ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

তিন দফা পিছিয়েও ভর্তিতে মনোনীতদের তালিকা প্রকাশ হয়নি

কলেজে ভর্তি নিয়ে তুঘলকি কাণ্ড

প্রকাশিত: ০৬:১৫, ২৮ জুন ২০১৫

কলেজে ভর্তি নিয়ে তুঘলকি  কাণ্ড

বিভাষ বাড়ৈ ॥ কলেজে ভর্তি নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের তুঘলকি কর্মকা-ে দেশজুড়ে চরম ভোগান্তি আর হয়রানির কবলে পড়েছে সাড়ে ১১ লাখ শিক্ষার্থী। সঙ্কট তৈরি হয়েছে ট্রান্সক্রিপ্ট বিতরণ কার্যক্রম নিয়েও। উদ্বেগের মধ্যে পড়েছেন কলেজ ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের আরও ২৩ লাখ অভিভাবক। তিন দফা পিছিয়ে নতুন নতুন সময় দিয়েও কলেজে ভর্তির জন্য মনোনীতদের তালিকা প্রকাশ করতে পারেনি মন্ত্রণালয়, বোর্ড ও কার্যাদেশ পাওয়া প্রতিষ্ঠান বুয়েটের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। ফল প্রকাশের জন্য আজ আবার সময় দেয়া হয়েছে। প্রতিদিনই বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলা হচ্ছে, ‘আজ রাতে ফল প্রকাশ হচ্ছে’। অথচ লাখ লাখ শিক্ষার্থী ও কলেজ কর্তৃপক্ষ সারারাত জেগেও ফলের কোন হদিস পাচ্ছেন না। নিজেদের সক্ষমতা বিবেচনা না করে ঢাকঢোল পিটিয়ে হঠাৎ করে অনলাইনে ভর্তির ঘটনায় দেশজুড়ে অসন্তোষ বাড়ছে। সর্বশেষ শনিবার দুপুর ১টায় টানা তিনদিন দফায় দফায় তারিখ পিছিয়েও সমস্যার জট খুলতে না পেরে কলেজে ভর্তির জন্য মনোনীতদের প্রথম মেধা তালিকা প্রকাশ করতে আবার সময় নেয়া হয়েছে। সে অনুসারে আজ আবার লাখ লাখ শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও কলেজের শিক্ষক-কর্মকর্তারা অপেক্ষা করবেন ফলের জন্য। আজ সকাল নাগাদ এই তালিকা ওয়েবসাইটে পাওয়া যাবে বলে শনিবার দুপুরে জানিয়েছেন ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু বকর সিদ্দিক ও কলেজ পরিদর্শক আসফাকুস সালেহীন। িি.িীরপষধংংধফসরংংরড়হ.মড়া.নফ এই ওয়েবসাইটে বহু প্রত্যাশিত এই ফল পাওয়া যাবে বলে আশা তাদের। চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু বকর সিদ্দিকী বলছিলেন, একটু ত্রুটি হচ্ছে। এখন বুয়েটে বিষয়টি দেখছেন শিক্ষা সচিব স্যার। বিশেষজ্ঞরাও আছেন। জানা গেছে, অধিক আবেদনকারী এবং কারিগরি জটিলতার কারণে বার বার পিছিয়ে যাচ্ছে ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে একাদশ শ্রেণীতে মনোনীত শিক্ষার্থীদের ফল প্রকাশ। এতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন সাড়ে এগারো লাখ আবেদনকারী ও তাদের অভিভাবকরা। কারিগরি ত্রুটির কথা স্বীকার করে শনিবার শিক্ষা সচিব নজরুল ইসলাম খান সাংবাদিকদের বলেছেন, অধিক আবেদনকারীর কারণে কিছুটা জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। ফল প্রকাশের জন্য তারা দিন-রাত যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন। দ্রুতই ফল দিতে পারবেন বলে আশ্বাস দেন তিনি। এর একদিন আগেও তিনি অবশ্য সকলকে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তার পর সময় চলে গেছে প্রায় দুইদিন। এর মধ্যে তারিখও দেয়া হয়েছে দুইবার। বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১১টায় ওই ফল প্রকাশের কথা ছিল। অনেকে রাত জেগে চেষ্টা চালিয়েও ফল পাননি। মধ্যরাতে বোর্ডের পক্ষ থেকে বলা হয় সকাল আটটায় ফল প্রকাশ করা হবে। শুক্রবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে ঢাকা বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক সালেহীন বলেছিলেন, শনিবার সকাল ৮টায় ওয়েবসাইটে ফল প্রকাশিত হবে। কিন্তু তাও ব্যর্থ হয় মন্ত্রণালয়, বোর্ড ও বুয়েটের কর্মকর্তারা। শনিবার সকালে চেয়ারম্যান বলেন, বুয়েটে কাজ চলছে। সচিব স্যার সেখানে আছেন। সমস্যা সমাধানে কায়কোবাদ (বুয়েটের কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোঃ কায়কোবাদ) স্যারকে ডাকা হয়েছিল। তিনি বলেছেন, প্রোগ্রামটি রান করছে না। তবে এটা বড় সমস্যা নয় জানিয়ে আজ (শনিবার) নাগাদ সমাধান করা যাবে। আমরা আশা করছি আজ ফল দেয়া যাবে। কিন্তু একটার দিকেই জানা গেল, ফলাফল জিরো। সকাল থেকে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা ওয়েবসাইটে ফল পাননি। বরং আগের মতোই ওয়েবসাইটে নোটিস ঝুলছিল- ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তিচ্ছুক শিক্ষার্থী ও সংশ্লিষ্টদের জানানো যাচ্ছে যে, ভর্তির ফল প্রক্রিয়াকরণের কাজ চলছে, প্রকাশের সময় আগামীকাল রবিবার।’ ভর্তি ও ফল প্রকাশের এই কাজে বুয়েট কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে। সেখানেই জট বেঁধেছে বলে বোর্ড কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। ওয়েবসাইট হ্যাকড হওয়ায় ফল প্রকাশ বিলম্বিত হয়েছে বলে কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমে খবর এলেও বোর্ড কর্মকর্তারা তা নাকচ করেন। এদিকে গতকাল শনিবার ছিল ভর্তির নির্ধারিত সময়। তবে ভর্তি তো পরের কথা ফলই প্রকাশ করতে ব্যর্থ হয়েছে মন্ত্রণালয় ও বোর্ড। ফলে ভর্তির সময় বাড়ানো ছাড়া আর কোন উপায় নেই। কিন্তু সেখানেও কি হবে তার জবাব জানতে পারছে না সারাদেশের শিক্ষার্থীরা। খোদ বুয়েটের অনেক কর্মকর্তাই বলছেন, মন্ত্রণালয় ও বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অজ্ঞতার কারণে আজ দেশজুড়ে বিশাল এ কাজটি সঙ্কটের মুখে পড়েছে। এখানে লাখ শিক্ষার্থীর ডাটা নিয়ে কাজ করতে হবে। এটা আদৌ এভাবে হুট করে হয় না তা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন কর্মকর্তারা। ফলাফল হচ্ছে তিনদিন ধরে দিন-রাত জেগেও শিক্ষার্থীরা তালিকা পাচ্ছে না। এদিকে বোর্ড ও মন্ত্রণালয়ের অনেক কর্মকর্তা বলছেন, এক সঙ্গে সারাদেশের প্রতিষ্ঠানকে অনলাইনের আওতায় আনার সিদ্ধান্ত ছিল ভুল। শহরাঞ্চলের প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রথমবার অনলাইনের আওতায় এনে দেখা উচিত ছিল। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ স্বল্প সংখ্যক প্রতিষ্ঠানকে প্রথমবার অনলাইনের আওতায় আনার নির্দেশ দিলেও পরে সে অবস্থান পাল্টে যায়। কিন্তু সেটা কিভাবে হলো তা নিয়ে এখন উঠেছে নানা প্রশ্ন। ঢাকঢোল পিটিয়েই এবার প্রথমবার একাদশ শ্রেণীতে অনলাইন ভর্তির পদ্ধতি শুরু করা হয়। আর এই পদ্ধতি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে শুরু থেকেই পদে পদে হোঁচট খেল শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বোর্ড। ভর্তির আবেদন থেকে শুরু করে বাছাই প্রক্রিয়া, টেলিটকে টাকা পাঠানো, শিক্ষার্থীর আবেদন অন্য আরেক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান করে ফেলা, সর্বশেষ ফল প্রকাশে বিলম্বসহ সব স্তরেই চলছে তুঘলকি কর্মকা-। এদিকে কেলেঙ্কারির এখানেই শেষ নয়। ভর্তির সময় যে ট্রান্সক্রিপ্ট বা নম্বরপত্র দরকার হবে এসএসসি পাস করা শিক্ষার্থীদের। তাও হাতে পাচ্ছে না তারা। জানা গেছে, গত তিনদিন আগে এসএসসি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের একাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্ট বিতরণ করার কথা থাকলেও ট্রান্সক্রিপ্টে অসংখ্য ভুল ধরা পড়ে। এজন্য ট্রান্সক্রিপ্ট বিতরণ স্থগিত করেছে শিক্ষা বোর্ড। ট্রান্সক্রিপ্ট বিতরণ স্থগিতের বিষয়ে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের একজন উর্ধতন কর্মকর্তা বলেন, ট্রান্সক্রিপ্টে অনেক ভুল লেখা হয়ে গেছে। ফলে বিতরণ বন্ধ করা হয়েছে। যারা নিয়েছে তাদের ট্রান্সক্রিপ্টও ফেরত দিতে বলা হয়েছে। লাখ লাখ নম্বরপত্রে ভুলের জন্য বোর্ডকে কয়েক কোটি টাকা গচ্ছা দিতে হয়েছে। এই ঘটনার জন্য ইতোমধ্যেই কম্পিউটার শাখার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাসহ কয়েকজনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। ইতোমধ্যেই সরকারের ভারমূর্তি নষ্ট করার জন্য অসাধু কর্মকর্তাদের বিচারের দাবি তুলেছেন শিক্ষক-কর্মকর্তারা। এ মুহূর্তে পুরো ঘটনা নিয়ে ক্ষোভ বাড়ছে শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের। স্বনামধন্য কলেজগুলোর অধ্যক্ষরাই বলছেন, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা না করে তড়িগড়ি করে অনলাইন ও এসএমএসে ভর্তি কার্যক্রম শুরু করা মোটেও উচিত হয়নি, যার খেসারত এখন দিচ্ছে শিক্ষার্থীরা। কলেজগুলোকেও এখন ভর্তি কার্যক্রম নিয়ে নানা ভোগান্তির শিকার হতে হবে। কারণ শিক্ষা বোর্ড বলছে, অনলাইনে আবেদন না করলে ভর্তি বৈধ হবে না। কিন্তু দেশে অনেক কলেজ আছে, যেখানে বিদ্যুত নেই, নেই ইন্টারনেট সংযোগ। তাহলে সেসব কলেজ কী শিক্ষার্থী ভর্তি করাবে না? ভর্তির হয়রানি নিয়ে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও। তানভীর তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, এটি এর আগে টেলিটক একাই সুন্দর ও সফলভাবে সম্পন্ন করতে পেরেছে। বুয়েটকে এর মধ্যে জড়িয়ে ব্যবসায়িক তালগোল পাকিয়েছে। কি জন্য বুয়েটের দরকার ছিল? ভিকারুন নিসায় ভর্তির জন্য আবেদন করেছিল রুকসানা। তিনি বলছিলেন, আমরা দুই রাত ঘুমায়ইনি। এটা কি মগের মুল্লুক নাকি? ক্ষোভ প্রকাশ করে তার মা হাসনাহেনা বলছিলেন, নিজেদের ক্ষমতা ও আওতা সম্পর্কে সকলের ধারণা থাকা অবশ্যক। পর পর দুই তিন রাত চরম উৎকণ্ঠায় ভুগছে ছাত্রছাত্রীরা। কিন্তু কেন? তারা না পারলে কেন এত তাড়াহুড়া করে এইবার এই সিস্টেম চালু করতে গেল? এখন আগামীকাল ফলাফল দেয়ার একটা সম্ভাবনার কথা শোনা যাচ্ছে। তাও নিশ্চিত নয়!! ঢাকা কলেজে ভর্তির জন্য আবেদন করেছে রুবেল। তিনি লিখেছেন, বুয়েটের এটা নতুন কিছু না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির কাজ করে এই প্রতিষ্ঠানটি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থীদের একইভাবে হয়রানি করে। বিষয়টি আমরা জানি। কিন্তু জানেন না শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষা সচিব ও বোর্ডের কর্মকর্তারা। তাদের দায়িত্ব ছেড়ে দেয়া উচিত।
×