ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নির্যাতিত গৃহবধূ ঢাকা মেডিক্যাল থেকে ফিরে গেল স্বামীর সংসারে

প্রকাশিত: ০৬:৩৫, ২৮ জুন ২০১৫

নির্যাতিত গৃহবধূ ঢাকা মেডিক্যাল থেকে ফিরে গেল স্বামীর সংসারে

শর্মী চক্রবর্তী ॥ চিকিৎসার কথা বলে হাসপাতালে ফেলে যাওয়া গৃহবধূ ফিরে গেলেন তার স্বামীর সংসারে। গৃহবধূ আফিফা (১৯)। নির্যাতনের শিকার এই গৃহবধূ ও তার দুই মেয়েকে চিকিৎসার কথা বলে ঢাকা মেডিক্যালে রেখে চলে গিয়েছিলেন তার শাশুড়ি। আড়াই বছরের কন্যা আয়শা আক্তার ও দেড় বছরের নূরুন নাহারকে নিয়ে জরুরী বিভাগের মেঝেতে পড়ে থাকা আফিফার জায়গা হয়েছিল ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি)। ৬ দিন পর শনিবার ওসিসির সমন্বয়কারী বিলকিস বেগমের মাধ্যমে হাসপাতালে ফেলে যাওয়া সেই গৃহবধূকে সংসারে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন তার স্বামী। সিলেটের জাফলংয়ের গৃহবধূ আফিফা। প্রেমের টানে ১৩ বছর বয়সে ধর্ম ত্যাগ করে বিয়ে করেন তিনি। এজন্য সব কুলই হারিয়েছেন এই কিশোরী গৃহবধূ। বিয়ের পাঁচ বছর যেতে না যেতেই শুরু হয় পরিবারের ও স্বামীর নির্যাতন। শাশুড়ি তাকে সহ্য করতে পারতেন না। পারিবারিক নির্যাতনের ফলে শারীরিকভাবে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন আফিফা। অসুস্থ পুত্রবধূকে চিকিৎসা করানোর কথা বলে গত ২০ জুন শাশুড়ি শামসুন্নাহার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসে। তখন পুত্রবধূ আর নাতি-নাতনিকে জরুরী বিভাগে রেখে ইফতারি কিনার কথা বলে বের হয়ে যান আর ফিরে আসেননি। দুখিনী আফিফা তার দুই সন্তানকে নিয়ে প্রায় ২০ ঘণ্টা পড়েছিলেন জরুরী বিভাগের মেঝেতে। এক সময় হাসপাতালের কর্মচারী ও রোগীর স্বজনরা অসহায় আফিফাকে দেখে তাকে মেডিসিন বিভাগ হয়ে ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে ভর্তি করায়। আফিফা সন্তানদের নিয়ে পড়েছিলেন ওসিসিতে। তাকে দেখার কেউ ছিল না। ৬ দিন কেউ তার খোঁজ নেয়নি। শনিবার পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ দেখে তার স্বামী রাকিব হাসান স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিতে আসেন। তখন রাকিব বলেন, আমি তাকে কখনও নির্যাতন করিনি। আমি ঢাকায় কাজ করি। মাঝে মাঝে বাড়িতে যাই। বাড়িতে আমার বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকে সে। তাদের সঙ্গে তার তেমন বনিবনা হতো না। এ কারণেই এমনটা হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। আফিফা বলেন, ২০১০ সালে ছাতক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময় এক বান্ধবীর মাধ্যমে তাকে প্রেমের প্রস্তাব দেয় রাকিব হাসান। বান্ধবীর কথায় আর অবুঝ বয়সের প্রথম প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায় পূজা নামের মেয়েটি। এর কয়েকদিন যেতে না যেতেই হিন্দু-মুসলিম ধর্মে বাদ সাধে পূজার পরিবার। তাদের বাধার মুখেই প্রেমের মূল্য দিতে পূজা ধর্মান্তরিত হয়ে আফিফা নাম ধারণ করে রাকিব হাসানকে বিয়ে করেন। মেয়ে ধর্মান্তরিত আর বাল্যবিয়ের অপরাধে আইনী ঝামেলা এড়িয়ে আফিফার বাবা-মা তাকে ত্যাজ্য করেন। আফিফার গ্রামের বাড়ি জাফলংয়ের ছাতক খেওয়াপাড়া এলাকায়। আফিফা বলেন, বিয়ের পর বাবা-মা ও ছোট বোনকে ছেড়ে এসে স্বামীর দিন আনে দিন খায় রোজগারেও তার সংসার সুখেই কাটছিল। এরই মধ্যে একটি কন্যা আসে। কিন্তু দ্বিতীয় কন্যা আসার পর পরই তিনি দিন দিন স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকদের শত্রুতে পরিণত হন। কথায় কথায় শুরু হয় মানসিক নির্যাতন। বাবা-মা ত্যাজ্য করলেও সেখানে গিয়ে টাকাপয়সা আনার জন্য রাকিব হাসান ও তার পরিবারের সদস্যরা তাকে শারীরিক নির্যাতন করে আসছিল। তিনি বলেন, সন্তানদের কথা ভেবে মুখ বুজে রাকিবের সব নির্যাতন সহ্য করে আসছিলাম। ভাবছিলাম নিজের ভুলে বিয়ে করেছি। মেয়ে দুটিকে যতœ করে বড় করব। বড় হলে তাদের বোঝাব যেন আমার মতো ভুল না করে। শাশুড়িও তাকে অন্য চোখে দেখা শুরু করে। কিন্তু সীমাহীন নির্যাতনের মধ্যেই দেড়মাস আগে সেই রাকিব হাসান ঢাকায় চলে আসে। তার কোন খবর পাই না। বাড়িতে টাকা পাঠায় কিনা তাও জানি না। শাশুড়ির যখন ইচ্ছা খাবার দিত। এভাবে খেয়ে, না খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে শাশুড়িই আবার দয়া দেখিয়ে ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু সেদিন আমাকে রেখে তিনি চলে গিয়েছিলেন। কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে ততক্ষণে দুচোখ জলে ভেসে যায় আফিফার। ওসিসির সমন্বয়কারী বিলকিস বেগম বলেন, জরুরী বিভাগে পড়ে থাকা আফিফার অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তাকে মেডিসিন বিভাগে ভর্তির পর ওসিসিতে স্থানান্তর করা হয়। তখন তার সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম পুরো ঘটনা। পরিবারের সদস্যরা তার ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করত। শুধু তাই নয়, তাকে সহ্য করতে পারত না বলেই তার শাশুড়ি চিকিৎসার কথা বলে ঢাকা মেডিক্যালে ফেলে রেখে যায়। তখন থেকেই ওসিসিতে চিকিৎসাধীন আফিফা। ৬ দিন পর তার স্বামী আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং সে দাবি করে আফিফার ওপর সে কোন নির্যাতন করেনি। সে আফিফাকে ফিরিয়ে নিতে চায়। পরে মেডিক্যালে এসে রাকিব জানাল সে আফিফাকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জে থাকবে। এবং পরবর্তীতে এমন ঘটনা হবে না বলে রাকিব হাসান আশ্বস্ত করে। তাই আফিফাকে তার সন্তানসহ আমরা তার স্বামীর সঙ্গে দিয়ে দিই।
×