ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জাহানারা ইমাম স্মারক বক্তৃতা ও আলোচনায় স্পীকার ড. শিরীন শারমিন

জঙ্গীবাদ দমনে কোন আপোস করা যাবে না

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ২৭ জুন ২০১৫

জঙ্গীবাদ দমনে কোন আপোস করা যাবে না

স্টাফ রিপোর্টার ॥ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করতে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন আরও বেগবান ও ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন জাতীয় সংসদের স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। শুক্রবার শহীদ জননী জাহানারা ইমামের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এ আহ্বান জানান তিনি। তেইশ বছর আগে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মশালটি সযতেœ জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। যুুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে নব্বইয়ের দশকে গড়ে তুলেছিলেন সোচ্চার আন্দোলন। এমনকি প্রতীকী আদালত গঠন করে একাত্তরের বিশ্বাসঘাতকদের শাস্তিও দিয়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধার গর্বিত মা, বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও সংগঠকের সেই বিচারের স্বপ্ন পেয়েছে বাস্তবতার পথ। চলছে মানবতাবিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজ। শুক্রবার ছিল এই মহিয়সী নারীর ২১তম মৃত্যুবার্ষিকী। আর প্রয়াণবার্ষিকীতে নানা আয়োজনে হৃদয়ের ভালবাসা শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করা হলো শহীদ জননীকে। বৃষ্টি উপেক্ষা করে সকালের প্রথম প্রহরে ফুলে ফুলে ছেয়ে যায় তাঁর মিরপুরের সমাধি। এছাড়া একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আয়োজনে শহীদ জননীকে নিবেদিত স্মারক বক্তৃতা, আলোচনা সভা ও তাঁর নামে প্রবর্তিত পদক প্রদান করা হয়। সকালে ধানম-ির ডব্লিউভিএ মিলনায়তনে জাহানারা ইমাম স্মারক বক্তৃতা ও আলোচনা সভার আয়োজন করে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। এছাড়া অনুষ্ঠানে প্রদান করা হয় জাহানারা ইমাম স্মৃতি পদক। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। ‘বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলন (১৯৬১-১৯৭১)’ শীর্ষক স্মারক বক্তৃতা করেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সঙ্গীতজ্ঞ ও ছায়ানটের সভাপতি সন্্জীদা খাতুন। প্রতিবছরের মতো এ বছরও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের বরেণ্য ব্যক্তিত্ব ও সংগঠনকে প্রদান করা হয় জাহানারা ইমাম স্মৃতি পদক। ব্যক্তি হিসেবে অধ্যাপক অজয় রায়কে এবং সাংগঠনিকভাবে ছায়ানটকে প্রদান করা হয় এই পদক। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নির্মূল কমিটির সহ-সভাপতি শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী। সূচনা বক্তব্য রাখেন নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির। এছাড়াও আলোচনায় অংশ নেন উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতি কামাল লোহানী এবং ইতিহাসবিদ ও লেখক অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। বক্তাদের আলোচনায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারসহ জঙ্গীবাদমুক্ত একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র বিনির্মাণের প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়। জঙ্গীবাদের অপতৎপরতা কঠোরভাবে দমনে এবং অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ার বিষয়ে কোন ধরনের আপোস না করে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন জাতীয় সংসদের স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, একটি ন্যায়-নিষ্ঠ সমাজ বিনির্মাণে যুদ্ধাপরাধের বিচার করা অনিবার্য। যুদ্ধাপরাধের বিচার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ আমাদের মানবিক মর্যাদাকে ভুলুণ্ঠিত করে, জাতিসত্তার মূলে কুঠারাঘাত করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করেছে, ইতোমধ্যে বিচারের রায় কার্যকর হচ্ছে। দুইজন যুদ্ধ অপরাধীর মৃত্যুদ- কার্যকর হয়েছে, যা শেখ হাসিনার সরকারের বড় অর্জন। শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, সংবিধানের আলোকে স্বাধীনতার চেতনায় গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি সকলকে একযোগে কাজ করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল সমাজ বিনির্মাণে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে বাংলাদেশকে একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে সকলকে একযোগ কাজ করতে হবে। স্পীকার বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সুদীর্ঘ সংগ্রাম ও রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ৩০ লাখ শহীদ ও ২ লাখ মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্র বাংলাদেশের মানুষের মহান অর্জন। দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে স্বাধীনতার চেতনা সমুন্নত রেখে একটি উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে। দারিদ্র্য বিমোচন, বৈষম্য দূরীকরণসহ ধনী-গরিবের ব্যবধান কমিয়ে আনতে হবে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে হবে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সংস্কৃতির ভূমিকা তুলে ধরে স্পীকার বলেন, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মহান মুক্তিযুদ্ধসহ সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে প্রেরণা যুগিয়েছেন সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা। আমাদের জাতিসত্তার সঙ্গে মিশে আছে সাংস্কৃতিক বোধ। আমাদের সকল চিন্তা-চেতনা এবং মেধা ও মননে এই সাংস্কৃতিক বোধ সদা জাগ্রত। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলন (১৯৬১-১৯৭১) শীর্ষক স্মারক বক্তৃতায় ছায়ানটের সভাপতি অধ্যাপিকা সন্জীদা খাতুন বলেন, পূর্ববাংলার সংস্কৃতি আন্দোলন শুরু হয়েছিল ভাষা আন্দোলন থেকে। ১৯৪৭ এ শুরু হয়ে বায়ান্ন সালের রক্তক্ষরণের ভেতর দিয়ে শক্তিশালী হয়ে ভাষার অধিকার সংরক্ষণ করেছিল বাঙালী। ভাষা জাতীয় সংস্কৃতির প্রধান বাহন বলে ভাষার সম্মান এবং অধিকার আদায় আমাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ভিত্তিপ্রস্তুত করে দিয়েছিল। এরপর একষট্টি সালে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ এসে বাঙালীর হৃদয়-দুয়ারে করাঘাত করল। তিনি বলেন, ভাষা, সংগীত আর সাহিত্যের উৎকর্ষ সাধন করে বাঙালীকে বিশ্বমুখী হয়ে উঠবার আহ্বান ঘোষণা করেছেন যে রবীন্দ্রনাথ, তিনি বাঙালীর আপনজনÑ এটা উপলব্ধি করলেন সবাই। অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন বলেন, ১৯৪৭ থেকে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিককর্মীরা যে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ার লক্ষ্যে কাজ করছিল তা থেকে সাংস্কৃতিককর্মীরা বিচ্যুত হয়নি। বিচ্যুত হয়েছে রাজনীতিবিদরা। তিনি মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উল্লেখ করে বলেন, ইতিহাসের সত্য উপেক্ষা করা যাবে না। মানবতাবিরোধী অপরাধের শাস্তি কেবল মৃত্যুদ-ই হওয়া উচিত। অধ্যাপক অজয় রায় বলেন, জাহানারা ইমাম কেবল একজন ব্যক্তি নন; তিনি একটি প্রতিষ্ঠান। এই মহিয়সী নারী না জন্মালে আমাদের আন্দোলন অনেকখানি স্থিমিত হয়ে যেত। তিনি ব্লগার হত্যা প্রসঙ্গে বলেন, একের পর এক ব্লগার হত্যা হচ্ছে কিন্তু সরকার প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা কোন প্রতিক্রিয়া জানাননি। তিনি বলেন, ব্লগাররা আস্তিক হোক বা নাস্তিক হোক তাদের হত্যার দায়িত্ব তো কারও নেই। গোয়েন্দা বাহিনী চিহ্নিত হত্যাকারীদের ধরছে নাÑ এটা কি ইচ্ছাকৃত? এই স্মারক বক্তৃতা ও আলোচনা সভার আগে বৃষ্টি উপেক্ষা করে সকাল সাড়ে সাতটায় একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টসহ বিভিন্ন সামাজিক রাজনৈতিক সংগঠনের পক্ষে মিরপুরে শহীদ জননীর সমাধিতে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করা হয়।
×