ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অচলাবস্থায় ঢাকা মহানগর বিএনপি

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ২৭ জুন ২০১৫

অচলাবস্থায় ঢাকা মহানগর বিএনপি

শরীফুল ইসলাম ॥ বিএনপির রাজনীতিতে এক সময়ের প্রাণশক্তি ঢাকা মহানগর বিএনপি এখন অচল হয়ে পড়েছে। দীর্ঘদিন ধরে মহানগর বিএনপির কোন কার্যক্রম লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। একদিকে আহ্বায়ক মির্জা আব্বাস ও সদস্য সচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেলের মধ্যে দ্বন্দ্ব এবং অপরদিকে সহিংস আন্দোলন করতে গিয়ে নেতাকর্মীরা মামলায় জড়িয়ে পড়ায় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু ঢাকা মহানগরে বিএনপির এখন বেহাল দশা। সাংগঠনিক কার্যক্রমে অংশ নেয়া দূরে থাক দলীয় কার্যালয়েও কেউ যায় না। এ কারণে ২ বছরেও থানা ও ওয়ার্ড কমিটিগুলো গঠন করতে পারছে না ঢাকা মহানগর বিএনপি। এক যুগ ধরে দায়িত্ব পালন করা সাদেক হোসেন খোকাকে মাইনাস করে মির্জা আব্বাসকে আহ্বায়ক ও হাবিব-উন-নবী খান সোহেলকে সদস্য সচিব করে নতুন কমিটি গঠনের পর বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া মনে করেছিলেন রাজধানীতে দলীয় কর্মকা- চাঙ্গা হবে। কিন্তু এ কমিটি নিয়ে দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার আশার গুঁড়ে বালি পড়েছে। তিনি এখন ঢাকা মহানগর বিএনপির কার্যক্রম নিয়ে হতাশ। তবে আন্দোলন ব্যর্থ ও বিভিন্ন মামলায় জড়িয়ে নিজেই বেকায়দায় থাকায় তিনি এখন এ বিষয়ে কাউকেই কিছু বলছেন না। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর রাজধানীতে দলীয় কর্মকা- চাঙ্গা করতে ২০১৪ সালের ১৮ জুলাই বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মেয়র মির্জা আব্বাস এবং স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি ও ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি হাবিব-উন-নবী খান সোহেলের নেতৃত্বাধীন ৫৩ সদস্যের ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি গঠন করেন। এ কমিটিকে তিনি এক মাসের মধ্যে প্রতিটি থানা ও ওয়ার্ড কমিটি গঠনের সময়সীমা বেঁধে দেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত ১ বছরেও অধিকাংশ ইউনিট কমিটিই গঠন করতে পারেনি তারা। আর এসব ইউনিট কমিটি না থাকায় ৬ জানুয়ারি থেকে টানা ৯২দিন অবরোধ ও দফায় দফায় হরতাল কর্মসূচী চলাকালে ঢাকা মহানগরীতে বিএনপির কোন নেতাকর্মীকে মাঠে নামতে দেখা যায়নি। প্রসঙ্গত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আন্দোলন ব্যর্থতার অভিযোগ উত্থাপিত হওয়ায় সাদেক হোসেন খোকা ও আবদুস সালামের নেতৃত্বাধীন কমিটি ভেঙ্গে দিয়ে মির্জা আব্বাস ও হাবিব-উন-নবী খান সোহেলের নেতৃত্বে ঢাকা মহানগর বিএনপির নতুন আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে দেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। কিন্তু এভাবে নতুন কমিটি করায় আগের কমিটির আহ্বায়ক সাদেক হোসেন খোকা ও সদস্য সচিব আবদুস সালামের অনুসারীদের মধ্যে চরম অসন্তোষ ও ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। তবে সাদেক হোসেন খোকা বিদেশে চিকিৎসাধীন থাকায় তারা প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ না করলেও চুপে চুপে নিজেদের মধ্যে এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে থাকে। অপরদিকে মির্জা আব্বাস ও হাবিব-উন-নবী খান সোহেলের দ্বন্দ্বের কারণে এক পর্যায়ে খোকা-সালাম বিরোধী ঢাকা মহানগর বিএনপির নেতাকর্মীরাও দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। আর এসব কারণেই ঢাকা মহানগর বিএনপি কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়ে। যার প্রমাণ পাওয়া যায় মির্জা আব্বাস মেয়র প্রার্থী হওয়ার পর প্রচার কার্যক্রমে তার স্ত্রী আফরোজা আব্বাস ছাড়া উল্লেখ করার মতো কোন নেতা মাঠে না নামায়। এক পর্যায়ে খালেদা জিয়া নিজে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে ভোট প্রার্থনা করতে মাঠে নামলেও তার সঙ্গে মাঠে নামেননি ঢাকা মহানগর বিএনপির নেতারা। ৪ বছর আগে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া সাদেক হোসেন খোকাকে আহ্বায়ক ও আবদুস সালামকে সদস্য সচিব করে ২১ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করার পর থেকেই দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস তার অনুসারীদের নিয়ে এ কমিটির বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে সাংগঠনিক কার্যক্রমে নানাভাবে বাধা সৃষ্টি করেন। মির্জা আব্বাসদের অসহযোগিতার কারণেই খোকার নেতৃত্বাধীন কমিটি সংশ্লিষ্ট থানা ও ওয়ার্ড কমিটিগুলো পুনর্গঠন করে মহানগরীর পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করতে পারেননি। যেখানেই থানা বা ওয়ার্ডের কাউন্সিল করার চেষ্টা চালানো হয়েছে সেখানেই গ্রুপিং-কোন্দল সৃষ্টি করে অচলাবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়েছে। এমনকি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আন্দোলন কর্মসূচী পালনকালেও মির্জা আব্বাস ও তার অনুসারীরা মাঠে নামেননি। আবার তারাই নির্বাচনের পর আন্দোলনে ব্যর্থতার দায় খোকা-সালাম নেতৃত্বাধীন কমিটির ওপর চাপিয়েছেন। তাদের অভিযোগের কারণেই বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া গত বছর ১৮ জুলাই ঢাকা মহানগর বিএনপির নতুন আহ্বায়ক কমিটি গঠন করেন। টানা অবরোধ ও দফায় দফায় হরতাল কর্মসূচী পালনকালে ঢাকা মহানগর বিএনপির কোন নেতাকর্মী রাজপথে নামেননি। আহ্বায়ক মির্জা আব্বাস ও হাবিব-উন-নবী খান সোহেলসহ অধিকাংশ নেতাই ছিলেন পলাতক। রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র রাজধানীতে বিএনপি নেতাকর্মীরা সক্রিয় না থাকায় বিএনপির আন্দোলন কর্মসূচী ব্যর্থ হয়। শুধু তাই নয় এখনও দলীয় কোন কর্মসূচীতে মহানগর বিএনপির নেতাদের দেখা যায় না। উল্লেখ্য, ২০১১ সালের ১৪ মে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া দলের ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকাকে আহ্বায়ক ও অর্থনৈতিক বিষয়ক সম্পাদক আবদুস সালামকে সদস্য সচিব করে ২১ সদস্যের ঢাকা মহানগর আহ্বায়ক কমিটি গঠন করেন। এ কমিটিতে ১৯ জন যুগ্ম আহ্বায়কের মধ্যে মাত্র ৪ জন ছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের অনুসারী। আর বাকি সবাই ছিলেন সাদেক হোসেন খোকার পছন্দের লোক। আব্বাস অনুসারী ৪ জন যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন, কেন্দ্রীয় কমিটির সমবায় বিষয়ক সম্পাদক সালাউদ্দিন আহমেদ, প্রয়াত সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টু, সবুজবাগ থানা বিএনপির সভাপতি সামসুল হুদা ও মতিঝিল থানা বিএনপির সভাপতি সাজ্জাদ জহির। আর খোকার অনুসারী যুগ্ম আহ্বায়করা ছিলেন, সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর কাজী আবুল বাশার, এমএ কাইয়ুম, আবদুল লতিফ, এমএ মজিদ, শাহাবুদ্দিন আহমেদ, আলী আজগর মাতব্বর, নূরজাহান মাহবুব, মোঃ আতিক উল্লাহ, মোঃ আজিজ উল্লাহ, আনোয়ারুজ্জামান, আবদুল আলীম নকি, বজলুল বাছিত আঞ্জু, মোহাম্মদ মোহন সাবেক সংসদ সদস্য এসএ খালেক ও আবু সাঈদ খান খোকন। ২০১৪ সালের ১৮ জুলাই স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে আহ্বায়ক ও স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি হাবিব-উন-নবী খান সোহেলকে সদস্য সচিব করে ঘোষিত ঢাকা মহানগর বিএনপির ৫৩ সদস্যের কমিটিতে যারা স্থান পেয়েছেন তার মধ্যে মির্জা আব্বাস অনুসারীদের পাল্লা ভারি হলেও কমিটির বাইরে থাকা নেতাকর্মীদের অসহযোগিতার কারণে সুবিধা করতে পারছেন না তিনি। কমিটিতে থাকা ৬ যুগ্ম-আহ্বায়কের মধ্যে রয়েছেন চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা আবদুল আউয়াল মিন্টু, দলের সমবায় বিষয়ক সম্পাদক সালাহউদ্দিন আহম্মেদ, নির্বাহী কমিটির সদস্য কাজী আবুল বাশার, এমএ কাইয়ুম ও আবুল সাইদ খান খোকন। আর আরেক যুগ্ম আহ্বায়ক নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টু মারা গেছেন। ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটিতে সদস্যেদের মধ্যে রয়েছেন গয়েশ্বর চন্দ্র রায় (বর্তমানে কারাগারে), আমান উল্লাহ আমান (বিদেশে পলাতক), এসএ খালেক, আবুল খায়ের ভূঁইয়া, মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, বরকত উল্লাহ বুলু, ও ব্যারিস্টার নাসির উদ্দিন অসীম, শাহাবুদ্দীন আহম্মেদ ও আবদুল লতিফ (কলাবাগান), আবদুল মজিদ (রমনা), আনোয়ারুজ্জামান আনোয়ার (তেজগাঁও), শামছুল হুদা (সবুজবাগ), সাজ্জাদ জহির (শাহজাহানপুর), একরামুল হোসেন (শাহজাহানপুর), ইউনুস মৃধা (খিলগাঁও), বজলুল বাসিত আনজু (মিরপুর), সাদেক আহম্মেদ (মুক্তিযোদ্ধা), আলী আজগর মাতবর (কাফরুল), নিতাই চন্দ্র ঘোষ (সূত্রাপুর), আহসান উল্লাহ হাসান (পল্লবী), বোরহানুজ্জামান ওমর (পল্টন), হারুন অর রশিদ হারুন (মতিঝিল), সিরাজুল ইসলাম সিরাজ (কলাবাগান), গোলাম হোসেন (সবুজবাগ), তানভীর আদেল বাবু (পল্টন), আবুল হাসান তালুকদার ননী (শাহবাগ), আবু মোতালিব (চকবাজার), আলী ইমাম আসাদ (পল্লবী), আবদুল মহিন (মোহাম্মদপুর), আবদুস সামাদ (কোতোয়ালি), হাজী আলতাফ হোসেন (লালবাগ), ফরিদ আহম্মেদ ফরিদ (দয়াগঞ্জ), আনোয়ার পারভেজ বাদল (চকবাজার), আক্তার হোসেন (খিলক্ষেত), নবী উল্লাহ নবী (যাত্রাবাড়ী), হাজী মীর হোসেন মীরু, ফখরুল ইসলাম (রামপুরা), ফেরদৌস আহম্মদ মিষ্টি (শাহ আলী), তানভীর আহমেদ রবিন (কদমতলী), ধশেখ রবিউল আলম (ধানম-ি), কফিল (উত্তরা), আরিফুর রহমান নাদিম (আরমানিটোলা), জাফরুল (বংশাল) ও এসএম জিলানী। এদের কাউকেই এখন ঢাকা মহানগর বিএনপির কার্যক্রমে দেখা যায় না। এমনকি জরুরী কোন প্রয়োজন না হলে তারা দলীয় কার্যালয়েও যায় না। এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান বলেন, নানামুখী সমস্যায় থাকার কারণে ঢাকা মহানগর বিএনপি এখন আগের মতো সক্রিয় হতে পারছে না। বিশেষ করে অধিকাংশ নেতার নামে মামলা রয়েছে। মামলার কারণে কেউ কারাগারে, কেউ পলাতক ও কেউ ঝামেলা এড়াতে দলীয় কর্মকা- থেকে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছেন।
×