাফলে দেখা গেছে, ঢাকা বিভাগে ১০ লাখ ৬২ হাজার ২৮৪ জন, বিভাগভিত্তিক বস্তিবাসীর সংখ্যা হচ্ছে, বরিশালে ৪৯ হাজার ৪০১ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৬ লাখ ৩৫ হাজার ৯১৬ জন, খুলনা বিভাগে ১ লাখ ৭২ হাজার ২১৯ জন, রাজশাহী বিভাগে ১ লাখ ২০ হাজার ৩৬ জন, রংপুর বিভাগে ১ লাখ ১৮ হাজার ৬২৮ জন এবং সিলেট বিভাগে ৯১ হাজার ৬৩০ জন। এলাকাভিত্তিক বস্তির সংখ্যা হচ্ছে বরিশালে ১৩৭টি, চট্টগ্রামে ২ হাজার ২০৮টি, কুমিল্লায় ৪১টি, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ মিলে ৩ হাজার ৩৯৯টি, গাজীপুর ১ হাজার ২৮৭টি, খুলনায় ১ হাজার ১৪৩টি, রাজশাহী ১০৩টি, রংপুর ৪৯টি এবং সিলেটে ৬৬৭টি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বস্তিতে আসার কারণ হিসেবে অর্ধ শতাধিক পরিবার বলেছে কাজের সন্ধানে তারা বস্তিতে এসেছে। ২৯ শতাংশ পরিবার বলেছে তারা দারিদ্র্যের কারণে শহরে এসেছে, এক শতাংশ পরিবার বলেছে তারা নদীভাঙ্গনসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে নিঃস্ব হয়ে বস্তিতে বাস করছে। এক শতাংশ মহিলা বলেছে সে ডির্ভোস হয়ে যাওয়ায় অসহায় হয়ে পরে এবং শেষে বস্তিতে বসবাস করছে। দুই শতাংশ পরিবার বলেছে তারা নিরাপত্তাহীনতার কারণে ভিটেমাটি ও গ্রাম ছেড়েছে, এখন বস্তিতে বসবাস করছে। প্রতিবেদনে দেখা যায়, বস্তিতেও লেগেছে ডিজিটাল বাংলাদেশের ছোঁয়া। বস্তির প্রায় ৮৪ শতাংশ খানায় (পরিবারে) মোবাইল ফোন রয়েছে, ৪৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ পরিবারে রয়েছে টেলিভিশন, ২ দশমিক ৫৮ শতাংশ পরিবারে রয়েছে রেডিও। বস্তিতে বসবাসকারী ১৬ দশমিক ৮০ শতাংশ পরিবারের আয়ের প্রধান উৎস হচ্ছে রিক্সা বা ভ্যান চালনা, ৫ দশমিক ৬৮ শতাংশ পরিবার রিক্সা বা ভ্যান রয়েছে, ১৪ দশমিক ৩৫ শতাংশ মানুষ গার্মেন্টসকর্মী, ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ পরিবহন শ্রমিক, ৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ নির্মাণ শ্রমিক, ২ দশমিক ৮২ শতাংশ হোটেল শ্রমিক, ১৫ দশমিক ৭১ শতাংশ ব্যবসা এবং ১৪ দশমিক ৩৩ শতাংশ সেবাখাতে কাজ করে। জাতীয় গৃহায়ন নীতিমালা প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত বিশিষ্ট নগর বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ড. নজরুল ইসলাম জানিয়েছেন, বাংলাদেশ সরকারের তাবত অর্থনৈতিক কর্মকা-ের মূল দর্শন হচ্ছে দারিদ্র্যবিমোচন। এ লক্ষ্যেই স্বাধীনতার পর থেকে সকল সরকারই তার যাবতীয় অর্থনৈতিক কর্মকা- পরিচালনা করে আসছে। কিন্তু সরকারের এসব দারিদ্র্য নিরসন কার্যক্রমের সঙ্গে বস্তি উচ্ছেদ চরম সাংঘর্ষিক। সরকার একদিকে দরিদ্র জনগণকে শহরে-নগরে আসার সুযোগ দিচ্ছে, শ্রম নিচ্ছে, শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো নাগরিক জীবনযাপনের সকল আধুনিক সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার এবং কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নগরে গড়ে তুলতে সহায়তা দিচ্ছে, বাজেটে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করছে অথচ সেখানে দরিদ্রদের বসবাসের কোন ব্যবস্থা করছে না। ফলে দরিদ্ররা বাধ্য হয়ে অস্থায়ী বস্তিতে আশ্রয় নিচ্ছে। এটা সরকারের চরম বিপরীতমুখী নীতি। আবার কিছুদিন পরপর ওইসব বস্তি ভেঙ্গে দেয়া হচ্ছে কিংবা আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এতে দরিদ্র জনগোষ্ঠী তাদের দারিদ্র্য নিরসন প্রক্রিয়ায় দুই ধাপ উপরে উঠে তিন ধাপ নিচে পড়ে যাচ্ছে এবং দেশে দরিদ্ররা কেবল দরিদ্রই থেকে যাচ্ছে। তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হচ্ছে না এবং অর্জিত সম্পদ রাতারাতি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। শুধু দরিদ্র মানুষের একটু নিশ্চিত ও নিরাপদ আবাসনের অভাবে সরকারের দারিদ্র্য নিরসনসংক্রান্ত সকল বিনিয়োগ বিফলে যাচ্ছে। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বস্তিতে বসবাসকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ বিদ্যুত ব্যবহার করছে। এ হার ৮৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ। কেরোসিন তেল ব্যবহার করে ৯ দশমিক ৭০ শতাংশ মানুষ।
×