ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ওয়াহিদ নবি

অস্বীকার করলেই ভুল শুদ্ধ হয়ে যায় না

প্রকাশিত: ০৬:৪২, ২৮ জুন ২০১৫

অস্বীকার করলেই ভুল শুদ্ধ হয়ে যায় না

একই ভুল বিএনপি পর পর দু’বছর করেছে এবং এখন তার খেসারত দিচ্ছে। মনে হচ্ছে, তারা ভুল অস্বীকার করার চেষ্টা করছে এবং সেটা করে নিজেদের জনগণের কাছে হাস্যাস্পদ করে তুলছে। পেট্রোলবোমাবাজি ব্যর্থ হওয়ার পর যখন তারা নিজেদের ক্ষতস্থান চাটছিল তখন বাংলাদেশ সফরে এলেন দলবলসহ নরেন্দ্র মোদি। বিএনপি অতীত ভুল অস্বীকার করে নিজেদের তালগোল পাকানো অবস্থাকে সবার সামনে তুলে ধরল। এর ঠিক পরেই বের হলো মুজাহিদের রায়। যারা পুরনো কাহিনী ভুলে গিয়ছিলেন, তাদের আবার সব মনে পড়ল। এই তিনটি ঘটনা বিএনপির যে অবস্থার সৃষ্টি করল, তাকে বলা চলে ত্রিশঙ্কু অবস্থা। মানসিক বিভ্রান্তি যে তাদের তালগোল পাকানো অবস্থার জন্য দায়ী, এটা পরিষ্কার। তাদের নেতারা এখন বলছেন যে, তারা কোন কালে ভারতবিদ্বেষী ছিলেন না, এখনও নেই। তাদের ভাষায়Ñ ‘ম্যাডাম’ ভবিষ্যতেও হবেন না। ভবিষ্যতের কথা ভবিষ্যতই জানে। অতীতের কথা ভাবা যাক। তাদের নেত্রী বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জিতলে মসজিদে উলুধ্বনি শোনা যাবে। আসলে তারা সাম্প্রদায়িকতা আর ভারতবিরোধিতাকে এক করে ফেলেছেন। উনি উলুধ্বনিকে হিন্দুদের ব্যাপার মনে করেন। তিনি তো বেশ কয়েকবার আরব দেশে গেছেন। তিনি বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জিতলে ফেনী পর্যন্ত ভারত হয়ে যাবে। তারা মনে করেন, আওয়ামী লীগ ভারতের পক্ষে কাজ করে। বিএনপি নেতাদের কথাবার্তা শুনলে তাদের নেত্রীর কথার প্রতিধ্বনি শোনা যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক এক টকশোতে রেগেমেগে বললেন যে, ভারত আমাদের শত্রু, একথা রেখেঢেকে বলার প্রয়োজন নেই। ২০০১ সালের নির্বাচনের পরে হত্যাযজ্ঞ কারা চালিয়েছিল? রমনার বটমূলে কারা রক্ত ঝরিয়েছিল? বাঙালীর নিজস্ব উৎসবগুলোকে নিয়ে কটাক্ষ করে কারা? পহেলা বৈশাখের মিছিলের বিরুদ্ধে অপমানকর উক্তি শুনেছি টিভিতে প্রাক্তন এক মহিলা এমপির মুখে। ভারত সব নিয়ে গেল, আর আওয়ামী লীগ সব দিয়ে দিল; এমন কথা কি আমরা দিনের পর দিন শুনিনি! সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা কি আমাদের অজানা? বিএনপির গঠনের দিকে তাকালেই তাদের চিন্তাধারা সম্পর্কে একটা ধারণা করা যায়। তাদের দলে কারা আছেন, এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন নেই। শুধু এটুকু বললেই চলে যে, ভাসানী ন্যাপ আর মুসলিম লীগের মধ্যে মিলটা কোথায়? মুসলিম প্রধান দেশ বিধায় মুসলিম লীগ পাকিস্তানকে নিজের দেশ মনে করে। আর ’৭১-এ চীন ছিল পাকিস্তানের বন্ধু। চীন ছিল ভারতের শত্রু। কাজেই ভাসানী ন্যাপ পাকিস্তানের পক্ষে। সেদিনের ভাসানী ন্যাপের অনেকেই আজ সেভাবে চিন্তা করেন না। আজ চীনের চিন্তাধারাও আগের মতো নেই। গত বছর প্রকাশিত চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বই ‘গবার্নেন্স অব চায়না’ পড়লেই এটা বোঝা যায়। এই দুটি দলের আদর্শগত মিল ভারত বিরোধিতা। দুঃখের বিষয় এই যে, প্রাক্তন বামপন্থীদের অনেকেই সাম্প্রদায়িকতাকে পরিহার করেন না। ভারত বিরোধিতাকে মূলধন করে যারা রাজনীতি করেন, তাদের কথা বুঝতে হলে আমাদের চিন্তা করতে হবে স্বাধীনতাউত্তর কয়েকটি বছরের কথা। এটা করা উচিত একজন বাংলাদেশী হিসেবে। এই সময়ে বিভিন্নজনের ভূমিকা এই জন্য বোঝার চেষ্টা করতে হবে, যাতে করে এগুলো যেন আর না ঘটে, সেজন্য চেষ্টা করা। সে সময়ের কথা ভাবলে সব কিছু ছাপিয়ে মনে পড়ে বঙ্গবন্ধুর মর্মস্পর্শী আর্তনাদÑ ‘আমি ভিক্ষা করে নিয়ে আসি আর চাটার দল সব খেয়ে ফেলে’। এই চাটার দল সম্বন্ধে সবাইকে সাবধান হতে হবে। ধ্বংসস্তূপে পরিণত দেশ গড়ে তোলার পরিবর্তে সমাজতন্ত্রের বিশেষ বিশেষণ সামনে রেখে তাতে মেতে ওঠেন অনেকে। দেশ শাসনে অনভিজ্ঞ ছিলেন রাজনীতিবিদরা দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের কারণে। পাকিস্তানীরা চলে গছে। কাজেই তারা যা নিয়ে যেত, তা এখন আমরা নেবÑ এমনি মানসিকতা জন্ম নিল অনেকের মধ্যে। আমলারা সেনাশাসনের সময় সেনাকর্তাদের ‘জি হুজুর’ বলে নিজেরা কর্তৃত্ব চালিয়েছে। জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কাজ করার ব্যাপারে তাদের মধ্যে তেমন উৎসাহ দেখা গেল না। পাকিস্তানপন্থী আর চীনাপন্থীরা সব দোষ চাপিয়ে দেয় সরকারের ওপর। মরিয়া হয়ে বঙ্গবন্ধু ‘বাকশাল’ গঠন করার চেষ্টা করেন। পরবর্তীতে এই প্রচেষ্টাকে তীব্রভাবে সমালোচনা করেন অনেকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই সমালোচকদের মধ্যে ছিলেন অনেক চীনাপন্থী, যারা নিজেদের খাঁটি সাম্যবাদী বলে মনে করতেন। আর যারা বাকশালের হর্তাকর্তা হয়েছিলেন তাদেরও কেউ কেউ বাকশালের নিন্দা করেছিলেন। একজন বলেছিলেন, ‘সমস্ত জাতি আজ বাকশালীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ’। আসলে নিজের দলে গণতন্ত্র চর্চার নামগন্ধ না রেখে নিজেকে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা বলে চালানো মানুষেরা এমন কথা বলতেই পারেন। তার দলের একজন প্রভাবশালী তার বইতে লিখেছিলেন, ‘তিনি নিজের দলের লোকদের বাক্সবন্দী রাখতেন। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কিছু করার দরকার হলে তাদের ছেড়ে দিতেন। কাজ হয়ে গেলে তাদের আবার বাক্সবন্দী করে ফেলতেন’। মুজাহিদের প্রাণদণ্ড বহাল রইল। এদের বাঁচাবার জন্য ‘ম্যাডামের’ উৎসাহের শেষ ছিল না। ম্যাডামের ভারত বিরোধিতার এটা একটি কারণ। অনেকের বক্তব্য, জামায়াত থেকে বিএনপিকে বিচ্ছিন্ন করা। আমি এমন চিন্তাকে অর্থহীন মনে করি। বিএনপির ইতিহাসের দিকে তাকানো যাক। প্রথম থেকেই তারা বাংলাদেশ বিরোধীদের সঙ্গে সখ্য করেছে। জিয়াউর রহমানের সিনিয়র মন্ত্রী ছিলেন মশিউর রহমান। পরবর্তীতে শাহ আজিজুর রহমানকে বানান প্রধানমন্ত্রী। এরই ধারাবাহিকতায় ম্যাডাম আবদুর রহমান বিশ্বাসকে বানালেন রাষ্ট্রপতি আর মন্ত্রী হলেন নিজামী আর মুজাহিদ। এদের মধ্যে মান-অভিমান চলতে পারে, তবে ছাড়াছাড়ি হবে না। এরা নিজেদের স্বার্থ বেশ ভাল করেই বোঝে। পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছেÑ স্টেটসম্যান পত্রিকায় প্রকাশিত ম্যাডামকে করা মোদির তিনটি প্রশ্ন। এর উত্তর সবার জানা। ম্যাডাম লুকাবার চেষ্টা করছেন। ভারত বিরোধিতা আর সাম্প্রদায়িকতা তার দলের মূলমন্ত্র। আর জামায়াতের সঙ্গে সখ্যের যোগসূত্র। সাম্প্রদায়িকতা ত্যাগ করার ইচ্ছা থাকলে, তিনি নিজের ভুল স্বীকার করতেন। অসাম্প্রদায়িক আদর্শকে মেনে নিতেন রাজনীতিসহ জীবনের সর্বস্তরে। আজ তার দলের মধ্যে যে স্ববিরোধিতা দেখা দিচ্ছে, তার প্রধান কারণ অন্যদের প্রতারণার বাসনা। তিনি এবং তার দলের নেতারা অবশ্যই বুদ্ধিমান। কিন্তু অন্যরা বোকা নন। লেখক : রয়াল কলেজ অব সাইকিয়াট্রিস্টের একজন ফেলো
×