ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

এক বছরে মরেছে ২৬ প্রাণী, আনা হয়নি একটিও, মৃত্যুঝুঁকিতে ধুঁকছে আরও ৩৩;###;পশুপাখির খাবারের টাকা যাচ্ছে কর্তৃপক্ষের পেটে!

অনিয়ম অব্যবস্থা স্বেচ্ছাচারিতায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ॥ বেহাল চিড়িয়াখানা

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ২৭ জুন ২০১৫

অনিয়ম অব্যবস্থা স্বেচ্ছাচারিতায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ॥ বেহাল চিড়িয়াখানা

আরাফাত মুন্না ॥ অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, স্বেচ্ছাচারিতা আর হয়রানিতে ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে দাঁড়িয়েছে জাতীয় চিড়িয়াখানা। একের পর এক প্রাণী মারা যাচ্ছে, কিন্তু আনা হচ্ছে না নতুন একটিও। আবর্জনা আর দুর্গন্ধে দর্শনার্থীদের দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম। অন্যদিকে, চিড়িয়াখানার পশুখাদ্য ক্রয়সহ নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। এছাড়া চিড়িয়াখানার ভেতরে দর্শনার্থীদের নানাভাবে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে হয়রানি করছে সংঘবদ্ধ চক্র। খোদ চিরিয়াখানার কিউরেটরই স্বীকার করছেন এমন অভিযোগ। দেশের এই ঐতিহ্যবাহী চিড়িয়াখানা রক্ষায় দ্রুত পদক্ষেপ নিতে সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছেন দর্শনার্থীরা। একদিকে জমছে অভিযোগের পাহাড়, অন্যদিকে চিড়িয়াখানা তদারকিতে যারা আছেন তারা নির্বিকার। কোন এক অদৃশ্য দাপটে বিচার হয় না কোন অভিযোগেরই। স্থানীয় সংসদ সদস্যরা পরপর কয়েকবার দুর্নীতি তদন্তে নামলেও শেষ পর্যন্ত মন্ত্রণালয়ে গিয়ে তা আটকে গেছে। এখানে নেই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ জনবল। সঠিক সেবাযতেœর অভাবে অনেক প্রাণীকে অকালে প্রাণ হারাতে হচ্ছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়াজার (ওয়ার্ল্ড এ্যাসোসিয়েশন অব জু এ্যান্ড এ্যাকুরিয়ামস) সদস্য না হওয়ায় বিদেশ থেকে প্রাণী আনতেও নানা সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষকে। গত এক বছরে বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানায় মারা গেছে ২৬ প্রাণী। অথচ এই সময়ে নতুন করে আনা হয়নি একটিও। আরও ৩৩ প্রাণীর আয়ুষ্কাল অতিক্রান্ত হওয়ায় রয়েছে মৃত্যুঝুঁকিতে। এর মধ্যে অনেক প্রাণীই বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছে, হারিয়েছে চলাচলের সক্ষমতা। এই দুর্বল প্রাণীগুলোকেই খাঁচায় রাখা হয়েছে প্রদর্শনীর জন্য, যা দেখে দর্শনার্থীরাও এক প্রকার বিরক্তই হচ্ছেন। প্রতিবছর প্রাণী মারা যাওয়ার বিপরীতে আনা না হলে চিরিয়াখানায় চিরিয়াই থাকবে না। এদিকে, চিড়িয়াখানায় পশু-পাখি দেখশুনার জন্য রয়েছে লোকবল সংকট। যারা আছেন তারাও ব্যস্ত চিড়িয়াখানাকেন্দ্রিক নিজেদের ব্যবসা নিয়ে। কেউ বিক্রি করেন ময়ূরের পালক আবার কেউ বিক্রি করেন বাদাম। এসব বিষয়ে খেয়াল নেই কর্তৃপক্ষের। চিড়িয়াখানা এ্যাক্ট না থাকা, অবকাঠামো ও ব্যবস্থাপনায় ঘাটতির জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়াজার (ওয়ার্ল্ড এ্যাসোসিয়েশন অব জু এ্যান্ড এ্যাকুরিয়ামস) সদস্য হতে পারেনি বাংলাদেশ। এ কারণে আন্তর্জাতিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত জাতীয় চিরিয়াখানা। ভারতসহ পার্শ্ববর্তী দেশগুলো এই সংস্থার সদস্য। আন্তর্জাতিক এই সংস্থার অভিযোগ, ঢাকা চিড়িয়াখানার অবকাঠামো, খাঁচার বিন্যাস ও পরিবেশসহ কোনকিছুই মান উপযোগী নয়। এছাড়া এ সংস্থার সদস্য হতে সবচেয়ে জরুরী চিড়িয়াখানা এ্যাক্ট, সেটি নেই বাংলাদেশে। এ কারণে জাতীয় চিড়িয়াখানাকে সদস্য করেনি সংস্থাটি। আর সংস্থার সদস্য না হওয়ায় বৈধপথে পশু-পাখি আনতেও নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এছাড়া ওয়াজা প্রশিক্ষণ দিচ্ছে না জাতীয় চিড়িয়াখানার কোন কর্মকর্তাকে। এর ফলে জাতীয় চিড়িয়াখানার পশু-পাখি সঠিকভাবে দেখভালও করা যাচ্ছে না। চিড়িয়াখানা সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবছর ৩০ থেকে ৩৫ লাখ দর্শনার্থী আসেন চিড়িয়াখানায়। কিন্তু তাদের জন্য নেই উপযুক্ত পরিবেশ। গত সোমবার (২২ জুন ২০১৫) সরেজমিনে মিরপুরে জাতীয় চিড়িয়াখানায় গিয়ে দেখা যায়, দুপুর বারোটায় কানাবকের জন্য নির্ধারিত জায়গায় সামান্য পানি থাকলেও নেই তেমন খাবার। একটা ছোট লাল ঝুড়িতে কিছু একটা থাকলেও সেদিকে খেয়াল নেই কারও। ওই খাঁচায় থাকা সব বকই ঠোঁক দিচ্ছে শ্যাওলাতে। বানরের খাঁচায় পাউরুটি, আম, বাদাম, ফালি করা মালটা, কলা ছড়িয়ে ছিটিয়ে মেঝেতে ফেলে রাখা হয়েছে। সেগুলোকে ঘিরে উড়ছে অগণিত মাছি। একটি খাঁচায় দুই সিংহ নিস্তেজ পড়ে আছে। তাদের সামনে দুটি বড় হাড়। এক কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বাঘ ও সিংহকে হাড়ওয়ালা মাংস দিলে তারা খেতে চায় না জেনেও এদের হাড়ই দেয়া হয়। ইচ্ছে হলে হাড় থেকে মাংস ছাড়িয়ে খায়, আবার না খেয়েও থাকে। অন্য আরেকটি খাঁচায় থাকা দুই বাঘের মধ্যে একটি নিস্তেজ হয়ে ঘুমাচ্ছে আর অন্যটি দর্শনার্থীদের বিনোদন দেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। ওই খাঁচায়ও রয়েছে বড় দুটি হাড়। আর বেশিরভাগ খাঁচার সামনেই বেশি সময় দাঁড়ানো যাচ্ছিল না দুর্গন্ধে। অনেক খাঁচা খালি। সরেজমিনে আরও দেখা গেছে, জাতীয় চিড়িয়াখানার বিভিন্ন স্থানে রয়েছে অসংখ্য অবৈধ দোকান। পাবলিক টয়লেটের ইজারাদারও টয়লেটের সামনে অবৈধ দোকান বসিয়েছেন। এসব দোকানে প্রতিটি পণ্যেই নেয়া হচ্ছে চড়া মূল্য। গত সোমবার ১৫ টাকার মিনারেল ওয়াটার ৩০টাকায় বিক্রি করতে দেখা গেছে। অভিযোগ রয়েছে, এসব দোকানির একটি সংঘবদ্ধ চক্রের যোগসাজশে দর্শনার্থীদের নানা হয়রানির অভিযোগ রয়েছে। এ চক্রটি দর্শনার্থীদের সামনে ৩০ থেকে ৪০ টাকা দামের একটি কোমল পানীয়র ক্যান খুলে দিয়ে আদায় করছে ১শ‘ থেকে ৫শ’ টাকা। এসব কারণে অনেক সময় চিড়িয়াখানায় নানা অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটে। দুর্নীতি তদন্তে কমিটি ॥ গত বছর ঢাকা চিড়িয়াখানার দুর্নীতি খতিয়ে দেখতে সংসদীয় উপ-কমিটি গঠন করা হয়। এর আগেও ২০১০ সালে একই কমিটি গঠন করা হলেও কাজ হয়নি। মন্ত্রণালয় এবং চিড়িয়াখানার প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের কারণে সফল হয়নি সংসদীয় উপ-কমিটি। এবছরও কমিটি গঠন করা হলেও তদন্তে নেই দৃশ্যমান অগ্রগতি। তদন্ত প্রতিবেদনে ত্রুটিপূর্ণভাবে পশুখাদ্য সরবরাহ, মানসম্মত নয় এমন খাদ্য সরবরাহ, চিড়িয়াখানার যেসব কর্মকর্তা প্রেষণে অন্য দফতরে কর্মরত তাদের নিজ দফতরে ফেরত পাঠানো এবং চিড়িয়াখানার নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার বিষয়ে মন্ত্রণালয়কে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়। চিড়িয়াখানাকে দৃষ্টিনন্দন করতে সামনের দোকানগুলোর ইজারা বাতিল এবং কর্মরত কর্মচারীদের সরকারী পোশাক পরিধানসহ কর্মস্থলে আগমন ও প্রস্থানের বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য মন্ত্রণালয়কে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়। সরেজমিনে দেখা যায়, এর কোনটিই পালন হয়নি। মূল ফটকে টাকা দিয়ে অবাধে ভেতরে ঢুকছে ফেরিওয়ালা। ভেতরের দোকানগুলোর সঙ্গে যোগসাজশে তারা পণ্য ফেরি করে বেড়াচ্ছে। সূত্র জানায়, কর্মচারীরা কখন আসে কখন যায়, কার দায়িত্ব কে কতটা পালন করছে এর কোন মনিটরিং নেই। না এসে হাজিরা দেয়া থেকে শুরু করে পশুখাদ্য কেনাবেচাÑ সবখানেই চলে টাকার খেলা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চালান ছাড়াই কেনা হয় পশুখাদ্য। কাগজপত্র দেখতে চাইলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা ‘কনফিডেন্সিয়াল’ বলে এড়িয়ে যান সাংবাদিকদের। মৃত্যুর প্রহর গুনছে প্রাণীরা ॥ জানা গেছে, চিড়িয়াখানায় গত বছর ২৬ প্রাণী নানা কারণে মারা গেছে। ৩৩ প্রাণী বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছে। আর সম্প্রতি অসুস্থ হয়ে মারা গেছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার সম্রাট। চিড়িয়াখানায় ৭৯ বছর বয়স্ক কুমির রয়েছে। কিন্তু সে নড়তে চড়তে পারে না। শুধু তার আকৃতির জন্যই দর্শকের ভিড় তার খাঁচার সামনে। হায়েনার অবস্থা জবুথবু। বয়স্ক প্রাণীদের মধ্যে রয়েছে অলিভ বেবুন, বাগডাশা, ভোঁদর, শঙ্খিনী সাপ, উটপাখি, কোশোয়ারি, সারস, লিলফোর্ড সারস, সাদা পেলিক্যান, মদনটাক (ছয়টি), ভারতীয় সিংহ (ভাস্কর, শান্তি), চিত্রা হায়েনা, ডোরাকাটা হায়েনা, কালো ভল্লুক (মিজি ও মিলা), শিম্পাঞ্জি, নীল গাই, হাতি (কুসুমতারা) ও জলহস্তি। অতিরিক্ত বয়সের কারণেই এসব প্রাণীর দেহে শারীরিক নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে। বয়স্কদের মধ্যে অবস্থা খারাপ এমন পাঁচ থেকে ছয়টি প্রাণীকে রাখা হয়েছে চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে। এদের অনেকের দাঁত নেই, নেই হাঁটাচলার শক্তি, কয়েকটি প্রাণীর চোখও নষ্ট হয়ে গেছে। খাবার দিতে হয় গুঁড়ো করে। ফলে তাদের পরিচর্যা ও খাবার সরবরাহে নানা সমস্যা হচ্ছে। এদের দেখভালের জন্য কর্তৃপক্ষকে বাড়তি জনবল কাজে লাগাতে হচ্ছে। বয়স্ক ও অসুস্থ প্রাণীর মধ্যে ঘড়িয়ালের বয়স ৩৬ বছর, কুমির পৌঁছেছে ৭৯-এর কোঠায়, সোনালী বুক বানরের বয়স ৩১ বছর। উটপাখির বয়স ২৬ বছর, মদনটাক ২৭-এ পা রেখেছে। ১৯ বছর বয়সী সিংহও অসুস্থ। শিম্পাঞ্জির বয়স ৩৬ বছর। জলহস্তির বয়স হয়েছে ৩৯ বছর। ২০ বছর বয়সী শঙ্খিনী সাপের অবস্থাও খারাপ। নতুন অতিথি ॥ জাতীয় চিড়িয়াখানার বাসিন্দা আফ্রিকান জলহস্তি, জেব্রা ও এ্যারাবিয়ান হর্স, ইম্পালা ও ওয়াইল্ডবিস্ট পরিবারে জন্ম নিয়েছে নতুন সদস্য। দুটি জলহস্তি শাবকের আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য প্রায় ২ কোটি, জেব্রার ৫০ লাখ ও এ্যারাবিয়ান হর্সের ৫ লাখ টাকা। আর সন্তান সম্ভবা হয়েছে ৮ বছর বয়সের জিরাফ ক্লিওপেট্রা। সবার আগে বিশালদেহী জলহস্তি পরিবারে আসে নতুন দুই অতিথি। একইভাবে এ্যারাবিয়ান হর্স পরিবারে জন্ম নিয়েছে আরেকটি বাচ্চা। পরে ইম্পালা ও ওয়াইল্ডবিস্ট পরিবারে আসে নতুন অতিথি। জাতীয় চিড়িয়াখানার বাসিন্দা জলহস্তি দু’টির জন্ম হয়েছিল কেনিয়ায়। ১৯৯১ সালের জুলাইয়ে কেনিয়া সরকার বাংলাদেশকে এগুলো দান করে। এই প্রাণীর গড় আয়ুষ্কাল ৩২ থেকে ৩৫ বছর। তবে আবদ্ধ পরিবেশে বা বেষ্টনীতে ২৮ থেকে ৩০ বছর বেঁচে থাকে এরা। প্রাণী আনা যাচ্ছে না ॥ দরদাতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্কটে বিদেশ থেকে চাহিদা অনুযায়ী প্রাণী আনা যাচ্ছে না। সর্বশেষ প্রাণী আনার জন্য একাধিকবার দরপত্র আহ্বান করা হয়। কিন্তু কোন প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা দেয়নি। চিড়িয়াখানার প্রাণী ও পাখি আনার জন্য কোন আন্তর্জাতিক দরপত্র গ্রহণ করা হয় না। আর দেশের মাত্র দুটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা বিদেশ থেকে প্রাণী আমদানি করে। এদের মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠান ইতোপূর্বে দরপত্রের নিয়ম ভেঙ্গেছে। যথাসময়ে প্রাণী আমদানি করতে ব্যর্থ হয়েছে। সে কারণে প্রতিষ্ঠানটি আর দরপত্রে অংশ নিতে পারবে না। বাকি রইল একটি। তবে এ প্রতিষ্ঠানটি প্রাণী আমদানির ক্ষেত্রে ততটা সমর্থ নয়। এ কারণে বিপাকে পড়েছে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে ওয়াজার সদস্য না হওয়ায় বিদেশীরাও প্রাণী দেয় না। সেক্ষেত্রে নতুন প্রাণী আনতে হলে চোরাই পথই একমাত্র ভরসা। এসব সমস্যা থেকে উত্তরণের বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে বলে চিড়িয়াখানার কিউরেটর জানিয়েছেন। চিকিৎসা ব্যবস্থা ও জনবল সঙ্কট ॥ চিড়িয়াখানার প্রাণী ও পাখির জন্য চিকিৎসা ব্যবস্থা একেবারেই অপ্রতুল। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভেটেরিনারি পাস করে বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে এন্ট্রি লেভেলের এক কর্মকর্তা এখানে চিকিৎসা বিভাগের প্রধান হন। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিভিএম শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে গৃহপালিত পশু-পাখির চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে জানা। বন্যপ্রাণী সম্পর্কে শুধু পাঠ্যবইয়ের মাধ্যমে কিছুটা জানার সুযোগ থাকে। কিন্তু এই বিভাগে পাস এক শিক্ষার্থীর চাকরির শুরুতে চিড়িয়াখানার মতো স্পর্শকাতর এলাকার চিকিৎসার দায়িত্বে দেয়া হচ্ছে। নেই বন্যপ্রাণীসহ অন্যান্য ভিনদেশী প্রাণীর চিকিৎসার বাস্তব অভিজ্ঞতা। নেই বিদেশে কোন প্রশিক্ষণ। এ বিষয়ে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এখানে এসে পশু ডাক্তাররা দেখে দেখে শেখেন। ওয়াজার সদস্য না হতে পারায় উন্নত প্রশিক্ষণ দেয়া যাচ্ছে না। বিশ্বের অন্যান্য দেশে যারা চিড়িয়াখানায় পশু চিকিৎসক বা অন্যান্য পদে চাকরি করেন তাদের বন্যপ্রাণীর ওপর বিশেষ কোর্স করতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এমনটি হচ্ছে না। পশু-পাখির রোগ নির্ধারণে নেই প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। এছাড়া চিড়িয়াখানায় প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণী এবং দৈনিক শ্রমিক সব মিলিয়ে ১৯৯ কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মরত রয়েছেন। জাতীয় চিড়িয়াখানায় মঞ্জুরিকৃত ২৪৫ পদের মধ্যে ৪৬ পদই খালি রয়েছে। চিড়িয়াখানা এ্যাক্ট নেই ॥ বাংলাদেশের চিড়িয়াখানাগুলোর জন্য কোন এ্যাক্ট নেই। আর এ্যাক্ট না থাকাতে পড়তে হয় নানা ঝামেলায়। আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়াজার সদস্য হতে না পারার অন্যতম একটি কারণ এটি। এদিকে, জাতীয় চিড়িয়াখানায় আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে যাওয়া প্রাণীদের মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য প্রদর্শন করা হচ্ছে। যেগুলো খুবই অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকে সেগুলোকে অভ্যন্তরীণ হাসপাতালে রাখা হয়। অন্য দেশে বার্ধক্যগ্রস্ত প্রাণীদের মেরে ফেলা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এ্যাক্ট না থাকায় এ ধরনের কোন ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত আবদ্ধ খাঁচায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হয় তাদের। সমস্যার পাহাড় ॥ প্রাণী সংরক্ষণ, প্রাণী কল্যাণ, গবেষণা, শিক্ষা ও বিনোদন-এই পাঁচ উদ্দেশে চিড়িয়াখানা প্রতিষ্ঠা হলেও একটি উদ্দেশ্যও পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। পর্যাপ্ত খাদ্য, বসবাসের পরিবেশ ও চিকিৎসার অভাবে প্রাণীগুলোর শারীরিক অবস্থা ভাল নেই। ১৯৭৪ সালে পুরনো আদলে সাজানো চিড়িয়াখানায় দর্শনার্থীদের চলাচলের রাস্তাও পরিচ্ছন্ন নয়। পশুপাখির শেডের আশপাশ ঘিরে ময়লা আবর্জনার স্তূপ। কিছু শেড অকেজো হয়ে আছে। মেরামতের উদ্যোগ নেই। দর্শকদের জন্য যে পাবলিক টয়লেট রয়েছে তা নোংরা এবং ব্যবহার অযোগ্য। শিশুদের বিনোদনের জন্য রয়েছে শিশু পার্ক। তবে সেখানে অকেজো কিছু বিনোদনসামগ্রী রয়েছে। ব্যবহার উপযোগী কোন উপকরণ নেই। পরিবেশও অপরিচ্ছন্ন। পার্কের ভেতরে বসার বেঞ্চগুলো নোংরা। পেছনের কথা ॥ পঞ্চাশের দশকে ঢাকা হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে সীমিতভাবে হাতি, চিত্রা হরিণ, বানরসহ কয়েকটি প্রজাতির বন্যপ্রাণী নিয়ে ঢাকা চিড়িয়াখানার যাত্রা শুরু হয়। মিরপুর এলাকায় ১৯৬০ সালে চিড়িয়াখানা প্রতিষ্ঠার জন্য একটি মহাপরিকল্পনা অনুমোদিত হয়। ১৯৬১ সালে চিড়িয়াখানা প্রতিষ্ঠা এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য একটি উপদেষ্টা বোর্ড গঠন করা হয়। প্রাণীদের বাসস্থান ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি, হাইকোর্ট সংলগ্ন চিড়িয়াখানা হতে বন্যপ্রাণী স্থানান্তর ও দেশ-বিদেশের প্রাণী সংগ্রহের পর ১৯৭৪ সালের ২৩ জুন জনসাধারণের জন্য বর্তমান চিড়িয়াখানা উন্মুক্ত করা হয়। ঢাকা পাল্টে জাতীয় চিড়িয়াখানা ॥ সরকারের মন্ত্রিসভার অনুমোদনক্রমে ‘ঢাকা চিড়িয়াখানা’ নাম পরিবর্তন করে ‘বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানা’ করা হয়েছে। নতুন নাম এখন থেকে কার্যকর হবে। ২০১২ সালে জাতীয় চিড়িয়াখানা ঘোষণার প্রথম উদ্যোগ নেয়া হলেও ২০১৫ সালে এসে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলো। নতুন নামের বিষয়ে ২০১৪ সালের ১৮ ডিসেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি এবং সর্বশেষ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ৫ ফেব্রুয়ারি সম্মতি দেয়। তার ভিত্তিতে নতুন নামকরণ করা হয়েছে। দর্শনার্থীদের বক্তব্য ॥ মানিকগঞ্জ থেকে স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে চিড়িয়াখানায় এসেছেন প্রবাসী জামাল উদ্দিন। তিনি দুবাই থাকেন। দু’মাসের ছুটিতে দেশে এসেছেন। হাতে সময় কম বলেই স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে রোজার মধ্যেই এসেছেন চিড়িয়াখানায়। তবে চিড়িয়াখানার অবস্থা দেখে মোটেও সন্তুষ্ট নন তিনি। জনকণ্ঠকে জামাল বলেন, সারাদিন চিড়িয়াখানায় ঘুরে তেমন কিছুই দেখতে পেলাম না। অনেক খাঁচা খালি। পশুপাখিগুলোও বেশিরভাগ ঘুমাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে এগুলো রোজা রেখেছে। জামাল বলেন, অনেক জায়গায় ময়লা আবর্জনা রয়েছে। খাঁচার সামনে বিশ্রী দুর্গন্ধ। সরকারের এদিকে খেয়াল দেয়া উচিত। কিউরেটরের বক্তব্য ॥ চিড়িয়াখানার দুর্নীতি তদন্তে কমিটি গঠনের বিষয়ে জাতীয় চিড়িয়াখানার কিউরেটর ডা. এনায়েত হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, আসলে দুর্নীতি তদন্তে নয় কমিটি গঠন হয়েছিল চিড়িয়াখানার সার্বিক বিষয় নিয়ে। এই কমিটি বেশকিছু সুপারিশ করেছে যা বাস্তবায়নের কাজ চলছে। চিড়িয়াখানার ভেতরে যে অবৈধ দোকান রয়েছে প্রথমে তা না জানার ভানই করলেন কিউরেটর। পরে জনকণ্ঠের প্রতিবেদক তাকে কয়েকটি ছবি দেখানোর পর তিনি জানান, এসব দোকানকে সরিয়ে নিতে বলা হয়েছে। চলতি মাসের মধ্যেই তারা চলে যাবে। তিনি বলেন, স্থানীয় প্রভাবশালী লোকজন দোকানগুলো বসিয়েছে। তাই দোকান ওঠাতে তাদের বেগ পেতে হচ্ছে। এসব দোকানির যোগসাজশে দর্শনার্থী হয়রানির কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, এমন অনেক অভিযোগ আমার কাছে আসে। প্রাণিগুলোর এই অবস্থা কেন জানতে চাইলে কিউরেটর ডা. এনায়েত হোসেন বলেন, চিড়িয়াখানা আধুনিকায়নের কাজ শুরু হয়েছে। এটা বড় প্রকল্প। এটা শেষ হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। আধুনিকায়নের কাজ কতদূর জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখনও পরিকল্পনা পর্যায়ে আছে। কতদিন লাগবে বলা যাচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, নতুন কিছু প্রাণী আনা দরকার বলে আমরা প্রস্তাব পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু প্রাণী ক্রয়ের জন্য প্রাক্কলিত ব্যয় ৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা অনুমোদিত হয়নি। নতুন প্রাণী না এনে যারা আছে তাদের দেখভালে পরিবর্তন আনবেন কিনা প্রশ্নে তিনি আবারও আধুনিকতার প্রকল্পের কথা বলেন এবং যেসব প্রাণী আছে তাদের রক্ষণাবেক্ষণ শতভাগ হচ্ছে বলেও দাবি করেন।
×