ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

প্রতিবেশী হলেও আস্থার সঙ্কট কাটছে না মিয়ানমারের সঙ্গে

প্রকাশিত: ০৬:৩৯, ২৮ জুন ২০১৫

প্রতিবেশী হলেও আস্থার সঙ্কট কাটছে না মিয়ানমারের সঙ্গে

তৌহিদুর রহমান ॥ বাংলাদেশ-মিয়ানমারের ভৌগোলিক নৈকট্য ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে প্রত্যাশিত সম্পর্ক তৈরি হয়নি। দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ‘আস্থার সঙ্কট’ রয়েছে। প্রধানত রোহিঙ্গা সমস্যাই প্রতিবেশী দুই দেশের সম্পর্কে ‘কাঁটা’ হওয়ায় এ আস্থার সঙ্কট তৈরি হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে গভীর সম্পর্ক তৈরির লক্ষ্যে উভয়ের পররাষ্ট্র নীতিতে এ বিষয়ে গুরুত্ব দেয়ার পক্ষে মতামত দিয়েছেন কূটনীতি বিশেষজ্ঞরা। ১৭ জুন বাংলাদেশ সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর নায়েক আবদুর রাজ্জাককে মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষীবাহিনী তুলে নিয়ে যায়। বাংলাদেশের জলসীমা থেকে তুলে নেয়ার পরে প্রায় ৮ দিন পরে ফেরত দেয় মিয়ানমার। এ ঘটনায় মিয়ানমারের ঢাকায় নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত মিউ মিন্ট থানকে তলব করা হয়। এছাড়া চলতি মাসের ৫ জুন মিয়ানমারের ঢাকায় নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতকে মিউ মিন্ট থানকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করা হয়েছিল। নে পি দোতে এক কূটনৈতিক ব্রিফিংয়ে রাখাইন রাজ্যের একজন মন্ত্রী অযৌক্তিভাবে বলেছিলেন ‘বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক দুরবস্থার কারণে মানুষ অবৈধভাবে দেশান্তরিত হতে বাধ্য হচ্ছে’। ওই মর্যাদাহানিকর বক্তব্যের প্রেক্ষিতে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তখন তলব করা হয়। মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নিজেদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি না দেয়ায় শরণার্থী সমস্যা দু’দেশের সম্পর্কের ‘কাঁটা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে প্রায় ৫ লাখ মিয়ানমারের রোহিঙ্গা শরণার্র্থী অবস্থান করছে। তবে কেউ কেউ মনে করেন এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি। কক্সবাজার সীমান্তে কুতুপালং ও নয়াপাড়া শরণার্থী ক্যাম্পে প্রায় ৩০ হাজার তালিকাভুক্ত শরণার্থী রয়েছে। অবশ্য জাতিসংঘের শরণার্থী পর্যবেক্ষণ বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের হিসেবে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা দুই লাখ। এর আগে ১৯৯১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত দুই লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীকে ফিরিয়ে নিয়েছিল মিয়ানমার। তারপর থেকে এ প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। এরপর গত বছর আগস্ট মাসে ঢাকায় অষ্টম পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবসন প্রক্রিয়া শুরুর প্রতিশ্রুতি দেয় মিয়ানমার। সে অনুযায়ী দেশটি দুই হাজার ৪১৫ জন রোহিঙ্গা নাগরিককে ফিরিয়ে নিতে রাজী হয়। তবে এখনও তারা কোন রোহিঙ্গা নাগরিককে ফিরিয়ে নেয়নি। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে বাঁধার বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, দুই দেশের মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। আর এই আস্থাহীনতা মূলত রোহিঙ্গা সমস্যার কারণেই হয়েছে। তবে দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে আরও বিভিন্ন বিষয়ে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক রয়েছে। সেসব সম্পর্ক যদি বাড়ানো যায়, তাহলে এই আস্থাহীনতা কেটে যাবে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কূটনীতি বিশেষজ্ঞ ড. দেলোয়ার হোসেন জানান, বাংলাদেশ-মিয়ানমারের সম্পর্ক বাড়াতে হলে দুই দেশের পররাষ্ট্রনীতির মধ্যে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে। এছাড়া বাংলাদেশ, ভারত, চীন ও মিয়ানমার যে বিসিআইএম গড়ে তুলতে চলেছে সেটিকে কার্যকর করতে পারলে দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সম্পর্ক বাড়বে। রোহিঙ্গা সমস্যাকে পেছনে ফেলেও বাণিজ্য, পর্যটন, শিক্ষা, মানুষে মানুষে যোগাযোগ ইত্যাদির মাধ্যমে দুই দেশের সম্পর্ককে এগিয়ে নেয়া যায় বলেও মত দেন তিনি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে ১৯৮০ সালে সীমান্ত শূন্য রেখা চুক্তি অনুষ্ঠিত হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী দুই দেশ নিজ নিজ সীমান্ত শূন্য রেখার তিনশ’ গজের মধ্যে কোন স্থাপনা তৈরি করতে পারবে না। তবে মিয়ানমার এই চুক্তি ভেঙ্গে চারটি ক্যাম্প স্থাপন করে। গত বছর জানুয়ারি মাসে নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের আশারতলি এলাকায় এ ক্যাম্প স্থাপন করে। এ ঘটনায় সে সময় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ জানানো হয়। পরবর্তীতে বাংলাদেশ কাউন্টার ক্যাম্প স্থাপন করার হুমকি দিলে মিয়ানমার তাদের ক্যাম্প প্রত্যাহার করে নেয়। এছাড়াও এর আগে কয়েকবার মিয়ানমার সীমান্তে ক্যাম্প স্থাপন করে শূন্য রেখা চুক্তি লঙ্ঘন করে মিয়ানমার। গত বছর দুই দেশের সীমান্ত বৈঠকে শূন্য রেখা চুক্তি লঙ্ঘনের বিষয়ে মিয়ানমারকে সতর্ক করে দেয়া হয়। এর আগে গত বছর ২৮ মে মিয়ানমার সীমান্তে বিজিবির নায়েক মিজানুর রহমান নিহত ও নিখোঁজের ঘটনায় দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়। ঢাকায় নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তখন দুই দফায় তলব করে প্রতিবাদ জানানো হয়। এছাড়া ১৯৯১ সালে নাইক্ষ্যংছড়ির রেজু আমতলী ক্যাম্পে হামলা চালিয়ে বাংলাদেশী সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর একজন সদস্যকে হত্যা করেছিল মিয়ানমার। সেই ঘটনার প্রতিবাদ জানানোর পরে মিয়ানমার দুঃখ প্রকাশ করেছিল। সূত্র জানায়, দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে এখনও প্রত্যাশিত সম্পর্ক তৈরি হয়নি। তবে ২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মিয়ানমারের সফরের মধ্যে দিয়ে দুই দেশের মধ্যে নতুন অভিযাত্রা সূচিত হয়। এছাড়া গত বছর ঢাকায় দেশ দুটির পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের অষ্টম বৈঠক হয়। সেখানে উভয় দেশই পারস্পারিক সহনশীলতা ও সদিচ্ছার মাধ্যমে সীমান্ত রক্ষা, বাণিজ্য-বিনিয়োগ, আন্তঃসংযোগ, জ্বালানি নিরাপত্তা, বিসিআইএম ও বিমসটেকের উদ্যোগগুলোতেও একত্রে কাজ করার জন্য আলোচনা হয়। তবে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে কোনভাবেই যেন গতি পাচ্ছে না। এদিকে বর্তমানে দেশটিতে চলমান সংস্কার প্রক্রিয়ার জন্য অনেক দেশই অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের আকর্ষণীয় ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করেছে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে একটি শক্তিশালী সম্পর্ক তৈরি করলে উভয়দেশের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সুফল বয়ে আনতে পারে বলে কূটনীতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, মিয়ানমারের প্রায় ৫০ বছরের একাকিত্ব এখন ভেঙেছে। তারা এখন সংস্কার প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে বিশ্বের দরবারে উন্মুক্ত হচ্ছে। এখন দেশটি বিদেশী উদ্যোক্তা ও উন্নয়ন অংশীদারদের জন্যও তার দুয়ার খুলছে। সে কারণে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধির সম্ভাবনার পাশাপাশি রেল ও সমুদ্রপথে যোগাযোগ বৃদ্ধির ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যুসহ বেশ কয়েকটি বিষয়ে মতপাথর্ক্য থাকা সত্ত্বেও পারস্পারিক সহযোগিতা আরও সম্প্রসারণ করা সম্ভব।
×