ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

মোস্তাফা জব্বার

একুশ শতক ॥ হাওড় বাংলার রূপান্তর

প্রকাশিত: ০৬:৪৪, ২৮ জুন ২০১৫

একুশ শতক ॥ হাওড় বাংলার রূপান্তর

॥ দুই ॥ বাংলাদেশের গ্রাম এখন আর সাপুড়ে আর জাদুর দেশের গ্রাম নেই। আমি যে এলাকা থেকে শহরে উঠে আসা মানুষ সেই এলাকার রূপান্তর তো আরও বেশি করে চমকে দেয়ার মতো। আমি ভাবি আমার প্রয়াত দাদা মুন্সী আলিমুদ্দিন তালুকদার যদি এখন আমার গ্রামে এসে এর এক মাথা থেকে আরেক মাথায় হেঁটে যেতেন তবে তার চোখ কপালে ওঠা ছাড়া আর কোন গতি ছিল না। তিনি ভাবতেই পারতেন না যে, এটিই তাঁর গ্রাম। প্রায় দুইশ বছর আগে নবীনগরের গ্রামবাসীদের সঙ্গে ভাসতে ভাসতে এসে যে ভিন্ন ধরনের গ্রামটাতে পা রেখেছিলেন সেই গ্রামটি এখন আর নেই। সেটিকে তিনি এখন আর কোথাও খুঁজে পাবেন না। গ্রামের এক মাথা থেকে অন্য মাথা পর্যন্ত যেতে ডজনখানেক খাল আজ আর নেই। সাঁকোগুলো এখন অতীত স্মৃতি। আমি আমার শৈশবে দেখতাম বৈশাখ মাসে ধান কাটা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের মানুষ সাঁকো বানাতে লেগে যেত। এখন সেসব খালের সবগুলো ভরাট হয়ে বাড়ি তৈরি হয়ে গেছে। বাজার থেকে তার বাড়ি পর্যন্ত তৈরি হয়েছে পাকা রাস্তা। এই গ্রামের বড়বাড়ির আমগাছতলায় নলখাগড়ার খুঁটি গেড়ে যে মক্তব স্থাপন করেছিলেন সেখানে এখন মেয়েদের হাই স্কুল আর দোতলা দালান তাকে চমকে দিতই। শত শত মেয়েকে নীল রংয়ের কাপড় পরে স্কুলে আসতে দেখলে তিনি হয়ত চোখটা কপালে তুলতেন। ভাবতেন, কোত্থেকে আসছে এই নীল পরীর দল। স্কুলের পাশের মসজিদটা এবং এর পাশেই তার ছোট ছেলের মাজারটা দেখে তিনি ভাবতেন; তার উত্তরসূরিরা কতটা পথ পার হয়েছে। বিশ কিলোমিটার দূর থেকে যখন মসজিদের মিনারটা আর তার বাতিটা চোখে পড়ত তখন তিনি ভাবতেন, ঝড়ের রাতেও গ্রামটা চিনতে আজ আর কোন অসুবিধাই হয় না। কত না কষ্ট হয়েছে হাওড়ের মাঝে বসে থেকে অন্ধকারে নিজের গ্রামটাকে খুঁজে পেতে। চাঁদের দিকে তাকিয়ে তারা গুনে গুনে বলতে হতো কোন গ্রামটা কৃষ্ণপুর। একদিন যে মানুষটির এক গ-া জমি ছিল না সেই মানুষটির একজন নাতির সম্পদ নিয়ে তিনি এখন একটি পুরো হাওড় কিনে ফেলতে পারেন। ভাতের খোঁজে ভাইদের সঙ্গে ভাসতে ভাসতে আসা আমার দাদি আদির মা কি কল্পনাও করতে পারতেন যে, তাঁর বাড়ির সামনে থেকে পাকা রাস্তায় তিনি তার আরেক বাড়িতে যেতে পারবেন! যে বয়সে তিনি মা হয়েছেন সেই বয়সের মেয়েরা এখন স্কুলের পোশাক পরে স্কুলের ক্লাসরুমে বসে দুনিয়ার তাবত বিষয় জানে, সেটি কি কল্পনাও করতে পারতেন! এই গ্রামের সব মেয়ে স্কুলে যায়, বাড়িতে বসে হাই স্কুল, কলেজ ও ডিগ্রী-মাস্টার্স পড়তে পারে, সেটি স্বপ্নেও কি দেখতে পারতেন? স্কুলে মেয়েরা কম্পিউটারে বসে, ইন্টারনেট চালায়- সেকি বিশ্বাস হতে পারে! সেই গ্রামেরই মেয়ে জয়া ফেসবুকে দুনিয়ার লোকের সঙ্গে চ্যাট করে? আমার দাদার জীবনটা ছিল এ রকমÑ তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর থানায় জন্ম নিয়েছিলেন। সেখানে অল্প বয়সে বিয়েও করেছিলেন। ছেলেমেয়ে ছিল কিনা সেটি আমি জানি না। গ্রামের নামটাও জানি না। এখন আমার চারপাশে এমন কেউ নেই যার কাছ থেকে আরও কিছু বিবরণ জানতে পারি। তবে এটি জানি যে, তিনি মুন্সী মানুষ ছিলেন এবং গ্রামের মানুষেরা ভাগ্য অন্বেষণে উত্তরে পাড়ি জমানোর উদ্যোগ নিলে তিনি একেবারেই শূন্যহাতে তাদের সঙ্গী হন। আমি শুনেছি, তাঁর স্ত্রী এই অজানা-অচেনা দুনিয়াতে আসতে রাজি হননি। তিনি থেকেই গিয়েছিলেন। তবুও আমার দাদা তাঁর সিদ্ধান্ত বদলাননি। সেই স্ত্রীকে ছেড়েই নিজের ভাগ্য অন্বেষণে চলে এসেছিলেন হাওড় অঞ্চলের কৃষ্ণপুর গ্রামে। তাঁর সঙ্গে পরিবারের আরও যাঁরা ছিলেন তাঁরা কেউ কেউ হাওড়ের কলিমপুর এবং হোসেনপুর নামক দুই গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। কৃষ্ণপুর গ্রামটা তখন হাওড় অঞ্চলের প্রসিদ্ধ গ্রাম ছিল। এখানে ব্রাহ্মণ ঠাকুররা বাস করতেন। ছিল সংস্কৃত টোল। এসব টোলে পড়ার জন্য কলকাতা থেকেও ছাত্ররা আসত। আমি আমার শৈশবেই সেই ঠাকুরদের দেখেছি। গ্রামেই ছিল চৌধুরীবাড়ি। নানান সম্প্রদায়ের মানুষ ছিল। মোদক, কামার-কুমার সবাই মিলে গ্রামটাকে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম বানিয়েছিল। ছিল একটি হাট। আশপাশে বিশ কিলোমিটারের মাঝে বেচাকেনার একটাই স্থান ছিল সেটি। এর পাশেই ছিল বৈষ্ণবদের আখড়া। আমার দাদা মুন্সী আলিমুদ্দিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছেড়ে হাওড় এলাকায় আসেন প্রায় দুই শ’ বছর আগে। ধারণা করা হয়, বাংলাদেশে ১৭৬২ সালের ২ এপ্রিল আরাকানকেন্দ্রিক ৮.৮ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়েছিল যার ফলে দেশের ভৌগোলিক পরিবর্তন ব্যাপকভাবে হয়েছিল। এর ফলে হাওড়াঞ্চল এবং ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথ বদলে গিয়েছিল বলেই এর পর পর ভৈরব থেকে নরসিংদী পর্যন্ত বিস্তৃত মেঘনার দু’পারের মানুষ হাওড়ের দিকে যাত্রা করেছিল। এই দুইশ’ বছরের রূপান্তরটাকে বস্তুত মাত্র বিশ বছরে কমিনে আনা যায়। এই সময় কালের ১৮০ বছরের জীবনপ্রবাহ একই ধারার ছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার চার দশকের মাঝে প্রথম দুই দশক বস্তুত সেই প্রাচীন সময়কালের ধারাবাহিকতাতেই কেটেছে। জীবনযাপনের ক্ষেত্রে মানুষ তেমন কোন পরিবর্তন চোখে দেখেনি। আমাদের কৃষিতে রূপান্তরটা হয়েছে স্বাধীনতার কিছুটা আগে। সেই সময়ে ইরি ধানের প্রচলন ও সেচ ব্যবস্থার বিকাশের জন্য কৃষির ফলন বাড়ে বহুগুণ। তবে বিগত দুই দশকে কৃষির চাষাবাদের বাইরে যেমন খামার গড়ে তোলা ও কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণে বিপুল পরিবর্তন হয়েছে। আমার দাদার বাড়ির সামনেই ছায়ার হাওড়। তাঁর আমলে এই হাওড়ের একটি নদীর নাম ছিল ছায়া নদী। নদীটি এখন বিলে পরিণত হয়েছে। তবে হাওড়টার নাম সেই নদীর নামেই রয়ে গেছে। হাওড়টি বিশাল। নেত্রকোনা জেলার খালিয়াজুরী উপজেলার কৃষ্ণপুর ইউনিয়নের প্রায় পুরোটা এই হাওড়েই পড়েছে। এর সঙ্গে রয়েছে সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার একাধিক ইউনিয়ন। দিরাই উপজেলার কিছু অংশও এই হাওড়েই পড়েছে। এই হাওড়ে তখন ছিল নলখাগড়ার বন। ছায়া বিল ছাড়াও আরও অনেকগুলো বিল আছে এই হাওড়ে। তবে ছায়া বিলের সঙ্গে অন্য বিলগুলোর কোন তুলনা হয় না। তখন পুরো হাওড়জুড়েই ঘন বন ছিল। আশপাশের গ্রামগুলোর অতি অল্পসংখ্যক মানুষ সেই বনের যতটা পরিষ্কার করতে পারত তাতেই চাষ করত। মাত্র একটিই ফসল ছিল, বোরো। বিলের ধারে নিচু জমিতে যেখানে কাঠের যন্ত্র দিয়ে পানি সেচ দেয়া যেত তাতেই চাষ হতো। আমার দাদা চাষাবাদ জানতেন না। মক্তবে পড়ানোই তাঁর একমাত্র কাজ ছিল। কিন্তু দাদি ছিলেন অসাধারণ পরিশ্রমী এক নারী। বস্তুত দাদার সংসারটাকে তিনিই গড়ে তোলেন। আমার দাদি আদির মা (জোহরা বেগম) একেবারে শূন্য থেকে গড়ে তোলেন তাঁর সংসার। জমিদারের তালুক কেনা ছাড়াও আশুগঞ্জে তৈরি করেন পাটের গুদাম। সেই গ্রামটির সামনের যে অনাবাদী বনাঞ্চল ছিল সেটি এখন পুরোটাই উধাও হয়ে গেছে। সম্ভবত এক ইঞ্চি মাটিও নেই যেখানে এখন চাষাবাদ হয় না। পুরো হাওড়জুড়ে বসে পাওয়ার পাম্প। যে জমিতে এক সময়ে বিঘাপ্রতি পাঁচ মণ ধান হতো এখন তাতে ফলন হয় ৩০ মণ। ইদানিং হাইব্রিড বীজেরও প্রসার ঘটেছে। তাতে ফলন আরও বেশি হয়। আমার দাদা তার পাঁচ পুত্র ও দুই মেয়ের মাঝে সবচেয়ে ছোট ছেলেটি ম্যাট্রিক পর্যন্ত লেখাপড়া করাতে পেরেছিলেন। তবে তার জন্যও তাঁকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরেই আসতে হয়েছিল। ঐ উপজেলার শ্যামগ্রাম নামক এক গ্রামের একটি হিন্দু বাড়িতে লজিং থেকে তিনি পড়াশোনা করেছিলেন। কারণ ১৯৭২ সালের আগে তার গ্রামে ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার কোন উপায় ছিল না। এক সময়ে এই গ্রামে সংস্কৃত টোল থাকলেও এতে কার্যকরভাবে হাই স্কুল চালু হয় ’৭২ সালেই। ’৬৯ সালে আমার উদ্যোগে আমার দাদার নামে স্কুলটির সূচনা হলেও সেটি আমার বাবার হাতে ’৭২-এর আগে কার্যকর হয়নি। এর আগে এওয়াইসি নামে আরও একটি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়ে অকালে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তখন সেই স্কুলে ছাত্র ও শিক্ষক কোনটাই পাওয়া যায়নি। মনে আছে দাদার বানানো মক্তবের জায়গাতেই আমগাছতলাতে দাঁড়িয়ে আমি স্কুল প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলাম। ক্লাস সিক্সে ছয়জন ছাত্র নিয়ে ’৭০ সালেই কৃষ্ণপুর বাজারে স্কুলটি শুরু হয়েছিল। কিন্তু সেটি টেকেনি। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ সেটিকে স্থবির করে দেয়। ’৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর সরকার সেই স্কুলটিকে প্রতিষ্ঠিত করতে সহায়তা করে। আমি প্রয়াত সাংসদ আব্দুল খালেক সাহেবের কথা প্রাসঙ্গিকভাবে স্মরণ করতে পারি। স্কুলটির স্বীকৃতি ও ভবন নির্মাণে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। স্কুলটি গড়ে তোলায় আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আব্দুল হক মাস্টার ও মাস্টার শহীদুল ইসলামের কথাও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করতে হবে। তাঁরা ছাড়াও গ্রামেরই শিক্ষক জনাব আব্দুল হান্নান ও আবিদউদ্দীন মাস্টার বিনা বেতনে শিক্ষকতা করে স্কুলটির সূচনা করেন। এই গ্রামটিকে পল্লব মোহাইমান বলেছেন হাওড়ের শিক্ষা গ্রাম। মাত্র চার দশকের রূপান্তরে এই গ্রামটি আর শুধু একটি গ্রাম নেই, এটি হয়ে উঠেছে হাওড়াঞ্চলের শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র। বস্তুত বাংলাদেশের উত্থানের প্রতীক এই গ্রামটি। এটি অতি পশ্চাদপদ একটি গ্রাম, যেখানে সড়ক নেই, বিদ্যুত ছিল না, শিক্ষা ছিল না, দুর্ভিক্ষ হানা দিত বছরে দু’বার, সেই গ্রামটিই এখন আড়াই হাজার বর্গকিলোমিটারের আদর্শের প্রতীক। সেই গ্রামটি দেখতেই ক’দিন আগে গত জুন মাসে আমি আমার পৈত্রিক বাড়িতে গিয়েছিলাম। ছোট ভাই রাব্বানী জব্বার বাড়িতে একটা দোতলা মসজিদ বানিয়েছে। এই গ্রামেরই মুন্সী আলিমুদ্দিন তালুকদারের ছোট ছেলে আব্দুল জব্বার তালুকদারের নাতনি ও আমার ছোট মেয়ে সুনন্দা শারমিনের স্থাপত্য নকশায় তৈরি অপূর্ব সুন্দর এই মসজিদটি প্রায় দুই বছরে নির্মিত হয়েছে। আড়াই হাজার বর্গকিলোমিটার হাওড় এলাকায় এমন সুন্দর স্থাপত্য এখনও আর একটিও নেই। পুরো টাইলস, ফ্যান, মাইক ব্যবস্থা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাসহ এটি এক অনন্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। মসজিদটার জুমার নামাজের সূচনা করতে বাড়ি যাওয়া। বাবা বেঁচে থাকলে এই কাজে আমাকে যেতে হতো না। বাবাই সবকিছু শুরু করে দিতেন। কিন্তু বাবা নেই বলে আমাকেই এই কাজটি করতে হয়। ঢাকা, ২৬ জুন, ২০১৫ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক ॥ ই-মেইল : [email protected] ওয়েবপেজ:ww w.bijoyekushe.net,ww w.bijoydigital.com
×