ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

নিঃশব্দতায় সুমনের ‘কোলাজ কাব্য’

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ২৭ জুন ২০১৫

নিঃশব্দতায় সুমনের ‘কোলাজ কাব্য’

গৌতম পাণ্ডে ॥ জল রঙের ছোঁয়ায় শিল্পের বহুত্বকে চিত্রায়ন দুঃসাধ্য। এ দুঃসাধ্যকে সাধন করেছেন শিল্পী সুমন বৈদ্য। যার চিত্রকলায় প্রতীয়মান আজকের বাস্তবতা। প্রাচ্যকলায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থাকলেও প্রদর্শনীর কাজগুলোতে প্রথাগতভাবে প্রাচ্য ঘরানার ধরন তেমন নেই। জল, তৈল ও রঙের ব্যবহারে শাশ্বত পন্থায় সৃষ্টিশীল মাধ্যমকে আশ্রয় করে মৌলিকত্ব কল্পনা, জীবনবোধ প্রতীয়মান প্রতিটি চিত্রকর্মে। বিজ্ঞান মনস্কতার পরিচয়ও মেলে কোন কোন চিত্রকর্মে। শিল্পের ভাষায় চিত্রকলা হচ্ছে নিঃশব্দ কবিতা। যে কবিতা প্রকৃতির কথা ও মানুষের ভাবাবেগের কথা বলে। এ প্রজন্মের তরুণ এ শিল্পীর চিত্রকর্ম তারই প্রতিধ্বনি। তাই বুঝি শিল্পীর প্রথম একক এ প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘কোলাজ কাব্য’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের জয়নুল গ্যালারি-১এ গত বুধবার শুরু হয়েছে সপ্তাহব্যাপী এ প্রদর্শনী। শিল্পীর সৃষ্টিকর্মে যখন সাধারণ দর্শকের মেলবন্ধন তৈরি হয়, তখনই হয়ত শিল্পের সার্থকতা আসে। হয়ত সে কারণেই নিজের কাজ নিয়ে সুমন বললেন, আমার মনে হলো, শুধু সৈন্দর্য বোধ প্রকাশের জন্য শিল্পী শিল্প সৃষ্টি করেন না। এর বাইরে সামাজিক অনাচার, ক্ষয়, দুর্যোগ, দুর্ভোগ যেটা আমাদের ভাবায় সেগুলো নিয়েও কিছু কাজ করার আছে। সুমনের চিত্রকর্মে এসবের প্রভাব আছে এটা বলার অবকাশ নেই। একজন দেশপ্রেমিক হয়ে অন্যকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করানোর যে প্রয়াস তার নিদর্শন পাওয়া যায় তার ‘বঙ্গবন্ধু’ শিরোনামের চিত্রকর্মে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন আঙ্গিকের ৬টি ছবি দিয়ে তিনি তা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। সুন্দরের মধ্যে যে ভয়ঙ্কর রূপ থাকতে পারে তারই উপমা হিসেবে তিনি এঁকেছেন ‘সাবলাইম’। এখানে তিনি চাঁদ, নারী ও কাককে নিয়ে এসেছেন অভিনব পন্থায়। চাঁদে কলঙ্ক আছে তবু লোকে দেখে চাঁদ, অধরা হলেও নারীর সৈন্দর্য সবসময় প্রতীয়মান। ‘লাভ অব হ্যাবেন’ শিরোনামের চিত্রটিতেও তিনি একই ইঙ্গিত করেছেন। এখানে ফুটে উঠেছে স্বামী-স্ত্রী ও প্রেমিক-প্রেমিকার ভালবাসার মুহূর্ত। সুন্দরের এ মুহূর্তের মধ্যে অসুন্দরের ছায়া যে থাকতে পারে, শিল্পীর ছবিতে সেটাই ইঙ্গিত করে। প্রাচ্য চিত্রকলায় প্রাচ্য সমাজের ধর্ম, রাজনীতি, দর্শন, সংস্কৃতির নান্দনিক ও শৈল্পিক উপস্থাপনা মন ও মস্তিষ্ককে পুলকিত করে। সুমনের চিত্রকর্মে জীবনধর্ম, মানবতা ও চিন্তাশক্তির উপস্থাপনা সহজেই দৃষ্টিগোচর হয়। ‘আই ওয়ান্ট পিচ’ নামের চিত্রে তারই প্রতিফলন ঘটেছে। অস্থির পৃথিবীতে একটু শান্তি চাই এ প্রত্যাশায় সবাই। ছবিতে মানুষের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে সাদা পায়রা। কিন্তু আকাক্সক্ষা থাকলেও সে তাদের মতো মুক্ত আকাশে, স্বাধীনভাবে উড়ে যেতে পারছে না। এমনকি চারদিকে নানাবিধ পলিউশনে কান বন্ধ করে থাকা শিশুর আস্ফালন প্রমাণ করে আমি নিরুপায়। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মকে ক্ষতবিক্ষত করছে মানুষ। প্রকৃতি যেন তারই প্রতিশোধ নিতে ব্যস্ত। অক্সিজেন নেই, কার্বনডাইঅক্সাইড ও অন্যান্য বিষাক্ততায় মানুষই নিজেরই ক্ষতি ডেকে আনছে। ‘ব্যাড ড্রিম’ নামের চিত্রকর্মে শিল্পী তারই প্রতিচ্ছবি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। শিল্পী যে আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাসী তার প্রমাণ মেলে ‘পাখি কখন জানি উড়ে যাবে’ শিরোনামের ছবিতে। লালন ভক্ত শিল্পীর চিন্তা-চেতনায় জাগতিক এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে কখন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হবে, কেউ তা জানে না। প্রাচ্য সমাজের ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে শান্তির প্রতীক হিসেবে এঁকেছেন গৌতম বুদ্ধের ছবি ও সেবিকা সুজাতাকে। শিল্পী রবীন্দ্রনাথের গানের চরণ ‘আজি ঝরঝর মুখর বাদর দিনে’ শিরোনামের চিত্রকর্মে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন বৃষ্টিস্নাত বাংলাদেশকে। সমসাময়িক সামাজিক অন্যায়কে প্রশ্রয় না দেয়ার জন্য শিল্পী আহ্বান করেছেন সচেতনদের। যার জন্য এঁকেছেন ‘ইভটিজিং’ নামের চিত্র। ‘আনচেঞ্জেব্ল বন্ড’ শিরোনামের চিত্রে উঠে এসেছে বাস্তবতার ছাপ। শিশু থেকে যৌবন, তারপর পৌঢ়ত্ব ঘিরে একজন রিকশাওয়ালার জীবন যেন নির্মম কাব্য হয়ে দেখা দিয়েছে চিত্রকলায়। সব মিলিয়ে সুমনের চিত্রকর্মের বিষয় বৈচিত্র্য বেশ সম্প্রসারিত। এখানে মানুষকে প্রধান্য দেয়া হয়েছে বেশি। মানুষের আশা-নিরাশা, দুঃখ-কষ্টের প্রকাশ যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে পারিপার্শ্বিক ও সামাজিক অচলায়তন থেকে মুক্তি ও শান্তির প্রত্যাশা। প্রদর্শনীতে মোট ছবির সংখ্যা ২৪টি। আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত প্রতিদিন বেলা ১১ টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য প্রদর্শনী খোলা থাকবে।
×