ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

দেশে অতিদরিদ্রের সংখ্যা মাত্র ১২ শতাংশ

পাঁচ বছরে দারিদ্র্য কমার বিস্ময়কর সাফল্য

প্রকাশিত: ০৬:৩৬, ২৮ জুন ২০১৫

পাঁচ বছরে দারিদ্র্য কমার বিস্ময়কর সাফল্য

হামিদ-উজ-জামান মামুন ॥ পরিকল্পিত অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সুফল মিলছে। অর্জিত প্রবৃদ্ধির ফল পৌঁছাচ্ছে সারাদেশে। যার প্রতিফলন ঘটছে দারিদ্র্য হারে। চলতি বছরের (২০১৫ সাল) সর্বশেষ প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী দেশে বর্তমানে দারিদ্র্যের হার ২৩ দশমিক ৬ শতাংশ, যা ২০১০ সালে ছিল ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ। অন্যদিকে কমেছে অতি দারিদ্র্যও। এ হার দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ৩ শতাংশে, যা ২০১০ সালে ছিল ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) মূল্যায়নে দারিদ্র্য হ্রাসের এ চিত্র উঠে এসেছে। বলা হয়েছে প্রতিবছর দারিদ্র্য কমছে ১ দশমিক ৭৪ শতাংশ হারে। দারিদ্র্য কমার কারণ পরিকল্পিত অর্থনৈতিক কার্যক্রম, বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচী যেমন, ভিজিডি, ভিজিএফ, জিআর, ওএমএস কর্মসূচী, টেস্ট রিলিফ, কাবিখা এবং ফেয়ার প্রাইস কার্ড প্রভৃতির কার্যকর বাস্তবায়ন। এর আগে চলতি বছরের শুরুতে বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট এ্যানেট ডিক্সন বলেছিলেন, দারিদ্র্য নিরসন ও মানব উন্নয়নে বাংলাদেশ অন্যান্য দেশের কাছে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের এই অভিজ্ঞতা থেকে অন্য দেশগুলো শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে পাঁচ দিনের সফর শেষে ঢাকা ত্যাগ করার আগে তিনি এসব কথা বলেছিলেন তিনি। সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, দারিদ্র্যবান্ধব উন্নয়ন কৌশল গ্রহণের কারণেই দারিদ্র্য হার প্রত্যাশিত মাত্রায় কমে আসছে। চলমান ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মধ্য মেয়াদি বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ সম্পন্ন হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হাইজ হোল্ড ইনকাম এ্যান্ড এক্সপেনডিচার সার্ভের (হায়েস) তথ্য অনুযায়ী ২০০০ থেকে ২০১০ সাল সময়ে দারিদ্র্য গড়ে এক দশমিক চুয়াত্তর শতাংশ হারে হ্রাস পাচ্ছে। এ প্রবণতা নিঃসন্দেহে একটি তাৎপর্যপূর্ণ অর্জন। তিনি জানান, বাংলাদেশ প্রেক্ষিত পরিকল্পনা (২০১০-২১) অনুযায়ী ২০২১ সাল নাগাদ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী জনগণের সংখ্যা ১৩ দশমিক পাঁচ শতাংশে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মেয়াদ শেষে চলতি বছর বাইশ দশমিক পাঁচ শতাংশে দারিদ্র্য হার নামিয়ে আনার লক্ষ্য স্থির করা হয়। এই লক্ষ্যের বিপরীতে গত পাঁচ বছরে দেশে দারিদ্র্য হ্রাসের হার হচ্ছে, ২০১১ সালে উনত্রিশ দশমিক ছয় শতাংশ, ২০১২ সালে সাতাশ দশমিক আট শতাংশ, ২০১৩ সালে ছাব্বিশ দশমিক চার শতাংশ এবং ২০১৪ সালে পঁচিশ শতাংশ। আর অতি দারিদ্র্যের হার গত পাঁচ বছরে কমেছে যথাক্রমে ষোল দশমিক তিন শতাংশ, পনের দশমিক দুই, চৌদ্দ দশমিক দুই এবং ২০১৪ সালে তের দশমিক দুই শতাংশ। জিইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত খানা আয়-ব্যয় জরিপের মাধ্যমে দারিদ্র্য পরিমাণ করা হয়। দেশে সর্বপ্রথম ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে খানা আয়-ব্যয় জরিপ পরিচালিত হয় এবং পরবর্তীকালে আরও কয়েকটি জরিপ পরিচালিত হয়। সর্বশেষ খানা আয়-ব্যয় জরিপ পরিচালিত হয় ২০১০ সালে। ১৯৯১-৯২ অর্থবছর পর্যন্ত পরিচালিত খানা আয় ব্যয় জরিপে দেশেল দারিদ্র্য পরিমাণের জন্য খাদ্য শক্তি গ্রহণ এভং প্রত্যক্ষ ক্যালরি গ্রহণের পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। সেক্ষেত্রে দারিদ্র্য পরিমাপে জনপ্রতি প্রতিদিন দুই হাজার ১শ’ বাইশ কিলোক্যালরির নিচে খাদ্য গ্রহণকে দারিদ্র্য এবং এক হাজার ৮০৫ কিলোক্যালরির নিচে খাদ্য গ্রহণকে চরম দারিদ্র্য হিসেবে গণ্য করা হতো। পরবর্তীতে প্রথমবারের মতো ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরে পরিচালিত খানা আয়-ব্যয় জরিপে মৌলিক চাহিদা ব্যয় পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। অনুরূপভাবে পরবর্তীতে দুটি জরিপ পরিচালনা করা হয়। কিন্তু ২০১০ সালে এসে পরিচালিত খানা আয়-ব্যয় জরিপে মৌলিক চাহিদা ব্যয় পদ্ধতিকে দারিদ্র্য পরিমাপে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত ভোগ্যপণ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ পদ্ধতিতে খাদ্যের ক্ষেত্রে দুই হাজার একশ বাইশ কিলোক্যালরির মাত্রা ঠিক রেখে এর ক্রয় ব্যয় ও খাদ্যবহির্ভূত ভোগ্যপণ্য ক্রয় ব্যয়কে একত্রিত করে মাসিক জনপ্রতি এক হাজার ছয়শ’ টাকার নিচে আয়কে দারিদ্র্য হিসাবে এবং মাসিক জনপ্রতি এক হাজার তিনশ টাকার নিচে আয়কে অতি দারিদ্র্য হিসেবে গণ্য করা হয়। পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, বর্তমান সরকার প্রথম মেয়াদে দায়িত্ব গ্রহণের পর পরই দেশের জনগণের প্রত্যাশা পূরণে পরিকল্পিত উন্নয়ন ব্যবস্থা প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অন্তর্বর্তীকালীন উন্নয়ন কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার স্বার্থে গত তত্ত্বাবধায় সরকার আমলে প্রণীত দারিদ্র্য নিরসন কৌশলপত্রটি বাতিল না করে সংশোধন করা হয়। এক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারের উন্নয়ন দর্শন ও লক্ষ্যের আলোকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে সংসদে আলোচনার মাধ্যমে জাতীয় দারিদ্র্য নিরসন কৌশলপত্র-২ (২০০৯-১১) দিন বদলের পদক্ষেপ প্রণয়ন করা হয়। ওই সময় সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ মনে করেছিল স্বল্প সময়ে পরিকল্পনার মাধ্যমে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অম্ভব। এ প্রেক্ষাপটে সরকার স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে সামনে রেখে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রথমবারের মতো দীর্ঘ মেয়াদি রূপকল্প হিসেবে বাংলাদেশ প্রেক্ষিত পরিকল্পনা (২০১০-২১) শীর্ষক পরিকল্পনা দলিল প্রণয়ন করে। পরিকল্পনায় দেশের কাক্সিক্ষত উন্নয়নের কৌশলগত লক্ষ্যমাত্রাসমূহ উল্লেখ করে আপামর জনসাধারণের আশা-আকাক্সক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে জাতির দীর্ঘ মেয়াদি উন্নয়ন দর্শন ও স্বপ্ন প্রতিফলিত করা হয়েছে। এই দীর্ঘমেয়াদি রূপকল্পের মৌলিক উদ্দেশ্য হচ্ছে উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন এবং ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করা, যেখানে দারিদ্র্য সর্বনিম্ন পর্যায়ে অবস্থান করবে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে আঞ্চলিক বৈষম্য হ্রাস পাবে। সরকার ঘোষিত দীর্ঘমেয়াদি রূপকল্প ২০২১ এর আলোকে প্রণীত প্রেক্ষিত পরিকল্পনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ দুটি মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে অর্জন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ দুটি মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা হচ্ছে ষষ্ঠ ও সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। এ প্রেক্ষিতে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ মাত্র আঠার মাসের মধ্যে প্রণয়ন করে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০১১-১৫), যা প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (এনইসি) ২০১১ সালের জুন মাসে অনুমোদন করা হয় এবং জুলাই মাস থেকে বাস্তবায়ন শুরু হয়। চলতি জুন মাসে শেষ হচ্ছে এই ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। ফলে আগামী জুলাই মাস থেকে বাস্তবায়নের জন্য চূড়ান্ত করা হয়েছে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। এ পরিকল্পনায় বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা এবং দেশের অর্থনীতির নিজস্ব সক্ষমতা বিবেচনায় নিয়ে আগামী পাঁচ বছরে দারিদ্র হার ১৬ দশমিক ৬ শতাংশে এবং অতি দারিদ্র্য হার ৮ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। তাছাড়া ২০৩০ সালের মধ্যে চরম দারিদ্র্য শুন্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মকৌশল গ্রহণের বিষয়টিও সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বলে জানা গেছে। সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের আর আগের এক মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের দারিদ্র্য কমানোর ক্ষেত্রে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। সরকার সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচীতে সবসময় বরাদ্দ বাড়িয়ে চলছে। বলা হয়েছে সরকারের দারিদ্র্যবান্ধব নীতি ও বিচক্ষণ কর্মসূচীর কারণে বাংলাদেশে খাদ্যভাব এখন নেই। দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সরকার সুলভ মূল্যে খাদ্য সরবরাহের পাশাপাশি তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে নানামুখী আয়বর্ধক কর্মসূচী বাস্তবায়ন করছে। তুলনামূলকভাবে অতিদরিদ্র এলাকাসহ (উত্তরাঞ্চল, উপকূলবর্তী এলাকা ও যমুনা-ব্রহ্মপুত্রের চরাঞ্চল ইত্যাদি) এলাকার খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য অতি-দরিদ্রের জন্য কর্মসস্থান কর্মসূচী বাস্তবায়ন করছে। এ কর্মসূচীর আওতায় প্রতিবছর গড়ে এক হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে ৮ লাখ লোকের ৮০ দিনের কর্মসংস্থান করা হয়েছে। গত পাঁচ বছরে দেশের উত্তরাঞ্চলে মঙ্গার পদধ্বনি শোনা যায়নি। চালের মূল্যের সঙ্গে তুলনা করে দেখা গেছে গত চার বছরে শ্রমিকদের মজুরি দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। একদিনের মজুরি দিয়ে একজন শ্রমিক প্রায় সাড়ে আট কোটি চাল কিনতে পারছে, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। অন্যদিকে ২০০৫-০৬ অর্থবছরে শ্রমিকের একদিনের মজুরি দিয়ে পাঁচ দশমিক সাত কোটি চাল কেনা যেত।
×