ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মার্কিন ডলারে নারীর ছবি একটি আনন্দ সংবাদ

প্রকাশিত: ০৬:৪১, ২৮ জুন ২০১৫

মার্কিন ডলারে নারীর ছবি একটি আনন্দ সংবাদ

সম্প্রতি মার্কিন ডলারে নারীর ছবি মুদ্রিত হওয়ার একটি সুখবর প্রচারিত হয়েছে। মার্কিন নারীবাদীদের দীর্ঘদিনের দাবি এটি। এ খবরে বাংলাদেশে আর কেউ না হলেও আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খুব খুশি হয়েছেন নিশ্চয়ই। কারণ বাংলাদেশের রাজনীতি, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য সারা দুনিয়ায় তিনি নন্দিত। উল্লেখ্য, সারা বিশ্বের রাজনীতি, আইনশৃঙ্খলা এবং উন্নয়ন থেকে শুরু করে রোগ-শোক, ওষুধ-বিষুধসহ সব বিষয়েই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোন না কোন একটা বক্তব্য, প্রস্তাব বা হস্তক্ষেপের অভিজ্ঞতা আমাদের রয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো- কোন্্ মহীয়সী নারীর ছবি মুদ্রিত হবে মার্কিন ডলারে? তিনি কে? কী তাঁর অবদান? কেনইবা তার ছবি মার্কিন ডলারে মুদ্রিত হতে পারে? এসব প্রশ্নের উত্তরে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আমার একটি যুক্তিসঙ্গত প্রস্তাব আছে। আমরা জানি, সব দেশের মুদ্রায় বা টাকায় ছবি থাকে। মুদ্রা প্রচলনের ইতিহাস আছে। প্রথমে ধাতব মুদ্রা, পরে সিল্ক, চামড়া, কাগজ ও এবং সর্বশেষ পলিমারের নোটের প্রচলন হয়েছে। প্রথম দিকে দেব-দেবী, জীবজন্তু-পাখি-শস্য, ঘোড়ার মুখ, ভাষার বিচিত্র ছাপচিত্র এবং ধীরে ধীরে রাজা-সম্রাট বা নৃপতিদের ছবি দিয়ে স্বর্ণ-রৌপ্য-ব্রোঞ্জ বা তামার মুদ্রার প্রচলন শুরু হয়। পরের দিকের এই ছবি মুদ্রণের উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায় প্রধানত সেই দেশের শাসক বা বীরদের কৃতিত্বগাথা প্রচার করা। আরও পরে দেখা যায় মুদ্রার মাধ্যমে জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও অহঙ্কারের কথা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সঞ্চারিত করার চিন্তা আসে মানুষের মনে। এ প্রক্ষাপটে আমার ভেতরে প্রথম প্রতিক্রিয়া হয় চীনে গিয়ে। সমাজকর্ম শিক্ষা বিষয়ক সম্মেলনে প্রবন্ধপাঠ ও কয়েক দিনের ভ্রমণে প্রথমত সাংহাইয়ের নানা ঐতিহাসিক স্থান ও নিদর্শন দেখি। তারপর ছোটবেলায় পাঠ্যপুস্তকে মুখস্ত করা সপ্তাচার্যের অন্যতম চীনের প্রাচীর বা গ্রেটওয়াল এবং তিয়েনয়ানম্যান স্কোয়ার ও ফরবিডেন সিটি দেখে নীল প্রিন্সকোট ও কালো চশমা পরিহিত মহামতি মাও-এর প্রশান্ত শায়িত দেহের পাশে দাঁড়িয়ে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করি। এভাবে চীন ভ্রমণের সময় যে বিষয়টি আমাকে অবাক ও আনন্দিত করল তা হচ্ছে, সকল মানের মুদ্রা বা কাগজের নোটে শুধু গণচীনের মহান নেতা মাও সে তুঙ-এর ছবি। মনে পড়ল, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মুদ্রায় আমাদের মহান নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি ছিল। চীন থেকে ফিরে শিব্বির আহমেদ সম্পাদিত যুক্তরাষ্ট্রের অনলাইন পত্রিকা খবরডটকম-এ দেয়া একটি সাক্ষাতকারে আমি ইতিহাস বিকৃতির ধারা উল্টে দেয়ার লক্ষ্যে একটি ইতিবাচক কৌশল হিসেবে বাংলাদেশের টাকায় শুধু বঙ্গবন্ধুর ছবি ছাপানোর প্রস্তাব করেছিলাম। বাংলাদেশের টাকায় বঙ্গবন্ধুর ছবির মুদ্রণ আমার প্রস্তাবে হয়েছে- এমন দাবি করার কোন প্রমাণ নেই। তবে বলতেই হবে শেখ হাসিনার সরকারের আমলে বাংলাদেশের টাকায় বঙ্গবন্ধুর ছবি মুদ্রিত হওয়াটা খুবই যৌক্তিক হয়েছে। আমি সমাজকর্ম বিষয়ের ছাত্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমার পড়াশোনার সুযোগ হয়নি। তবে ২০০৫ ও ২০০৯ সালে দু’বার পড়ানো, সেমিনার-ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ এবং একবার ফেলোশিপ পেয়ে এখন পর্যন্ত এশিয়ার একমাত্র ফেলো হিসেবে ওয়াশিংটন ডিসিতে ‘ক্যাথেরিন ক্যান্ডাল ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল সোশ্যাল ওয়ার্ক এডুকেশন’-এ গবেষণা করার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। এছাড়া বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী হিসেবে ২০১০ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে এবং কবি হিসেবে প্রবাসী বাংলাদেশীদের একাধিক সম্মেলনে যোগ দেয়া মিলিয়ে কয়েকবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। বিশেষ করে পড়ানো ও গবেষণার সুবাদে মার্কিনী সমাজের সঙ্গে মেলামেশা করে তাদের জীবনাচরণের দুটি প্রধান বৈশিষ্ট্য এখানে প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় উল্লেখ করতে চাই। এক. এই সমাজের মানুষদের মধ্যে এক জায়গায় থিতু হয়ে জীবনযাপনের আবেগ নেই। কাজ বা যে কোন প্রয়োজনে সাজানো ঘর-বাড়ি বিক্রি করে হরহামেশাই তারা এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে স্থানান্তরিত হয়। দুই. অধিকাংশ মানুষ চেতনায় কুঠরীবদ্ধ (পড়সঢ়ধৎঃসবহঃধষ) এবং এশিয়া-আফ্রিকার দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশের ছাত্রছাত্রী বা মানুষের মতো তাদের হরেক রকম বিষয়ে আগ্রহ নেই। কারণ শিক্ষা-দীক্ষা আয়-উপার্জন বা জীবিকার জন্যে আমাদের মতো অন্য দেশ বা সমাজের ওপর তাদের নির্ভরতা নেই বললেই চলে। আর বড় দাগে জীবিকাকে সহজ করার দায়িত্ব রাজনীতিক বা রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে যারা যুক্ত, তারাই পালন করেন। মার্কিন সমাজের এই বৈশিষ্ট্য দুটি উল্লেখ করার কারণ হচ্ছেÑ ২০০৫ সালে মিনেসোটার ইউনোনা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পড়ানোর সময় ক্লাসে ছাত্রছাত্রীদের কাছে কৌতূহলবশত আমি জাতিসংঘের হেড-কোয়ার্টারস কোথায় জানতে চেয়েছিলাম। স্নাতক চতুর্থ বর্ষের ক্লাসের ছাত্রছাত্রীর মধ্যে আমার এক ষাটোর্ধ বয়সী ছাত্র মি. বব সঠিক উত্তর দিয়েছিলেন। মি. বব মিনেসোটার একজন বড় কর্মকর্তা ছিলেন। মানবতার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার জন্য অবসর গ্রহণের পর সমাজকর্ম বিষয়ে পড়ছিলেন। তরুণ-তরুণীরা কেউ বলতে পারেনি। তারা পড়ে, কাজ করে, জীবনকে ওড়ায়, পোড়ায়- তারপর একদিন চলে যায়। যা হোক, মার্কিন ডলারে এমন একজন মহীয়সী নারীর ছবি মুদ্রণের প্রস্তাব আমি করছি, যার পিতা ছিলেন ইলিনয় রিপাবলিকান পার্টির একজন প্রতিষ্ঠাতা সভ্য, স্টেট সিনেটর (১৮৫৫-১৮৭০) এবং প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের বন্ধু ও অনুরাগী। এই নারীর জন্ম ১৮৬০ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ও মৃত্যু ১৯৩৫ সালের ২১ মে। এই মানবদরদী নারী একজন সমাজকর্মী হিসেবে ১৮৮০ সাল থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত ইংল্যান্ড থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আগত ধনী-দরিদ্রের অভিবাসন ও বসবাসের আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনি একাধারে সমাজবিজ্ঞানী, লেখক ও নারীর ভোটাধিকারের অগ্রসৈনিক (প্রসঙ্গত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নারীর ভোটাধিকার স্বীকৃতি পায় ১৯২০ সালে; সর্বপ্রথম স্বীকৃতি পায় ১৮৯৩ সালে নিউজিল্যান্ডে) এবং বিশ্বশান্তি আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেত্রী। তিনি প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ও উইথড্রো উইলসনের সংস্কার উদ্যোগের সক্রিয় সহযোদ্ধা; যিনি ১৮৮৯ সালে শিকাগোতে মানবকল্যাণের উজ্জ্বল প্রতীক ‘হাল হাউস’ প্রতিষ্ঠা করে প্রধানত ইউরোপ থেকে আগত শ্রমজীবী অভিবাসীদের বৃত্তি, শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও শিশু শিক্ষার সুযোগ করে দিয়েছেন। (বলা বাহুল্য, ‘হাল হাউস’ সারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমাজকর্ম বিষয়ের শিক্ষার্থীদের তীর্থস্থান; আমারও দেখার সৌভাগ্য হয়েছে)। তিনি দাস-ব্যবসার উত্তুুঙ্গযুগে বলপূর্বক পতিতাবৃত্তির বিরুদ্ধে গ্রন্থ লিখে প্রতিবাদ করেছেন (দেখুন ১৯১২ সালে প্রকাশিত তার গ্রন্থ ‘এ্যা নিউ কন্শ্যান্স এ্যান্ড এ্যান এন্শেন্ট ঈভ্ল্’/অ ঘবি ঈড়হংপরবহপব ধহফ ধহ অহপরবহঃ ঊারষ )। তিনি চিকিৎসা, জনস্বাস্থ্য ও সুন্দর শহর গড়ে তোলার পথে আমলাতান্ত্রিক প্রতিবন্ধকতার কারণ হিসেবে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ও ব্যবসায়ীদের অর্থলিপ্সাকে চিহ্নিত করেছেন। তিনি প্রাতিষ্ঠানিক সমাজকর্ম শিক্ষা-প্রশিক্ষণের অগ্রদূতদের অন্যতম এবং সারা মার্কিন মুলুকে, বিশেষ করে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিয়ে ও প্রবন্ধপাঠ করে জনসমাজকে হাতে-কলমে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করেছেন। নন্দিত সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে তিনি ১৯০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত আমেরিকার সামাজিক বিজ্ঞান সমিতির চার্টার মেম্বার মনোনীত হয়েছিলেন। তিনি প্রথম মার্কিন নারী ১৯৩১ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। এই মহীয়সী নারীর নাম জেইন এডামস (ঔধহব অফফধসং)। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এমন একজন মহীয়সী নারীর ছবিই আমি দশ মার্কিন ডলারে মুদ্রণের প্রস্তাব করছি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এবং যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ মহীয়সী নারী জেইন এডামসের অবদান কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করে আমার বিনীত প্রস্তাবটি ভেবে দেখতে পারেন। আমার বিশ্বাস, ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস নিশ্চয়ই আমার প্রস্তাবটি বিবেচনার জন্যে তাদের সরকারের গোচরে আনবেন। লেখক : কবি, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও উপাচার্য, ইউআইটিএস
×